ইনসাইড থট

দয়া করে আমার ঘাড় থেকে আপনার হাঁটু সরান, আমাকে স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে দিন!!


প্রকাশ: 09/06/2022


Thumbnail

১৯৮০ এর দশকে আমি তখন বতসোয়ানায় ছিলাম। জেলার সিনিয়র প্রধান মেডিকেল অফিসার হিসাবে জেলার মানুষের স্বাস্থ্যের দায়িত্বে কাজ করছিলাম। আমাদের জেলার মেডিকাল দল একটি অত্যন্ত সফল যক্ষ্মা রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রাম পরিচালনা করায় দেশে ভিতর আর বাহিরে অনেকের মনোযোগ সৃষ্টি করেছিল। একদিন একজন মার্কিন পরামর্শদাতা আমার দপ্তরে আমাদের প্রোগ্রাম এবং তার সাফল্য সম্পর্কে আরো জানতে আসেন। তিনি একজন আফ্রিকান আমেরিকান ছিলেন। আমি সত্যিই অবাক হয়ে শুনলাম তিনি আমাকে তার পরিচয় দেওয়ার প্রথমে জোর দিয়ে বললেন “আমাকে একজন আমেরিকান, আফ্রিকান আমেরিকান হিসাবে বিবেচনা করবেন। আমাদের নামে চালানো অনেক কিছুর জন্য আমি দায়ী নই”। আমি তার চোখে আমেরিকায় একজন আফ্রিকান হওয়ার কারণে তার দ্বন্দ্ব এবং কষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম।

আমরা শ্বেতাঙ্গ আমেরিকার ইতিহাস এবং আফ্রিকান দাসদের সংগ্রামের কথা জানি, আরো জানি সমান অধিকার পাওয়া আর তাদের মানুষ হিসেবে সমানভাবে বিবেচনা করার জন্য তাদের লড়াই ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। ১৭ এবং ১৮ শতক জুড়ে, আফ্রিকা মহাদেশ থেকে মানুষ অপহরণ করা হয়েছিল, আমেরিকায় আর আমেরিকান উপনিবেশগুলিতে দাসত্বে বাধ্য করা হয়েছিল। তাদের তামাক এবং তুলার মতো ফসল উৎপাদনে কাজ করার জন্য অমানবিক আচরণ আর শোষণ করা হয়েছিল।১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, আমেরিকার পশ্চিমমুখী সম্প্রসারণ এবং বিলুপ্তি আন্দোলন দাসপ্রথা নিয়ে একটি মহান বিতর্ককে উস্কে দিয়েছিল যা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে। যদিও ইউনিয়নের বিজয় দেশটির চার মিলিয়ন ক্রীতদাস মানুষকে মুক্ত করেছিল, আশ্চর্যজনক বিষয় হল আজও দাসত্বের উত্তরাধিকার আমেরিকার ইতিহাসকে প্রভাবিত করে চলেছে, মুক্তির এক শতাব্দী পরে আজও তাদের সমান নাগরিক অধিকারের আর আচরনের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। আজও সেখানে দৃশ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য রয়েছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমরা বিখ্যাত টিভি সিরিজ, “রুটস” দেখে বোঝার চেষ্টা করতাম এবং নিজেদেরকে প্রশ্ন করতাম কীভাবে তথাকথিত সভ্য বিশ্বে এমন মানবিক অসম্মান ঘটতে পারে! কি করে একটি তথাকথিত সভ্য সমাজ এমন কাজ করতে পারে! আমরা এই বিবেচনায় বড় হয়েছি যে প্রতিটি মানুষ সমান এবং প্রত্যেকেরই সমান অধিকার রয়েছে। সেই চিন্তা ধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমার এখনও মনে আছে স্কুলে থাকাকালীন আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা এবং রোডেশিয়ায় (জিম্বাবুয়ে) বর্ণবৈষম্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলাম। আমি নামিবিয়ার মুক্তির জাদুঘরে, বাংলাদেশ পতাকা আর পুলিশের পোশাক দেখে গর্বিত হয়েছিলাম যারা ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের অধীনে সংখ্যাগরিষ্ঠ কালো মানুষের স্বাধীনতার জন্য প্রথম সংসদীয় নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে গিয়েছিলেন।

যখন আমরা মার্টিন লুথার কিংকে দেখি - আমরা মানবতা, সমান অধিকার এবং সমতা দেখি - প্রত্যেকের সাথে সমান আচরণের গুরুত্বের সংগ্রাম দেখি। যখন আমি একজন আফ্রিকান আমেরিকানকে দেখি, আমি ন্যায়বিচার এবং সমান আচরণ এবং সুযোগের জন্য সংগ্রাম এবং লড়াই করার বিষয়ে অবিচল হই। আমি যখন দেখি যে কোনও আফ্রিকান আমেরিকান, যেহেতু তিনি ধনী শক্তিশালী দেশ থেকে এসেছেন বলে, কারও মর্যাদা, সার্বভৌমত্ব এবং সমান অধিকারকে ক্ষুণ্ণ বা হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে তখন আমি বিস্মিত হই এবং তা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়।

কয়েক বছর আগে যখন আমি নামিবিয়ায় WHO প্রতিনিধি হিসেবে ছিলাম, তখন অনেক রাষ্ট্রদূত এবং হাই কমিশনারের সাথে কাজ করার এবং বন্ধুত্ব গড়ে তোলার অনন্য সুযোগ পেয়েছি। তাদের সাথে এখনও যোগাযোগ করি। তাদের কাছে কূটনীতির শিল্প আর কীভাবে একজন কূটনীতিকের আচরণ করা উচিত তা শিখেছি। আমি তাদের সম্মান করেছি এবং সমানভাবে তাদের সম্মান অর্জন করেছি। আমার বাসায় আমেরিকান, ব্রিটিশ, রাশিয়ান, চীন, ভারতীয়, স্পেনীয়, জার্মান, ব্রাজিলিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান এবং কেনিয়ার রাষ্ট্রদূত এবং হাই কমিশনার এবং তাদের সহধর্মিদের সাথে সবাই একসাথে খাবার টেবিলের চারপাশে বসে আমার রান্না করা বাংলাদেশী খাবার উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি, ঘন্টার পর ঘন্টা ভাল সময় কাটার সুযোগ পেয়েছি। সেই সমস্ত রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনারা তাদের বাসভবনে প্রাইভেট ডিনারে সমানভাবে আমাকে অনেকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাদের সাথে মিশে আমি কূটনীতি, আচরণ এবং শালীনতার ভাষা শিখেছি। আরো শিখেছি কীভাবে মাস্টার হিসাবে নয় সমান অংশীদার হিসাবে, কোন দেশের সরকার, নিয়ম এবং সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে হয়। সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে হয়।

আজকে যখন দেখি বাংলাদেশে শক্তিশালী এবং ধনী দেশের কিছু রাষ্ট্রদূত নির্বাচন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে নেতিবাচক কথা বলছেন, তখন আমি অবাক হই। হ্যাঁ, প্রত্যেকেরই তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে, কিন্তু তা করবেন কূটনৈতিক শালীনতা এবং নিয়মের মধ্যে। তারা যে সকল মানুষের সমস্যা ও দুর্ভোগ তুলে ধরার প্ল্যাটফর্ম নেই তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারেন। একটি স্বাধীন ও গর্বিত জাতি হিসেবে সরকার তাদের পরামর্শ এবং সমর্থন স্বাগত জানায়। মানবাধিকারের উন্নয়ন, বাক স্বাধীনতা, তথ্য আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কূটনীতিকরা পরিবর্তন আনতে মাস্টার হিসাবে নয়, সমান অংশীদার হিসাবে সরকারের সাথে কাজ করতে পারেন। আরও ভাল করার জন্য, আদেশ বা হুমকি না দিয়ে একজন অংশীদার হিসাবে সরকারি প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে পারেন দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। হ্যাঁ, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল জাতি হতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তাদের মতো সম্মান ও মর্যাদার সাথে কোনো হুমকি, হস্তক্ষেপ ও হুকুম ছাড়াই নিজের ভালোটা বিবেচনা করে নিজের মত বাঁচতে চায়।

আমি অনুরোধ করবো আপনি বাংলাদেশের দিকে আঙুল তোলার আগে দয়া করে আপনার দিকে তাকান। আফগানিস্তান, লিবিয়া আর ইরাকে আগ্রাসন ও ধ্বংস, সেটা কি আন্তর্জাতিক আইন মেনে এবং সার্বভৌম অধিকারকে সম্মান জানিয়ে করা হয়েছিল? বিশ্বব্যাপী পরিবেশন ( rendition - সন্ত্রাসবাদে সন্দেহভাজন বিদেশী নাগরিকদের জর্ডান, ইরাক, মিশর, ডিয়েগো গার্সিয়া, আফগানিস্তানে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ সুবিধায় নেয়া), আবু ঘরায়েবে বন্দীদের নির্যাতন, গুয়ানতানোমো বে কারাগারে বছরের পর বছর মানুষদের পশুর মতো বিচার অধিকার ছাড়া বন্দী করা, তাদের অধিকারের কী হবে? ২০০১ সাল থেকে দেশপ্রেমিক আইন (patriot act) কীভাবে সংবাদপত্র এবং ব্যক্তি স্বাধীনতাকে প্রতিফলিত করে? কিছু তেল সমৃদ্ধ দেশের মত একটি অগণতান্ত্রিক, যেখানে মানবাধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অনুপস্থিত সেই দেশকে কীভাবে আপনারা সমর্থন করতে পারেন? মিশর বা থাইল্যান্ডে সামরিক স্বৈরশাসককে কেন সমর্থন করেন? সে দেশ গুলোতে আপনার সমর্থনের নৈতিক ব্যবস্থা আর শর্তাবলী নির্দেশ করার সাহস কেন করেন না? আপনার নিজের স্বার্থ বাঁচানোর জন্য ভেনেজুয়ালা থেকে আপনার আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অপসারণ করার সাথে সাথে আপনি কীভাবে অন্যান্য দেশকে হুমকি বা নির্দেশ দেওয়ার নৈতিক কর্তৃত্ব রাখেন? আপনি কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেন যখন অনেক আফ্রিকান বা অশ্বেতাঙ্গদের ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, যখন পরাজিত ব্যক্তি এখনও দাবি করেন যে ভোট কারচুপি বা চুরি হয়েছে? হ্যাঁ, আমরা আপনাদের মতামতকে সম্মান করি। আমরা সবার সাথে সমান অংশীদারের হিসাবে এবং পারস্পরিক সম্মান ও মর্যাদার সাথে কাজ করতে চাই।

কিন্তু আমাদের সাথে রাষ্ট্রদূতদের আচরণ আর সাহস দেখে রাষ্ট্রদূত আমি আপনাদের দোষ দেই না। আমি নিজেদের দোষারোপ করি যখন আমি দেখি আমাদের অনেক রাজনৈতিক দলের নেতারা, নাগরিক সমাজের সদস্য, বুদ্ধিজীবীরা বার বার দৌড়ে সমর্থনের জন্য আপনাদের দরজায় কড়া নাড়ছেন এবং আপনাদের হস্তক্ষেপের অনুরোধ করছেন। আমি যখন দেখি আমাদের সাংবাদিকরা আপনাদের আমন্ত্রণ পেয়ে এবং আপনাদের উপস্থিতিতে পার্টিতে যোগ দিতে এত গর্বিত বোধ করেন। আমরা আমাদের নিজেদের লড়াই নিজেরা চেষ্টা না করে, আমাদের নোংরা কাপর ধোয়ার জন্য আপনার জায়গায় ছুটে যাই। আমরা যদি নিজেদেরকে সম্মান না করি, আমদের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট বা গর্বিত বোধ না করি এবং স্বাধীন গর্বিত দেশের নাগরিক বলে গর্ববোধ না করি, এমনকি আমাদের গর্ব এবং মর্যাদা বিক্রি করতে দ্বিধা না করি তখন আমি কীভাবে আপনাদের দোষ দিতে পারি?

তবুও আমি আপনাদের অনুরোধ করব আমাদের সাথে সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করুন এবং দয়া করে কূটনৈতিক সুবিধার সুযোগ গ্রহণ করবেন না। আপনার দ্বৈত নৈতিকতা পরিত্যাগ করুন। অনুগ্রহ করে আপনার স্বার্থ এবং মুনাফা পেতে শুধুমাত্র যারা দরিদ্র বা দুর্বল তাদের উপর আপনাদের ইচ্ছা এবং নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেবেন না। আমরা আপনাদের বাণিজ্য দেই এবং আমরা আপনাদের দেশে বাণিজ্য করি। আমরা আপনাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করি না। আমাদের যেমন আপনাদের প্রয়োজন, আপনাদেরও আমাদের প্রয়োজন। আসুন আমরা সমর্থনকারী বন্ধু হই এবং স্বৈরশাসক না হই। আমরা আর তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ নই, আমরা একটি গর্বিত জাতি। দয়া করে আমার ঘাড়ে আপনার হাঁটু রাখবেন না এবং দয়া করে আমাকে স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে দিন। সমানভাবে এবং মর্যাদার সাথে বাঁচতে দিন। সমান অংশীদার হিসাবে একসাথে সমৃদ্ধি এবং বিকাশ করতে দিন।




প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭