ইনসাইড থট

বাংলাদেশ পুলিশের গৌরবসূত্র


প্রকাশ: 10/06/2022


Thumbnail

আমার এক পিতৃব্য আবদুল খালেক বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ছিলেন। আজ ১০ জুন তাঁর নবম মৃত্যুবার্ষিকী। জনাব খালেক ১৯২৭ সালের ১ মার্চ কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া থানাধীন জিরুইন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দেবিদ্বার গঙ্গামন্ডল রাজ ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিলেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি শাস্ত্রে সম্মান সহ ১৯৫০ সালে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। জনাব খালেক সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান (সিএসপি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫১ সালে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি মুজিবনগর সরকারের একই দায়িত্বের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বও পালন করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন ছিল তাঁর কর্ম-জীবনের এক মহোত্তম পর্যায়। দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও জ্ঞানী এই মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুরও ছিল অবিচল আস্থা। যে কারণে তিনি অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে স্বাধীনতাউত্তর দেশ পুনর্গঠনে অবদান রাখার সুযোগ পান। ‘৭৫ পরবর্তীকালের সরকারের সাথে মতদ্বৈততার কারণে আবদুল খালেক সরকারি চাকুরী থেকে পদত্যাগ করে আইন শিক্ষা ও আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন।

মরহুম আবদুল খালেক ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে “গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ” অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সরকার তাঁকে মরণোত্তর এ পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন। 

পারিবারিক সূত্রে আমার জানা ও দেখা যে একজন মানুষ কুমিল্লার এক অজো পাড়াগাঁ থেকে কেমন করে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছিলেন। বয়সে বড়ো ও সম্পর্কে ভাই হলেও তিনি ছিলেন আমার পিতারও শিক্ষক। ১৯৪৩ সালে আমার আব্বা যখন প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষা দেন, আমাদের ব্রাহ্মণপাড়ার বাড়ি থেকে চৌদ্দ মাইল হেঁটে চান্দিনা কেন্দ্রে খালেক চাচা তাঁকে নিয়ে যান ও পরীক্ষা চলাকালীন সেখানেই ছিলেন। তিনি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। চান্দিনায় আমার দাদার পরিচিত এক বাড়িতে একটি রুমে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। সেখানে ছোট ভাইকে চৌকিতে শুতে দিয়ে তিনি একটি কাঁথা বিছিয়ে কাঁচা মেঝেতে শুতেন। আব্বার পড়াশুনা থেকে চাকুরী এমনকি বিয়ে পর্যন্ত সকল সিদ্ধান্ত আমার দাদা ও আর এক চাচা কংগ্রেস কর্মী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট আবদুল লতিফ ভুঁইয়া (আবদু ভুঁইয়া নামে সুবিশেষ পরিচিত) নিলেও খালেক চাচাই সেসব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতেন। সত্তুরের দশকে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা, কোন হলে থাকবো সেসবের ব্যবস্থা সবই করেছিলেন খালেক চাচা। প্রায়ই বিকেলে বিকেলে তিনি ফজলুল হক হলে এসে আমাকে নিয়ে পুকুর পাড়ে হেঁটে বেড়াতেন আর তাঁর অভিজ্ঞতার গল্প শুনাতেন। পরামর্শ দিতেন আর একটি কথা প্রায় প্রতিদিনই বলতেন, ‘জীবনে যা করবি তাতে যেন মানুষের উপকার হয়’। আর বলতেন, ‘আমরা যে গ্রাম থেকে এসেছি সেটা একটা সারপ্রাইজ, এই কথাটা সব সময় মনে রাখবি’। তখন মাঝে মাঝেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে যেতেন। যাবার পথে আমাকে দেখে যেতেন।

আবদুল খালেক তাঁর নিজ গুণে, বিদ্যায় ও চৌকস পারদর্শিতায় বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক হয়েছিলেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে পুলিশ বাহিনীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ একটি নিয়মিত বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি অপরিসীম কষ্ট করেছেন যা তাঁর জীবনী গ্রন্থ ছাড়াও সে সময়ের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত খুঁজলে পাওয়া যায়। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে তিনি গবেষণা করতেন ও একটি আধুনিক বাহিনী হিসেবে একে গড়ে তুলতে নানারকম সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করেন। দুর্ভাগ্যবশত বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্রোত উল্টোপথে ঘুরপাক খাওয়ার ফলে মুক্তিযুদ্ধের সুফল হিসেবে যেসব ক্ষেত্রে স্বা্ধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক আধুনিকায়নের সম্ভাবনা ছিল সেগুলো থেমে যায়। ফলে পুলিশ বাহিনীর কর্মক্রিয়ায় প্রথমে ভাগ বসায় সামরিক বাহিনী ও পরে রাজনৈতিক শক্তির তোষন-পোষণ এসে এই বাহিনীকে নানাভাবে বিতর্কিত করে। অথচ নিবেদিত প্রাণ এই বাহিনীই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা কি না সরকারী প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসেবে সরাসরি মানুষের পাশে থেকে কাজ করে। এই বাহিনীর গুণগত উন্নয়ন তো দূরের কথা এর পরিচালন পদ্ধতি পর্যন্ত এখনও চলছে সেই ১৮৬১ সালের আইনের কাঠামোর মধ্যেই। নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় একে যুগোপযোগী করা যাচ্ছেনা।

ফলে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী চলছে তার নিবেদিতপ্রাণ অফিসারদের ত্যাগের ফলশ্রুতিতে। কিছুদিন আগে এক ঘরোয়া আড্ডায় সাবেক আইজিপি নূরুল হূদা ও বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খানের সাথে আমার আলাপচারিতার সুযোগ ঘটেছিল। সেখানেও এই বিষয়গুলোর অবতারণা হয়। বর্তমান সরকারের নানা পদক্ষেপ পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করেছে সন্দেহ নেই কিন্তু যেসব জটিলতা পুলিশকে উপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব থেকে সরিয়ে আনতে দিচ্ছেনা সেগুলোর সুরাহা হওয়া দরকার। একটি বিষয়ে আমরা সবাই সেদিন একমত হয়েছিলাম নেতিবাচক কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা পুলিশের মৌলিক ভূমিকার তেমন কোন ক্ষতি করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু পুলিশকে রাজনৈতিক ক্রীড়াচক্রের হাত থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে চলতে দেবার ও একীভূত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা দেয়া এখন জরুরী। বিশেষ করে পুলিশের নীচের দিকে অনিয়ম ও ব্যাপক দুর্নীতির যেসব সংবাদ আমরা পাই তাতে উদ্বিগ্ন হবার কারণ আছে কিন্তু এসবের সমাধান কীসে সেগুলোও ভেবে দেখা দরকার।

আমাদের জানা যে পুলিশের যেসব কর্মী নীচের দিকে কর্মরত তাদের অধিকাংশ স্বল্পশিক্ষিত, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। ঐতিহাসিক সত্য যে ব্রিটিশ বেঙ্গল পুলিশের আমল থেকে এদের বেতন ভাতাদি অত্যন্ত অনুল্লেখ্য পর্যায়ের যা তাদের কাউকে কাউকে বাধ্য করেছে অসাধু পথে চালিত হতে। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, দেশের মানুষের আয়ের পথ সুগম হয়েছে ও পরিবারগুলো দারিদ্র্য সীমার নিম্ন অবস্থান থেকে প্রায় বের হয়ে এসেছে। পরিবারের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা পুলিশে চাকুরী পাচ্ছে যেখানে একসময় একটি দরিদ্র পরিবারের স্বল্প শিক্ষিত কাউকে কনস্টেবল বা উপ-পরিদর্শক পদে চাকুরী পেতে কয়েক লক্ষ টাকা দালাল চক্রকে দিতে হতো, গত কিছুদিন যাবত সে পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ঘোষণা দিয়ে এখন দালাল ও বাড়তি টাকামুক্ত নিয়োগের প্রতিশ্রুতি স্বয়ং পুলিশের উচ্চ মহল থেকেই জেলায় জেলায় জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে এখন আমাদের ভাবা দরকার শিক্ষিত কিন্তু দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের পুলিশের নীচের দিকের কোন পদে চাকুরী পেলে যে সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে তা কেমন করে তারা মোকাবেলা করবে, সমাজই বা কেমন করে তা নিরূপণ করবে যে, নির্বিবাদে যে চাকুরী করতে গেছে সে লেখাপড়া জানা ও তার কাছ থেকে কোন অন্যায় কাজ আদায় করা আর যাবে না।

পুলিশের উচ্চ মহল যদি এই সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে তাহলে নিচের দিকে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। বাকী থাকে প্রশাসনিক প্রভাব ও রাজনৈতিক চাপ। একটি জেলায় বা উপজেলায় যিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা তাঁর মূল কাজ উন্নয়ন তদারকী, ভূমি ব্যবস্থার বিন্যাস ও কর আদায় অপরদিকে আইন শৃঙ্খলার দায় পুলিশের। প্রধানতঃ পুলিশ সেখানে সহায়ক ভূমিকা পালনে কাজ করে। বিচারিক ক্ষমতা প্রশাসনের কাছ থেকে আলাদা হবার পরে ও কালে কালে, বিশেষ করে সামরিক শাসনের আমল থেকে পুলিশকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য করা হয়েছে। এইরকম একটি জটিল মিথস্ক্রিয়া পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে অস্থির করে তুলেছে। ফলে এখন যে করেই হোক, পুলিশকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ করে দেয়া দরকার। কেউ কেউ ভয় পান পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলে সরকারের নীতিবিরুদ্ধ কাজে সে তার শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। এই চিন্তা অমূলক কারণ পুলিশ বা যে কোন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকেই একটি রেজিমেন্টেড প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, না হলে এতো প্রাচীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে এরা টিকে থাকতে পারতো না। দেশে রাজকতা প্রতিষ্ঠায় পুলিশের ভূমিকা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বুঝতেও পুলিশকে সুযোগ করে দেয়া দরকার। আমদের সকলের জানা আছে বাংলাদেশে পুলিশ কখনও কোন রাজনৈতিক শক্তিকে উৎখাত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি, সংবিধানের কোন অনুশাসনও পুলিশ বাহিনী কখনও অসম্মান করেনি। ফলে যেনতেন প্রকারে পুলিশকে হাতে রাখার যে রাজনৈতিক প্রবণতা তার অবসান হওয়া দরকার।

পুলিশের সাম্প্রতিক বেশ কিছু নিয়োগে রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করা হয়নি এমন অনেক তথ্য সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। আমার জানামতে, শতভাগ স্বচ্ছ এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে নিঃসন্দেহে পুলিশ বিভাগ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী একই প্রক্রিয়া নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলার পুলিশ সুপারগণ। এতে প্রমাণিত হয় পুলিশ বিভাগের সকল পর্যায়ে একটি গুণগত পরিবর্তনের শুভ সূচনা হ’তে যাচ্ছে।

সামনে বড়ো চ্যালেঞ্জ হবে পুলিশের সকল পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কারিকুলাম ও প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া ঢেলে সাজানো। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেখানে একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবার স্বপ্ন বাস্তবরূপ নিচ্ছে সেখানে দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষঘনিষ্ট পেশায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীকে অবশ্যই মানবিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যেখানে বাংলাদেশের পুলিশের ভূমিকা প্রশংসিত সেখানে দেশে কেন এরা সমালোচিত হবে?

আশার কথা শেখ হাসিনার সরকার এই বাহিনীকে স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে মানবিক করে গড়ে তুলতে সব প্রতিশ্রুতি পালন করছে, শুধু পুলিশ কর্মকর্তাদের সাহসের সাথে এখন সে স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দেশের সব মানুষ তাঁদের পাশে থাকবে ও পুলিশের সাফল্যে গৌরববোধ করবে।  

ইমেইল: rezasalimag@gmail.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭