ইনসাইড থট

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও স্থায়ী পঙ্গুত্ব রোধে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা


প্রকাশ: 26/05/2022


Thumbnail

পবিত্র ঈদুল ফিতরের আনন্দ শুরু করতেই দুঃখের কালোমেঘে রাজু আহমেদ এর সুখী সংসারের চারিদিক অন্ধকার নেমে এলো। একটি ছেলে একটি মেয়ে নিয়ে তার চারজনের ছোট সংসার। আমার পৈতৃক নিবাস জুরাইনে, নিজ বাড়িতে বসবাস করে। রাজু আহমেদ পরিবারের বড় মেয়ে আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের ছাত্রী। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান, এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। গত ১ এপ্রিল ঈদ পূর্ববর্তী আনন্দে বন্ধুদের সাথে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বেরিয়েছে। সে এক বন্ধুর মোটরসাইকেলে পিছনের সীটে বসা ছিল। পথিমধ্যে ট্রাকের সাথে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সাবেক পঙ্গু হাসপাতাল বর্তমানে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (NITOR) ভর্তি হয়েছে। আমার এলাকার একটি ছেলে গুরুতর আহত, খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে ছুটে গেলাম। আরাফাত রহমান একজন ডগবগে যুবক। কি সুন্দর দেখতে!  বিছানায় শুয়ে আছে। পা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। এক্স-রে রিপোর্ট অনুযায়ী ডান পায়ের লম্বা মোটা হাড়টি (Tibia) ভেঙে গেছে। পায়ের গোড়ালীর ছোট ছোট কয়েকটি হাড় ফেঁটে গেছে। হাঁটু থেকে গোড়ালী পর্যন্ত মাংসপেশিগুলো (Cuff muscles) হাড় থেকে সরে গেছে। প্রাণে বাঁচলেও অবস্থা গুরুতর। পা কেটে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে। বাবা-মায়ের চোখে অন্ধকার। বাবা-মায়ের আকুতি, ‘আমার ছেলের পা‘টা বাঁচান‘। রোগীর ভীড়ে হিমসিম খাচ্ছে চিকিৎসকরা। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা অপারেশনের রোগীর লাইন লেগেই আছে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (NITOR) এর পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ডাঃ গনি মোল্লা ও অধ্যাপক ডাঃ মো: ওয়াহিদুর  রহমান  এর স্মরণাপন্ন হলাম। উনাদের হস্তক্ষেপে ডাক্তারদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অবশেষে পা বাঁচানো গেল বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চলবে। পায়ের উরু থেকে মাংসসহ চামড়া নিয়ে গ্রাফটিং করা হয়েছে। অনেকগুলো লম্বা লম্বা ষ্টীলের রড দিয়ে পা‘ এর লম্বা হাড় ফিক্স করে রাখা হলেও গোড়ালীর ছোট ছোট হাড়গুলির কি হবে বুঝতে পারছি না। বিছানায় শুয়ে আছে। কবে নিজ পায়ে দাঁড়াবে বা আদৌ স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারবে কিনা, মহান আল্লাহই জানেন। এ ছেলের বা তার পরিবারের কত স্বপ্ন ছিল। একটি ছেলে, একটি মেয়ে নিয়ে ছোট পরিবার, সুখী পরিবার। পরিবারের পরিকল্পনা ঠিকই ছিল। বড় মেয়ে প্রকৌশলী হবে। ছোট ছেলে ডাক্তার হবে বা অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করবে। একটি দুর্ঘটনা ঐ ছোট পরিবারটির স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। এমনি অসংখ্য দুর্ঘটনার খবর প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। 

৫০ বছর বয়সী সিরাজ। এবারের ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। কুমিল্লা থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (NITOR) উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পুরো পরিবারের ঈদ আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া এলাকার হৃদয় হাসান (২৬) ঈদের পরদিন ১৮ জন বন্ধু মিলে মোটরসাইকেলে করে সিলেটের উদ্দেশে ঘুরতে বের হয়েছিল। দুর্ঘটনায় পড়ে তার ঠাঁই হয়েছে পঙ্গু হাসপাতালে। একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সঙ্গে থাকা বন্ধুর অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে মোটরসাইকেল আরোহীদের হেলমেট ব্যবহার প্রায় শতভাগ নিশ্চিত হলেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী এবার ঈদের ছুটির চার দিনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কেবল ঢাকার NITOR এ ই মারা গেছেন ৬০ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮ শতাধিক যার অধিকাংশই বয়সে তরুণ। বেঁচে থাকা অনেকের হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে হু হু করে বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এবার ঈদুল ফিতরে লাখ লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরেন।

তথ্যমতে, ঈদের সময় তিন দিনে ২১ হাজার ৩৬০টি মোটরসাইকেল বঙ্গবন্ধু সেতু পারাপার হয়, যা ১৯৯৮ সালে সেতুটি চালুর পর রেকর্ড। ২ মে থেকে ৭ মে পর্যন্ত ৬ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায়  রাজধানীর NITOR-এ ১ হাজার ২৫০ জনের বেশি রোগী ভর্তি হন। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভর্তি রোগীদের ৩০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। অনেকেরই হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে হাসপাতালটিতে দৈনিক দেড়’শ জনের মতো রোগী এলেও ঈদের সময় রোগীর সংখ্যা পৌঁছে যায় ২০০ থেকে ২৫০ জনে। ২ মে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ১৯৭ জন হাসপাতালে আসেন। তাদের মধ্যে সংকটাপন্ন অবস্থায় ৬৫ জনের অস্ত্রোপচার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এদিকে দুর্ঘটনা এড়াতে মোটরসাইকেল চালকদের জন্য নতুন নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী, সাড়ে ৩৬ লাখ মোটরসাইকেল নিবন্ধন করা হলেও দেশে নিবন্ধিত চালকের সংখ্যা সাড়ে ২৩ লাখ। অর্থাৎ সরকারী তথ্য অনুযায়ী ১৩ লাখ মোটরসাইকেল চালক রয়েছেন যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনার হার ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে সড়কে যত হতাহতের ঘটনা ঘটছে, এর ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণে হচ্ছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ঈদুল ফিতরের ছুটির আগে-পরের দুই সপ্তাহে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৩ জন নিহত হন। নিহতের ৪৩ শতাংশই ছিলেন মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। নিহতদের বড় অংশই ছিল কিশোর-তরুণ। গণমাধ্যমে আসা খবরের চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে আরও অনেক বেশি। দুর্ঘটনায় পড়ে পঙ্গু হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেলেই প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৪৫০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। সারা দেশে এই সংখ্যা ২ হাজারের মতো। এর মধ্যে ৩৫-৪০ ভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। সব খবর পত্র-পত্রিকায় আসছে না। 

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে যাতে  মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ এবং এ দুর্ঘটনাগুলোতে মৃত্যু ৫১ শতাংশ বেড়ে যায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, মোটরসাইকেল অন্যান্য যানবাহনের চেয়ে ৩০ গুণ ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর ওপর নানা বিধিনিষেধ দেওয়া হয়।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আমরা অনেক তরুণকে হারাচ্ছি। যারা বেঁচে থাকছেন, তারা পঙ্গুত্ব বরণ করে নিজের, পরিবারের ও দেশের জন্য বোঝা হয়ে বেঁচে থাকছে। মোটরসাইকেল চালানো এক ধরনের ‘আসক্তি‘র মতো। এর ডিজাইনও করা হয় তরুণদের আকর্ষণ করার উপযোগী করে, যে কারণে যারা মোটরসাইকেল চালায়, তাদের প্রাইভেট কার দিলেও চালাতে চান না।  

প্রতিদিনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের তালিকা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রতিদিন কোন না কোন পরিবারের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তারপরও আমরা সচেতন হই না। ‘পাঠাও’ নামে অনুমোদিত বাহনের পাশাপাশি অনঅনুমোদিত বাহনের সংখ্যা কত? এর কোন পরিসংখ্যান নাই। ঐসকল বাহনের কতজনের বৈধ লাইসেন্স রয়েছে তারও কোন হিসাব নেই। আর অভিভাবকরাও দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছি কি? আমার ছেলে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। কোথায় যাচ্ছে? কার বাইকে চড়ছে? চালকের লাইসেন্স রয়েছে কিনা? খোঁজ রাখি কি? 

অফিসিয়াল কাজে আগে ৫০ সিসি বা ৮০সিসি মোটরসাইকেল সরবরাহ করা হতো। কম অশ্বশক্তির ইঞ্জিন চালিত মোটরসাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ। দুর্ঘটনা ঘটলেও মরনঘাতি হয় না। কিন্তু বর্তমানে ৩০০ সিসি বাইকের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। অফিসে যেতে তো ৩০০ সিসির বাইক দরকার নেই। রাস্তায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনারোধে সরকার ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে। দূরপাল্লার ভ্রমণে মোটরসাইকেল ব্যবহার বন্ধ করাই শ্রেয়।

রাস্তায় দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা লাইসেন্স ও অন্যান্য কাগজপত্র পরীক্ষণ ও বেপরোয়া চালনা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট চেষ্টা করলেও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এ ব্যাপারে আমাদের সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭