ইনসাইড আর্টিকেল

মৃৎশিল্প নাকি ‘মৃতশিল্প’?


প্রকাশ: 17/06/2022


Thumbnail

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পের একটি হলো মাটির শিল্প। এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি নানা তৈজসপত্র ছিল এই দেশের প্রতি ঘরের নিত্য সামগ্রী। বাংলাদেশের রাজশাহী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন শহরে কারিগরদের রাজত্ব ছিল একচেটিয়া। তাদের তৈরি আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিল ছিল বাংলার সংস্কৃতির অংশ। যা এখনো বাংলার অন্যতম ঐতিহ্য হিসেবে পরগণিত হয়। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং আগ্রহের অভাবে মৃৎশিল্প আজ মৃতপ্রায়। 

গ্রামাঞ্চলে মেলা মানেই আমরা বুঝতাম নিত্যপণ্য, আর মাটির তৈরি সুদর্শন সব তৈজসপত্র। এতটাই আগ্রহ আর প্রয়োজনীয়তার জায়গা দখল করে ছিল এই মাটির শিল্প। রাজশাহীতে হওয়া রথের মেলায় বসতো বিশাল সারিবদ্ধ মাটির তৈজসপত্রের দোকান। মৃৎশিল্পীরা তাদের তৈরি পণ্য নিয়ে আসতেন। এই মেলা এতটা জমজমাট ছিল যে, বাইরের জেলা থেকেও ব্যবসায়ীরা আসতেন তাদের তৈরি মাটির পণ্য বেচাকেনা করতে। এখন মেলা অনুষ্ঠিত হয় ঠিকই, কিন্তু ব্যবসায়ীরা আর আসেন না আশানুরূপ সংখ্যায়। মানুষের আগ্রহের কমতি মেলায় মৃৎশিল্পীদের এবং মাটির শিল্পের অনুপস্থিতির প্রধান কারণ।  

দুই যুগ আগেও দেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ ছিল অনেক মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তখন তৈরিকৃত প্রতিটা জিনিসের চাহিদা এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার ছিল ব্যাপক। এখন,  মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদার জায়গা দখল করে নিচ্ছে প্লাস্টিক, কাঁচ এর ধাতব উপাদান সমূহ। অথচ, আগে পূজা, অনুষ্ঠান, নবান্ন, পিঠা উৎসব বাংলার সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা প্রতিটি ঘটনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল মাটির তৈরি জিনিসপত্র।  



দেশের এখনো কিছু গ্রামাঞ্চলে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী হিসেবে মাটির তৈরি জিনিসপত্র এর চাহিদা আছে বলে রাজশাহী, ফরিদপুর অঞ্চলে কিছু মৃৎশিল্পীর পরিবার টিকে আছেন। যারা বংশ পরম্পরায় এই কাজ এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। তবে তাদের কাজ অনুযায়ী এর চাহিদা নিয়ে অসন্তুষ্টি আছেই। ফরিদপুর অঞ্চলের কারণ্যপুর গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে তৈরি হতো আগে মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল। পালপাড়া নামে খ্যাত এই জায়গায় মৃৎশিল্পীরা পাল্লা দিয়ে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতো। উঠোন জুড়ে হাঁড়ি-কলসির মেলা বসতো। সেসব তৈরি জিনিস শুকিয়ে ঘরে তোলা, রং করা,  সব যেন উৎসবের মতন করা হতো। কিন্তু সেই পাড়ায় এখন হাতেগোনা কিছু পরিবার আছে যারা এই কাজের ধারিবাহিকতা বজায় রাখছেন।  

বাজারে মাটির তৈরি জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ হারিয়েছে দিনদিন সব ধরণের ধাতব বস্তুর উপর নির্ভরশীলতা বাড়ার জন্য। নান্দনিক এবং রুচিশীলতা অনুশীলনকারী অনেকেই এখনো মাটির তৈরি তৈজসপত্রের কদর করলেও সে সংখ্যা খুবই কম। যার কারণে মৃৎশিল্পীদের আগ্রহ কমছে। অনেকেই অন্য পেশায় নিযুক্ত হয়ে পড়ছেন। অনেকে নামমাত্র জিনিসপত্র বানাচ্ছেন। মাটির জিনিসের দাম পাচ্ছেন না বলে অনেকেই এই পেশা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। এতে মূলত দেশে মৃৎশিল্পী যেমন কমে আসছে তেমনি দেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের অবক্ষয় ঘটছে দিনের পর দিন। 

বাংলাদেশের সবখানে চৈত্র-বৈশাখে মেলা বসে। পাল পরিবারের সদস্যরা সেখানে এখন অন্য ধরনের পণ্য নিয়ে হাজির হন। শহরাঞ্চলে, ড্রইং/লিভিং রুমে দেখতে পাওয়া যায় নানা ধরণের মাটির পণ্য। বিত্তবানরা ঘর সাজাতে আজকাল আগ্রহ প্রকাশ করে মাটির জিনিসই কেনেন। কম ব্যয়ে ঘর সাজাতে মাটির তৈরি পণ্যই সেরা। কিন্তু, অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক সহ অন্য সকল ধাতব বস্তুর দাম বৃদ্ধি পেলেও বাড়েনি মাটির তৈরি জিনিসের দাম। তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন মৃৎশিল্পীরা। 



মৃৎশিল্প আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের ইতিহাসের এবং সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা শিল্পকর্ম। প্রাচীনযুগে দেয়ালের ফলক থেকে শুরু করে কারুকাজ সকলই করা হতো মাটি দিয়ে। কিন্তু এই শিল্প দিনকে দিন বিলুপ্তির পথে এগুচ্ছে। এ শিল্প যেনো হারিয়ে না যায়, কোনোভাবেই ‘মৃতশিল্পে’ পরিণত না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরই।  মৃৎশিল্পীরা বিশ্বাস করেন যথাযথ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বেসরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে হারিয়ে যাওয়া মৃৎশিল্পের অতীত-ঐতিহ্য পুনরায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭