অ্যাম্বার হার্ডের বিপক্ষে এবার মামলাটা জিতেই গেলেন তার সাবেক স্বামী জনি ডেপ। যে নির্যাতনের কথা বলে সকলকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ডেপকে একেবারেই একেলা করে দিয়েছিলেন অ্যাম্বার সেই নির্যাতনের বেশির ভাগ অংশটুকুই মিথ্যা বলে রায় দিয়েছে মার্কিন আদালত। কিছুটা রায় বিপক্ষেও গেছে জনির, তবে সেটি নিয়ে আলোচনাতে এখন কেও মনযোগী নয়।
২০২০ সালে যুক্তরাজ্যের আদালতে ‘সান’ পত্রিকার বিরুদ্ধে মানহানির মামলায় হেরে যান হলিউডের তারকা অভিনেতা জনি ডেপ। কিন্তু একই মামলায় যুক্তরাষ্ট্রে জয়ী হন তিনি।
এ বিষয়ে দুই দেশের আদালতে দুই রকম রায় হওয়াকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখছেন না বিনোদন জগৎ-সংশ্লিষ্টদের আইনি পরামর্শ দেওয়া মার্ক স্টিফেন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, এটা ‘খুবই বিরল’ যে, একই মামলা জলাধারের দুই পাশে বিচার হলো এবং ভিন্ন ফল এলো।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের মামলার বিচার শুরু হওয়ার প্রথম দিকে অনেক আইন বিশেষজ্ঞই মনে করেছিলেন যে, যুক্তরাজ্যের আদালতে মামলার রায় পক্ষে আসার যতটুকু সুযোগ জনি ডেপের ছিল এখানে তার চেয়ে কম সুযোগ ছিল। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে বাক স্বাধীনতার পক্ষে জোরাল অবস্থান রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে বিচারকমণ্ডলী এক নিবন্ধের জন্য অ্যাম্বার হার্ড অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যক্ত করলেন। ওই নিবন্ধে ‘গৃহ নির্যাতনের’ শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন হলিউডের এই অভিনেত্রী। এ বিষয়ে বিচারকমণ্ডলীর রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, তাঁরা অ্যাম্বার হার্ডের বক্তব্য বিশ্বাস করেননি।
মার্ক স্টিফেন মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে জনি ডেপের জয়ের পেছনে যেটা প্রধান ভূমিকা রেখেছে তা হলো এখানে বিচারে সঙ্গে একাধিক বিচারক ছিলেন। অপরদিকে যুক্তরাজ্যের আদালতে মাত্র একজন বিচারক ছিলেন। ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ‘সান’–এ প্রকাশিত এক নিবন্ধের জন্য ওই মামলা হয়েছিল। নিবন্ধে জনি ডেপকে ‘স্ত্রী নির্যাতনকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
আইনজীবী স্টিফেন বলেন, ‘অ্যাম্বার হার্ড জনমতের আদালতে ব্যাপকভাবে হেরে গিয়েছিলেন এবং বিচারমণ্ডলীর (জুরি) কাছেও সেটা ঘটেছে।’
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য—দুই দেশের আদালতেই জনি ডেপের আইনজীবীরা দাবি করেন, অ্যাম্বার হার্ড মিথ্যা বলছেন। নিজেদের দাবির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তাঁরা তাঁকে (অ্যাম্বার হার্ড) চরিত্র নিয়ে আক্রমণ করেন। হার্ডই জীবনসঙ্গী হিসেবে নিপীড়নকারী ছিলেন বলেও দাবি করেন তাঁরা।
যৌন ও পারিবারিক নির্যাতনের মামলায় সচরাচর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এই কৌশল নিয়ে থাকেন বলে উল্লেখ করেন মার্ক স্টিফেন। তিনি বলেন, এই কৌশলকে বলা হয় ‘অস্বীকার কর, তারপর আক্রমণ কর, আর ভুক্তভোগীকে অপরাধী ও অপরাধীকে ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধর।’ এই কৌশলকে সংক্ষেপে বলা হয়, “ডারভো”।
মার্ক স্টিফেন বলেন, ওই কৌশলই মামলায় ভুক্তভোগী নিয়ে আলোচনা উল্টে দিয়েছে। অভিযুক্ত এই নিপীড়ন করেছিলেন কি না সেই প্রশ্নের বদলে অভিযোগকারী বিশ্বাসযোগ্য কি না তা সামনে চলে আসে। তিনি বলেন, ‘তাঁরা অস্বীকার করে যে, তাঁরা কিছুই করেনি। তাঁরা যে আসল অপরাধী সেটা তাঁরা অস্বীকার করে। এরপর যিনি নির্যাতনের অভিযোগ আনেন তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর আক্রমণ করে তাঁরা। এভাবেই মামলার ভুক্তভোগীকে অপরাধীতে পরিণত করা হয়।’
যুক্তরাজ্যের আদালতে বিচারক আইজীবীদের এই কৌশল ধরতে পেরেছিলেন বলে মনে করেন মার্ক স্টিফেন। এ কারণেই তিনি অনেক প্রমাণ খারিজ করেছিলেন, যেগুলো জনি ডেপ নির্যাতন করেছিলেন কি না সে বিষয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিল না।
মার্ক স্টিফেন বলেন, তবে একাধিক বিচারকের সামনে ‘ডারভো’ কৌশল খুবই কাজ করে—বিশেষ করে পুরুষ বিচারকদের ক্ষেত্রে। এমনকি নারী বিচারকেরাও আইনজীবীদের এই কৌশলের খপ্পরে পড়ে থাকেন।
এই আইনজীবী বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিকে কেমন দেখাবে এবং তিনি কেমন আচরণ করবেন, তার একটি চিত্র আগে থেকেই মনে মনে ঠিক করে রাখে মানুষ। এটা যে প্রায়ই ভুল হয়, তা আমাদের সবারই জানা।’
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য—দুই দেশেই জনি ডেপের মামলার খবর সংগ্রহ করেছিলেন গার্ডিয়ানের সাংবাদিক হেডলি ফ্রিম্যান। তিনি বিবিসিকে বলেন, দুই মামলার বিচারের মধ্যে বড় একটি তফাৎ হলো, যুক্তরাষ্ট্রে মামলার বিচার প্রক্রিয়া সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছে। আদালতের একটি বিষয়কে ‘অনেকটা স্পোর্টস গেমে’ পরিণত করা হয়েছিল।
শুনানিতে দুই পক্ষের যুক্তি–তর্কে মামলার গতিপ্রকৃতির প্রতিটি মোড় কোটি কোটি মানুষ দেখেছিলেন। তাঁদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জনি ডেপের পক্ষে সমর্থন যোগাড়ে নেমেছিলেন।
শুধু টিকটকেই জাস্টিসফরজনিডেপ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে পোস্ট করা ভিডিও প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি বার দেখা হয়েছে। মামলার বিষয়টি আনলাইনে না আনতে বিচারকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল না, তাঁরা সঙ্গে মুঠোফোন নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।
অ্যাম্বার হার্ডের বিপক্ষে জনমতের যে প্রতিফলন ঘটেছে, তা #মি টু আন্দোলনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ারই অংশ বলে মনে করেন হেডলি ফ্রিম্যান।
২০১১ সালে একটি চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের সময় জনি ডেপ ও অ্যাম্বার হার্ডের প্রেম শুরু হয়। ২০১৫ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। দুই বছর পর তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। ২০১৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা এক নিবন্ধে জনি ডেপের বিরুদ্ধে নির্যাতন করার অভিযোগ তোলেন হার্ড। সূত্র: বিবিসি