ইনসাইড থট

নতুন বছর নিয়ে আশা, নতুন বছর নিয়ে আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 01/01/2018


Thumbnail

নতুন বছরে পালন করা অন্যতম একটি আচার হলো আকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলোর তালিকা তৈরি যেখানে থাকে নিজেদের নিয়ে, পরিবার নিয়ে, দেশকে নিয়ে সর্বোপরি মানবতা নিয়ে প্রত্যাশা। অবশ্য, সবাই একই রকম নিঃস্বার্থ নয়, তাই সবার প্রত্যাশাও একরকম হয়না, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং কাছের ও প্রিয় মানুষের মঙ্গল কামনা করেন। গত বছরও আমরা একই আচার পালন করেছিলাম এবং আমি যতটুকু মনে করতে পারি, আমাদের পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো ২০১৭ সালে ঘটনা প্রবাহ ভালোর দিকে মোড় নেবে এমন প্রত্যাশাই করেছিল। একজন টক শো উপস্থাপক তো ঘোষণা করেছিলেন ২০১৭ সালে মাদকের অবসান ঘটতে চলেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের প্রতিরোধে বিপুল পরিমাণ আদক আটক এবং মাদক ব্যবসায়ীদের আটকের কথাই ছিল তাঁর প্রত্যাশার ভিত্তি।

তবে এমন আশাব্যাঞ্জক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। মাদকের ব্যাপকতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢলকেও দায়ী করতে হবে, কারণ এদের অনেকেই মাদক পাচারের বাহক হচ্ছে। শরণার্থী সমস্যা নিয়ে শক্ত নীতিগত অবস্থানের কারণে মিয়ানমারের নেতাদের বাংলাদেশ নিয়ে অ্যালার্জি থাকতে পারে। কিন্তু মাদক পাচারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইয়াবার ক্ষেত্রে তারা আবার বাংলাদেশের মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গ যোগাযোগ রক্ষা করতে নিজ দেশের মাদক সম্রাটদের উৎসাহ দেয়। আর এই কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ীরা, যাদের অনেকেই রাজনীতিকদের আশ্রয়- প্রশ্রয় ভোগ করে, নিজের দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে জেনেও এই ব্যবসা চালিয়ে আসছে। সত্যিকার অর্থে ২০১৮ সালে মাদক ব্যবসা থেমে যাবে বলে আমি মনে করি না কারণ, বছর বছর এই অপরাধীদের সংখ্যাক
কয়েকগুণ বেড়েছে। প্রশাসনও বহুল আলোচিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি দেখানোর বদলে চোখ বন্ধ রেখে তাঁদের ব্যবস্থা করতে দিচ্ছে।

এমন অনেক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই নতুন বছর আসছে। ২০১৭ সালে অপহরণ ও নিখোঁজের ঘটনা বেড়েছে, যেখানে অনেক্ষেত্রেই কোনো সূত্র না রেখেই এমন ঘটেছে। নিখোঁজ বাংলাদেশিদের অনেকেই ছিলেন সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী এবং শিক্ষক। সৌভাগ্যবশত কয়েকজন ফিরে এসেছেন। কিন্তু অনেকের অবস্থা সম্পর্কে আমাদের আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনী এখনো অন্ধকারেই আছে। কি কারণে, কে তাদের তুলে নিয়ে গেছে তা কেউ জানেনা। কিন্তু গুম-অপহরণের এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নেতিবাচক বার্তা দেয়। এছাড়া আমদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যেখানে আছে আমাদের অর্থনৈতিক যা বিশেষত বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।

পরিবেশ আমদের আরেকটি উদ্বেগের বিষয়। বিশ্বের সামনে আমরা নিজেদের এমন এক জাতি হিসেবে উপস্থাপন করেছি, যাদের নদী, বন এবং স্পর্শকাতর বাস্তুতন্ত্র নিয়ে কোনো উদ্বেগই নেই। নিম্নভূমি এবং জলাভূমিকে রক্ষার বদলে আমরা সেগুলো ভরাট করছি। পরিবেশ ধ্বংসের ফলাফল যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভুগতে হয় সেটি ভুলে গিয়ে আমরা উন্নয়নের নামে গাছ এবং পুরো বনাঞ্চল উজাড় করছি (যেমনটা ঘটেছে চন্দ্রা-কালিয়াকৈর সহ দেশের অনেক এলাকায়)। আমাদের নদীগুলোর জন্য আমাদের কোনো সম্মান-ভালোবাসা নেই। (বুড়িগঙ্গার মত) অনেক নদী এখন এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে, তা উদ্ধার করা সাধ্যের অতীত। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নদী দূষণ এবং দখল চলছে। আর দোষীদের অনেকেই রাজনৈতিক প্রভাবশালী, যার কারণে তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০১৭ সাল জুড়ে এসব ঘটে চলেছে। ২০১৮ সালে কি এই কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে?

গত এক দশকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের কাছে শিক্ষার সুবিধা পৌছানোয় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। নিঃসন্দেহে শিক্ষা ব্যবস্থা এখন অনেক বেশি উন্মুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মেয়ে স্কুলে আসতে এবং পড়ালেখা শেষ করতে পারছে। কিন্তু শিক্ষার নূন্যতম মান যা আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজের জায়গা করে নিতে সাহায্য করবে, তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। কয়েক দশকের ব্যর্থ এবং উদ্যমহীন প্রচেষ্টার পর ২০১০ সালে আমরা ১৯৭৪ সালের কুদরত-ই-খুদা কমিশনের সুপারিশের আংশিক প্রতিফলনে একটি শিক্ষা নীতি প্রণয়নে সফল হয়েছি। শিক্ষা উন্নয়নে কুদরত-ই-খুদা কমিশনের রিপোর্ট ছিল সদ্য স্বাধীন জাতির আত্ম উন্নয়নের একটি অসাধারণ পরিকল্পনা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সরকার এই রিপোর্টি অগ্রাহ্য করেছিল। কিন্তু ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষা নীতির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো দূর বাস্তবতা। একটি কার্যকরী কর্মপরিকল্পনার অভাবে- জাতীয় শিক্ষা নীতির যা হয়ে ওঠার কথা ছিল- শিক্ষা খাতে আমাদের কর্মকান্ড এখনো বিশৃঙ্খল। সরকার স্কুল পর্যায়ে- প্রাথমিক এবং নিম্ন মাধ্যমিকে দুটি পাবলিক পরীক্ষা চালু করেছে, যা ভালোর চেয়ে ক্ষতিই করেছে বেশি। যদিও জাতীয় শিক্ষা নীতিতে এই দুটি পরীক্ষার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি তারপরও শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর নামে এই পরীক্ষাগুলো চালু করা হয়। এর পরিবর্তে পরীক্ষা দুটি একদম গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত প্রাইভেট পড়াকে উৎসাহিত করছে। এর ফলে আরও অনেক অনৈতিক চর্চাও হচ্ছে যার মধ্যে আছে প্রশ্ন ফাঁস। ২০১৭ সালের সবচেয়ে লজ্জার সংবাদটি ছিল বরগুনার বেতাগী উপজেলায় দ্বিতীয় শ্রেণির প্রশ্নপত্র ফাঁস হবার মত একটি ঘটনা, যার জেরে ১৪০ টি সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছিলো।

তবে ২০১৮ সালে এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের অনেক সুযোগ রয়েছে। শুরুতেই সরকারকে অপ্রয়োজনীয় পাবলিক পরীক্ষা দুটি বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে প্রাইভেট কোচিং নিষিদ্ধ করত হবে এবং শিক্ষকদের বেতন ও সুবিধাদি বাড়াতে হবে যেন তাঁরা প্রাইভেট কোচিং না পড়ান। শ্রেণীকক্ষে পাঠদান পদ্ধতি, পরীক্ষা ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন সৃজনশীল করতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে। ২০১৭ সালে আমি দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা গুলোতে একটি সংবাদ পড়ে চমকে উঠেছিলাম, যে ভারত, শ্রীলংকা, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আরও কিছু দেশ থেকে আসা ‘সুপার ম্যানেজার’রা প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার নিজেদের দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। স্পষ্টত আমরা ‘সুপার ম্যানেজার’ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি, কেননা একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান চালাতে যে ভাষাগত ও বিষয়গত দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন তা যোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন পরীক্ষার্থী উৎপাদন করছে, যারা পরীক্ষায় ভালো ফল করে একটি সার্টিফিকেট পেয়েই সন্তুষ্ট, কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতে ব্যবসা, প্রাগ্রসর ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির প্রতিযোগিতাপূর্ণ জগতের মুখোমুখি হওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়।

২০১৮ সাল হতে চলেছে নির্বাচনী বছর, যেটি স্বভাবত একটি উৎসবের বছর হওয়ার কথা। বিরল কিছু মূহুর্তে আমরা দেখিয়েছি নির্বাচন একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্বাচন মানেই রক্তপাত এবং সংঘাত। বিএনপি এবং আর মিত্রদের বর্জন করা ২০১৪ সালের নির্বাচন অসংখ্য মৃত্যুর কারণ হয়েছে। যাত্রীভর্তি বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে গুলি এবং বোমা নিক্ষেপ করে নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।  আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সেইসব খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার হয়েছিলো, যা বহির্বিশ্বে একটি শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছে। মানুষজন এখন ভয়ে আছে  ২০১৮ সালেও ২০১৪ এর পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আর আশঙ্কা  সংঘাতের ভয়াবহতা আরও বাড়তে পারে। কিন্তু আমাদের সামনে একটি সুযোগ আছে বহির্বিশ্বের সামনে আমাদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয় আমরা তার চেয়ে ভালো। ঠিক যেভাবে আমরা বহির্বিশ্বের সামনে প্রতিষ্ঠিত করেছি যে আমরা বিবেকবুদ্ধি শূন্য কোনো জাতি নই যারা ধর্মের নামে রক্তপাতকে সমর্থন করে, নির্বাচনি বছরের ভাবমূর্তির ক্ষেত্রেও আমরা এমনটি করতে পারি।

স্পষ্টত সন্ত্রাসবাদ এখন পতনের দিকে আছে, কিন্তু তা এখনো আমাদের দুশ্চিন্তার একটি কারণ। কিন্তু সব ধরনের উগ্রবাদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ আমাদের জন্য স্বস্তিকর। বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত ধার্মিক কিন্তু একে অপরের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সংকটকালীন সময়ে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। আমি নিশ্চিত ২০১৮ সালে আমরা এমন একটি বাংলাদেশকে দেখতে পাব যে উগ্রবাদকে সফলভাবে মোকাবেলা করেছে।  

আমাদের ভয় ২০১৮ সালে দুর্নীতি নির্বিঘ্নে চলতে থাকবে, যা আগের মতোই আমাদের জাতীয় কর্মকান্ডে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। আমাদের দুর্নীতি বিরোধী প্রচেষ্টা, যার নেতৃত্বে আছে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক, সাম্প্রতিক সময়ে নতুন গতি পেলেও দুর্নীতির মাত্রার তুলনায় তা যথেষ্ঠ নয়।   

অতীতে বাংলাদেশ দারিদ্র্য এবং মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর মতো কিছু প্রকট সমস্যা সমাধান করেছে এবং নতুন অনেক সমস্যা নিয়ে কাজ করে চলেছে। ওপরের সমস্যাগুলোকে সে মোকাবেলা করতে না পারার কোনো কারণ নেই। আমাদের যা প্রয়োজন তা হচ্ছে দৃঢ় রাজনৈতিক সংকল্প, ক্ষমতার সব পর্যায়ের মানুষের মধ্যে একটি সমঝোতা, একটি সু-সংজ্ঞায়িত কর্মপরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে যথাযথ পথে আগানো। এই ২০১৮ সফল বছরে রূপান্তরিত করতে আমাদের প্রতিজ্ঞায় নির্বাচনী বছর যেন কোনো বাধা না হয়, বছরটি যেন সব ক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।  

দেশের বর্ধনশীল অর্থনীতি থেকে সৃষ্ট গতিময়তা এবং নিজেদের ওপর আমাদের আস্থার মধ্যে ২০১৮ সাল নিয়ে আমাদের সব প্রত্যাশা নিহিত। একটি বর্ধনশীল অর্থনীতির প্রয়োজন সৃজনশীল এবং সৃষ্টিশীল মানুষের, আর আমাদের মানুষ বিশ্বাস করে তারা বড় কিছু অর্জন করতে সক্ষম। এই সম্মিলন অন্যান্য দেশে অসাধারণ কিছু ঘটিয়েছে, যাঁর অন্যতম উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। আমরা বিশ্বাস করি আমরা সাফল্য অর্জনে সক্ষম এবং নির্বাচনী বছরটিকে মানুষের সক্ষমতা, গতিময়তা, সৃষ্টিশীলতা এবং তাদের সকল বাধাকে বিজয়ের সংকল্পকে উদযাপনের বছরে রূপ দিতে পারব।

বাংলা ইনসাইডারের সব পাঠককে নব বর্ষের শুভেচ্ছা!

বাংলা ইনসাইডার/কেএইচ/জেডএ 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭