ইনসাইড থট

মহিউদ্দিন ভাই ও শিউলিতলার সাপ্তাহিক আড্ডা


প্রকাশ: 21/06/2022


Thumbnail

মহিউদ্দিন আহমেদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা। তিনিই প্রথম সরাসরি পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং বিলেতে বসে কাজ শুরু করেন। তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সার্বক্ষণিক ভিত্তিতে কাজ করেন। বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করা এবং বিভিন্ন কাজে তিনি তাঁর অবদান রাখেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরবর্তীতে তিনি দেশে আসেন এবং তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন।

মহিউদ্দিন আহমেদ যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিবের পদমর্যাদায় কাজ করেন সেসময় তার সাথে আমার সর্বপ্রথম পরিচয় হয়। তার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফ আহমেদ। সুলতান শরীফের সাথে আমার পরিচয় প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময় ধরে। তার সাথে প্রথম পরিচয় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ঘুরেফিরে একটি বিষয় আসে, কি করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়, কিভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের জন্য মঙ্গল হয়, এই সমস্ত কিছুই ছিল তার দিনরাতের সাধনা। তার সহধর্মিণী নুরা ভাবী বেশ কিছুদিন আগে ক্যান্সার এ মারা গেছেন। তিনিও জীবিতকালে এই একইভাবে সুলতান শরীফ ভাইয়ের মতো ছিলেন। সুলতান শরীফ যখন আমাকে মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তখন তিনি রমনার সার্কিট হাউজের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন। সেখানে আমি মাঝেমধ্যেই যেতাম। খুব সিরিয়াস কিছু নয় কিন্তু বেশ গল্প গুজব করতাম। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাপ হত আামদের। এর আগে তার সাথে আমার ভালোভাবে পরিচয় হয় যখন তিনি উত্তরাতে তার নিজের বাড়িতে থাকতেন। পরে তিনি তার সে বাড়িটা ডেভেলোপারের কাছে দিয়ে দেন এবং সেটার নাম দেন শিউলিতলা। 

যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক, যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন বা লেখাপড়া করেন বা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে একদিন করে আলোচনায় বসতেন মহিউদ্দিন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। যার মধ্য মনি ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। সেখানে মহিউদ্দিন আহমেদের একটা শর্ত ছিল আর সেটা হলো সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হতে হবে। সে সময় জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের সাথে পরিচয় হয়। তখন তিনি লেখালেখি করতেন এবং তার অধিকাংশ লেখাই সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার পক্ষে ছিল। সুতরাং সেখানে মোটামুটিভাবে ঘুরেফিরে একটি প্রসঙ্গই আসত। আর সেটি হচ্ছে দার্শনিক রাষ্ট নায়ক শেখ হাসিনার প্রশংসা। তখন সময়টা বিএনপির আমল। বিএনপি সে সময় রাষ্ট ক্ষমতায় কিন্তু মহিউদ্দিন আহমেদের এমন একটা আকর্ষণ শক্তি ছিল যে সেখানে বেশ লোকজন জড় হতেন। সংখ্যায় প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ জনের মতো। কিছু কিছু সময় উনার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ২/৩ থেকে যেতাম এবং একসাথে খাওয়া দাওয়া করতাম। 

মহিউদ্দিন আহমেদের এরকম একটা পরিবার আমি দেখিনি। তার অন্য ভাইদেরকেও  আমি চিনি। তাদের একটি জিনিস শুধু আমাকে নয়, যে কেউ যারা জানবে তাদের আকর্ষণ করবে, সেটা হচ্ছে তাদের সততা এবং সোজাসুজি কথা বলা। তাদের কথাবার্তার মধ্যে কোন রকম ভণিতা নেই, যেটা বিশ্বাস করেন সেটা স্পষ্ট করে বলেন। এতে অবশ্য অনেকের মন খারাপ হতো।

কয়েক বছর আগে মহিউদ্দিন আহমেদ লিভার সংক্রান্ত জটিলতায় মৃত্যুপথযাত্রী ছিলেন, উত্তরার একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আমি সে সময় তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। ডাক্তার সে সময় বলেছিল যে, উনি আর বেশিদিন বাচঁবেন না। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তিনি সেখান থেকে ভালো হয়ে আসেন এবং আবার লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। তার অনেক লেখা হয়তো ছড়ানো-ছিটানো আছে যেগুলো বই আকারে ছাপানো প্রয়োজন। কেননা তাঁর লেখার ভিতর মুক্তিযুদ্ধের কথা, বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুর কথা, বঙ্গবন্ধুর কন্যা দার্শনিক রাষ্ট নায়ক শেখ হাসিনার কথা অনেক প্রসঙ্গ পাওয়া যাবে। তখনকার সত্যিকারের অবস্থা এবং ঘটনাগুলো জানা যাবে। বিলে তখন সত্যিকারের অবস্থা কেমন ছিল সেটা জানা যাবে। কারণ উনি চরিত্রগতভাবে এমন মানুষ যেটা হয়তো অনেকে কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে না লিখতে পারেন কিন্তু তিনি যেটা লিখেছেন তার ভিতরে সামান্যতম কোন সত্যের বাইরে গিয়ে নিজের কল্পনা উনার লেখায় কোন সময় বিস্তৃত হয়নি। আমি সুলতান শরীফের কাছ থেকে শুনেছি মহিউদ্দিন আহমেদের স্ত্রীর যখন প্রথম সন্তান হয়, তখনো তিনি সবাইকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন এবং আজীবন তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পক্ষে একজন লড়াকু সৈনিক ছিলেন। 

এক সময় তিনি বিলেতে লড়েছেন। সভা করে লোকজনকে একত্রিত করেছেন এবং অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা নিয়ে চাকরির পাশাপাশি যেটুকু করা যায় তিনি তা করেছেন। যখন তিনি নিউ ইয়র্কে ছিলেন, তখন তার রুমে সম্ভবত জিয়াউর রহমানের ফটো না থাকার কারণে তাকে ঢাকায় তলব করা। আমি তার কাছে অনেক কিছু শিখেছি। তখনকার সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লেখেন, তারা প্রায় সবাই ঘুরেফিরে উনার ওখানে যেতেন। সপ্তাহের একটি ‍নির্দিষ্ট দিন ছিল সেই দিনেই আমরা সকলে যেতাম। আমি প্রায় নিয়মিতই যেতাম সেখানে। 

আজকে যখন পত্রিকায় দেখলাম যে, মহিউদ্দিন আহমেদ না ফেরার দেশে চলে গেছেন, তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। কেননা সম্প্রতিকালে মহিউদ্দিন আহমেদের খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব হয়নি বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে। কেন যে এরকম একজন মানুষ, একজন মুক্তিযোদ্ধা, যার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো, এর জন্য আমি অপরাধী। আজকে তিনি না ফেরা দেশে চলে গেছেন এখন তার পক্ষে বা বিপক্ষে যাই বলা হোক তাতে তার কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমরা যারা বেঁচে আছি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একের পর এক যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, যারা সত্যিকারে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি তারা কিন্তু পরপারে চলে যাচ্ছেন। আমার মনে হয় এভাবে দেশ এখন আস্তে আস্তে মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম মেধা দেখা যাচ্ছে। মাত্র ৩/৪ কে বাদ দিয়ে সকলেই তাদের মেধা বিক্রি করছে। তারা তাদের মেধা দিয়ে একটি টেলিভিশনের অনুমতি নেন, একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপনের জন্য ঘুরেন অথবা মেধা এসব কাজে ব্যবহার করেন। আর লেখালেখি করেন কে খুশি হবে, সেটার উপরে। কিন্তু সত্যিকারে মেধা দেশের জন্য, দেশের মঙ্গলের জন্য, কয়েকজন খরচ করে সেটা আমরা হিসাব করলে সহজে বুঝতে পারবো। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭