ইনসাইড থট

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা: পিছনের রহস্য এবং আমাদের দায়িত্ব


প্রকাশ: 26/05/2022


Thumbnail

আঁচল ফাউন্ডেশন-এর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১০১ জন ছাত্র-ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে একটি দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী হিসেবে বিবেচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের জ্ঞানের আলোয় আগামীদিনের বাংলাদেশকে আলোকিত করবে সেখানে, আজ তারাই আলোহীনভাবে দিশেহারা হয়ে আত্মহত্যা করছে বা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছে যা সত্যিই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি বা উদ্বেগের কারণ। চলুন, প্রথমেই খুঁজে দেখা যাক, ঠিক কি কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা আত্মহত্যা করছে বা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছে।

প্রথমত, যদিও বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক গতিতে চলছে কিন্তু তার পরেও দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার প্রভাব এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠা যায়নি, যেমন- সেশন জ্যাম, পড়াশুনায় আগের মত মনোযোগ দিতে না পারা, পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও চাকরি নামক যুদ্ধে সুযোগ কমে যাওয়ার ভয়, সরকারি চাকরিতে প্রবেশাধিকারেরে বয়স শেষ হয়ে যাওয়ার পথে, বয়স বেড়ে যাচ্ছে কবে নাগাদ পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পারবে, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, দীর্ঘদিন চাকরি নামক সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে ছুটতে হতাশ হয়ে পড়া, প্রিয় মানুষদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার ভয়, সম্পর্কের টানাপোড়ন, জীবনের প্রায় পুরোটা জুড়ে থাকা সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির হঠাৎ করে ছেড়ে চলে যাওয়া, একাকীত্বে ভোগা, সমবয়সীদের থেকে অনেক বেশী পিছিয়ে পড়া বা পড়ে যাওয়ার শঙ্কা, চাকরির ক্ষেত্রে নৈরাজ্য বা দুর্নীতি নিয়ে হতাশা কিংবা ক্রোধ, নিজের বা প্রিয় মানুষদের প্রত্যাশানুযায়ী চাকরি বা স্বপ্ন পূরণ করতে না পারা বা ব্যর্থ হওয়ার ভয় এবং সর্বোপরি ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা তাদের মধ্যে একধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি করে। আত্মহত্যাপ্রবণ ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বড় অংশ আছে যারা দীর্ঘদিন ধরে এইসব কষ্টের বা সমস্যার কথাগুলো কাউকে বিশ্বাস বা ভরসা করে বলতে না পেরে তাদের সচেতন বা অবচেতন মনে একের পর এক জমাতে থাকে যা একসময় তার ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে সে তার নিজের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তখন তার জীবনের সমস্ত আনন্দ-সুখ ব্যর্থতায়-হতাশায় পর্যবসিত হয় এবং নিজ জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সব পথ তার কাছে বন্ধ বলে মনে হয়। ফলে একসময় যে জীবন ছিল হাসি-আনন্দময়, ছিল অনেক স্বপ্ন-আশা-ভালবাসা, আজ সেই মহামূল্যবান জীবনকে নিজের কাছে অসহ্য বলে মনে হয় এবং সে বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলে। আর তাই এই দুর্বিষহ-যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে নিজেকে সহজে মুক্তি দিতে আত্মহত্যাকেই একমাত্র সহজ সমাধান হিসেবে দেখে। এই আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী ছাড়াও বন্ধু-বান্ধব, পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

যেহেতু চাকরির পাওয়ার অনিশ্চয়তা আত্মহত্যার পিছনে একটি বড় কারণ হতে পারে, সে জন্য শিক্ষাব্যবস্থা চাকরির বাজারের চাহিদার সাথে সমন্বয় করে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের শিক্ষাজীবনেই চাকরি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাগুলো অর্জন করতে পারে। এছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন ধরনের একাডেমিক কিংবা ব্যক্তিগত যে কোন সমস্যায় শিক্ষকদের সহানুভূতিশীল ও নমনীয়তার সাথে সমস্যাগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে পাশে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা তাদেরকে ভরসা দিবে এবং সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেয়া যারা শিক্ষার্থীদের মনের গভীরে জমানো কষ্টের কথাগুলো শুনে তাদের নেতিবাচক ও অযৌক্তিক চিন্তাতে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে সামনের দেখতে না পাওয়া পথগুলোকে দেখতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার প্রয়োজনীয় মনোসামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদেরকে আত্মহত্যার পথ থেকে অনেকাংশে ফিরিয়ে আনতে পারে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সেন্টারের কার্যক্রম এবং শিক্ষকদের মধ্য থেকে যোগ্য ছাত্র-উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি আত্মহত্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীদের কাছে পৌঁছানোর আগে, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কাছের মানুষদের বিশেষ করে তার পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব কিংবা নিকট আত্মীয়-স্বজনদেরকেই প্রথম ভূমিকা পালন করতে হবে যাতে তারা প্রাথমিকভাবে সাহায্য করার কাজটি করতে পারে। যেমন ধরুন, তাদেরকে যথাসম্ভব সময় দিয়ে ধৈর্য ধরে নিরপেক্ষ থেকে তাদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনা ও সমাধানের চেষ্টা করা, কাছের মানুষ হিসাবে তাদের প্রত্যেকের উচিত এধরণের সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের নেতিবাচক বা দুর্বলতার বিষয়গুলোকে নিয়ে বার বার খোঁচাখুঁচি বা মজা না করে তাদের মধ্যকার ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার মাধ্যমে তাদেরকে উৎসাহিত করা। কারণ আপনার কাছে যা মজার বা আনন্দের অন্যের কাছে সেটা ক্ষতির কারণ হতেই পারে। এছাড়াও আত্মহত্যা প্রবণতার লক্ষণগুলো সম্পর্কে প্রত্যেকের সচেতন থাকা যাতে সহজেই তারা আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পারে এবং এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। অন্যদিকে প্রিয় মানুষ হিসেবে তার পাশে থাকার ভরসা দেওয়া যে জীবনে যাই ঘটুক  না কেন আপনি তার পাশে আছেন এবং থাকবেন।

পরিশেষে বলতে চাই, সমাজের একজন হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাধ্যমত যতটুকু সম্ভব অন্যের সমস্যা সমাধানে পাশে থাকা, কারণ আপনার সামান্য সাহায্য অন্যের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি হতে পারে যা তাদের অগোছালো জীবনকে কিছুটা হলেও ছন্দে ফিরিয়ে আনতে পারে। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, একটি আত্মহত্যা শুধু একজন মানুষকে নয় একটি পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আসুন নিজে সচেতন হই অন্যকেও সচেতন করি। ভালো থাকুক আমাদের প্রিয় ছাত্রসমাজ।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭