ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

পুতিনের গ্যাস রপ্তানিতে লাগাম টানায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ প্রযুক্তি বিশ্বে


প্রকাশ: 24/06/2022


Thumbnail

ইউক্রেন যুদ্ধ যে শুধু মাত্র দুই দেশের সীমানার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে নি তা যুদ্ধ শুরু সাথে সাথেই টের পায় গোটা বিশ্ব। কমলা লেবুর আকৃতির এই বিশ্ব এখন একা চলার নীতিতে বিশ্বাসী না। কারণ বিশ্ব জানে কেউ পিছনে পড়ে গেলে দিন শেষে তার দায়টুকু বহন করতে হবে তার নিজেকেই। ইউক্রেনকে সাথে নিয়ে চলার নীতিতে যখন এই বিশ্বের বড় বড় খেলোয়াড়রা রাশিয়ার বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে তখন এই যুদ্ধ সীমানা ছাড়িয়ে দুই দেশেরই। ইউক্রেনকে বহনকরার নীতিতে যে তারা নিজেরাই নিজেদের দিকে বিপদ টেনে আনছে তা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে আরো। কারণ সব সময় সব ক্ষেত্রেও একসাথে চল নীতি যে ঠিক কার্যকর নয় তা প্রমাণ করে দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। 

যে তেল-গ্যাস রপ্তানি আটকে দিয়ে যে রাশিয়া বিপদে ফেলার নীতি গ্রহণ করেছিলো পশ্চিমা বিশ্ব সেই নীতিই এখন হিতে বিপরীত আকারে তাদের দিকেই ধেয়ে আসছে আরো দ্রুত গতিতে। ইতিমধ্যে আগুন চড়েছে বিশ্ব তেলের বাজারে। চাইলেই এত সহজে গ্যাস পাওয়া সম্ভব না বলে গ্যাস রপ্তানিতে রাশিয়াকে কোন বাধা দেয় নি যে ইউরোপ এখন সেখানে গ্যাসের রপ্তানি নিম্নমুখী করা শুরু করেছে রাশিয়া নিজেই। 

শিল্পকারখানা কিংবা বাসাবাড়িতে রপ্তানি করা গ্যাস রাশিয়া এখন আস্তে আস্তে সরবরাহ করা কমিয়ে নিয়ে না আসলেও গ্যাস নিয়েই দেশটি পশ্চিমা বিশ্বের সাথে কিছুটা ভিন্ন পন্থায় খেলা শুরু করেছে। আর যার প্রভাব পড়তে পারে বিশ্বে চিপ নির্মাণকারী শিল্পখাতে। কারণ চিপ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ বিরল গ্যাসের রপ্তানির প্রায় এক তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন যৌথভাবে। যুদ্ধের পর গত মে মাস থেকে এই বিশেষ গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে দিতে শুরু করেছে রুশ সরকার। 

সেমিকন্ডাক্টর বা চিপখাত বেশ কিছুদিন থেকেই টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছিলো। প্রথমে করোনার ধাক্কা। এই সময়টায় সারা বিশ্বে বেশ ভালো রকমের চীপ বা সেমিকন্ডাক্টরের সংকট তৈরি হয়। স্মার্ট ফোন থেকে শুরু করে গাড়ি শিল্পে যা ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। উৎপাদন কমেছে প্রয়োজনীয় গৃহস্থালির ইলেক্ট্রনিক পণ্য থেকে গাড়ি নির্মাণেও। এই ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে নিয়ে আসতে না আসতেই এখন শুরু হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। এর ফলে বিশ্ববাজারে ইলেক্ট্রনিক পণ্যর থেকে শুরু করে বাড়তে পারে মোবাইল, গাড়ির দামও। 

হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন বর্ণহীন ও গন্ধহীন গ্যাস। এই গ্যাসগুলোকে বলা হয় নোবল গ্যাস বা নিষ্ক্রিয় গ্যাস। এরা অন্য মৌলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না বলে এদেরকে নিষ্ক্রিয় গ্যাস বলা হয়। আর এই গ্যাস উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষে রাশিয়া। এই গ্যাসগুলো গবেষণা কিংবা চীপ নির্মাণে অতীব জরুরী। 

লিথোগ্রাফি নামক প্রক্রিয়ায় সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নিয়ন। গ্যাসটি একটি লেজার থেকে উৎপাদিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ন্ত্রণ করে সিলিকনের ওপর বিশেষ গঠন তৈরি করে, যা মূলত একে চিপে রূপান্তরিত করে।

ইউক্রেনে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলা শুরু করে রাশিয়া। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞার পাল্টা জবাব দিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বেশ কিছু পাল্টা নিষেধাজ্ঞা ও নানা পণ্য ও সেবা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছেন। তার মধ্যে মস্কোর সাম্প্রতিক পদক্ষেপ হচ্ছে এই বিরল গ্যাস রপ্তানি সীমিত করা। 

রুশ সংবাদমাধ্যম তাস জানিয়েছে, গত মে মাসের শেষের দিক থেকে হিলিয়াম, নিয়ন ও আর্গন গ্যাসের রপ্তানি সীমিত করতে শুরু করে রাশিয়া। এ তিনটি গ্যাস স্মার্টফোন থেকে শুরু করে ওয়াশিং মেশিন, গাড়িসহ বিভিন্ন ভোক্তা পণ্যে ব্যবহৃত চিপ তৈরিতে কাজে লাগে। বেশ কিছু দিন ধরে প্রযুক্তি দুনিয়ায় চিপের বেশ সংকট তৈরি হয়েছে।

প্রযুক্তি শিল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বেইন অ্যান্ড কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়া ও ইউক্রেন একত্রে পুরো চিপ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ন গ্যাসের ৩০ শতাংশ সরবরাহ করত। সেমিকন্ডাক্টর শিল্প ও এর গ্রাহকেরা যখন বড় ধরনের সরবরাহ সংকটের মুখে ঠিক তখনই রাশিয়ার পক্ষ থেকে বিরল গ্যাসের রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

গাড়ি উৎপাদন পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান এলএমসি অটোমোটিভের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর চিপ সংকটের কারণে এক কোটি ইউনিট কম গাড়ি তৈরি হয়েছে। তবে এ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে গাড়ি উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার প্রত্যাশা ছিল।

এলএমসি অটোমোটিভের বৈশ্বিক উৎপাদন বিভাগের পরিচালক জাস্টিন কক্স বলেন, নিয়ন গ্যাসের সরবরাহ সীমিত করে দেওয়াটা দুশ্চিন্তার কারণ। তবে এটা গাড়ি শিল্পের জন্য আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। আট বছর আগে যখন ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়াকে আলাদা করেছিল রাশিয়া তখন থেকেই এ খাতে আবার সরবরাহ বিঘ্ন হওয়ার আশঙ্কা ছিল।


বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেকচেটের জ্যৈষ্ঠ প্রযুক্তি বিশ্লেষক জোনাস সানডকোভিস্ট বলেন, যুদ্ধের আগে রাশিয়ার ইস্পাত কারখানার উপজাত হিসেবে কাঁচা নিয়ন সংগ্রহ করা হতো। এরপর তা পরিশোধনের জন্য ইউক্রেনে পাঠানো হতো। সোভিয়েত যুগের শুরু থেকেই এই দুটি দেশ নোবল গ্যাসের শীর্ষ উৎপাদক। বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলো সামরিক ও মহাকাশ প্রযুক্তিতে এর ব্যবহার করত।

এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে গ্যাস উৎপাদন সক্ষমতার দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়েছে। ইউক্রেনের মারিওপোল, ওডেসাসহ বিভিন্ন এলাকায় রুশ সেনাদের সঙ্গে ইউক্রেনের সেনাদের লড়াইয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন শিল্প কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ওই অঞ্চল থেকে পণ্য রপ্তানি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বেড়েই চলেছে নোবেল গ্যাসের দাম

বেইন অ্যান্ড কোম্পানির সহযোগী পিটার হানবারি বলেন, নিয়ন গ্যাসের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল ৮০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে তা এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে এনেছেন নির্মাতারা।

রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি সীমিত করার প্রভাব কতোটা পড়বে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। হানবারি বলেন, এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক চিপ তৈরির প্রক্রিয়া এ যুদ্ধের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়নি। খুব শিগগিরই এর প্রভাব দেখা নাও যেতে পারে।

জোনাস সানডকোভিস্ট বলেন, বন্দরনগরী মারিওপোল ও ওডেসায় গ্যাস বিশুদ্ধিকরণ সক্ষমতা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের উদ্যোক্তারা ২০১৪ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর নির্ভরতা কমাতে শুরু করেছিলেন। ইউক্রেনে হামলার পর থেকে এই প্রচেষ্টা আরও জোরদার হয়েছে।

তবে চিপ নির্মাতাদের যদি রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হয় এবং অন্য উৎস খুঁজতে হয় তবে তাদের খরচ পড়ে যাবে অনেক বেশি। সানডকোভিস্ট বলেন, নিয়নসহ নোবল গ্যাসের দাম নির্ণয় করা কঠিন। কারণ, এগুলো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তবে টেকচেটের তথ্য অনুযায়ী, নিয়ন গ্যাসের দাম ইতিমধ্যে পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। এ বছরের শুরু থেকেই এর দাম বেড়েছে। শিগগিরই তা কমবে বলে মনে হয় না। যেকোনো নতুন চুক্তির ক্ষেত্রে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব অবশ্যই পড়বে।

দক্ষিণ কোরিয়ার চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং ইতিমধ্যে সমস্যায় পড়তে শুরু করেছে। কারণ দেশটিকে গ্যাস আমদানি করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা জাপানের মতো বড় গ্যাস কোম্পানির স্বল্পতাও রয়েছে দেশটির।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর চিপ রপ্তানির হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইনটেলকে ছাড়িয়ে যায় স্যামসাং। বিশ্বের আরেক বড় চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রন টেকনোলজির পক্ষ থেকে বলা হয়, নিয়ন গ্যাসের দাম বাড়ছে। তবে তাদের কাছে আগামী কয়েক মাসের চিপ তৈরির মতো গ্যাস রয়েছে।

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতে সুফল ভোগ করবে চীন

মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন বলছে, রাশিয়া অবন্ধুসুলভ দেশগুলোতে নিষ্ক্রিয় গ্যাস রপ্তানি সীমিত করার সুফল ভোগ করবে চীন। ২০১৫ সাল থেকে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে চীন। এর মধ্যে রয়েছে শিল্পপণ্য থেকে নিষ্ক্রিয় গ্যাস আলাদা করার মতো যন্ত্রপাতিও। চীন এখন এই গ্যাসের রপ্তানিকারক। 

বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেকচেটের জ্যেষ্ঠ প্রযুক্তি বিশ্লেষক জোনাস সানডকোভিস্ট বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের জন্য সবাই এখন চীনের দিকে ছুটবে। চীন এখন তাদের গ্যাস চড়া দামেই বাজারে বিক্রি করে মুনাফা করবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭