ইনসাইড থট

স্বাস্থ্য বাজেট এবং সুস্থ বাজেট


প্রকাশ: 24/06/2022


Thumbnail

বাংলাদেশের ৫১ তম জাতীয় বাজেট পেশ হয়েছে, যার আকার ৬.৭৮ লক্ষ কোটি টাকা। বিগত বছরের বাজেটের তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটের অংক ১৪.২৪% বেশি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। প্রথম বাজেটের তুলনায় প্রস্তাবিত ৫১ তম বাজেটের আকার প্রায় ৮৬৩ গুণ বেশী। সম্পূর্ণ ধংসস্তুুপের উপর দাঁড়ানো একটি সদ্যস্বাধীন দেশের বাজেটের আকার বর্তমানের তুলনায় নগণ্য, কিন্তু সে বাজেটে দেশের পূনগঠন, উন্নয়ন, পূর্নবাসন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, পল্লী উন্নয়ন এবং আয় বৈষম্য কমানোর সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ছিল। বর্তমানের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ৩৬,৮৬৩ কোটি টাকা, বিগত বছরে যা ছিল ৩২,৭৩১ কোটি টাকা। বিগত বছরে স্বাস্থ্য বাজেট ছিল জাতীয় বাজেটের ৫.২%, বর্তমান বছরে অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে (৫.৪%)। স্বাস্থ্য সেক্টরের প্রস্তাবিত এ বাজেট সন্তোষজনক কিনা বা তা কিরূপ হওয়া উচিৎ, এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বিশেষজ্ঞবৃন্দের আলোচনা/প্রবন্ধ ইতোমধ্যে প্রচার/প্রকাশ করা হচ্ছে। এ বাজেট দেশের সার্বিক জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থা উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে কিনা, সেটাই পর্যালোচনার বিষয়। এতে সন্তোষজনক তথ্য পাওয়া গেলেই স্বাস্থ্য বাজেটকে সুস্থ বাজেট বলা যাবে।

বাংলাদেশের সংবিধান স্বাস্থ্যকে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংবিধানের ১৮(১) উপানুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে “জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন”। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী কোন রোগ বা পঙ্গুত্ব না থাকলেই ভালো স্বাস্থ্য বলা যাবে না। ভালো স্বাস্থ্য হচ্ছে ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক এবং সম্পূর্ণভাবে সামাজিক বিকাশলাভের একটি অবস্থা। তৃতীয় বিশ্বের যে কোন দেশে রোগবিহীন সামাজিক বিকাশলাভের এ অবস্থা তৈরীতে সময় লাগবে, সন্দেহ নেই। তবে স্বাস্থ্য বাজেট ও কর্মসূচিতে এরূপ অবস্থা সৃষ্টির রূপরেখা, ভিত তৈরী এবং ক্রমান্বয়ে তা উন্নয়ন ও দৃশ্যমান করার প্রস্তাবনা ও বরাদ্দ থাকা বাঞ্চনীয়। তাহলেই স্বাস্থ্য বাজেট সুস্থ বাজেট হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে। 

আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় শুরু থেকেই গলদ। উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা একটা চিকিৎসামূখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পেয়েছি। যেখানে রোগীকে চিকিৎসা করাটাই মুখ্য, কেউ যাতে রোগী না হয় এজন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরী সেখানে গৌণ। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এ অবস্থা থেকে আমরা খুব একটা বের হতে পেরেছি, তাও নয়। আমাদের চিকিৎসক ও নার্স সংখ্যা অপ্রতুল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র/হাসপাতাল কম, হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা কম, বাজেট কম, এসব কথাই বিভিন্ন আলোচনায় বা প্রকাশনায় প্রতিধ্বনিত হয়। আমাদের রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচি অপর্যাপ্ত, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কম, স্কুল হেলথ কর্মসূচি খুবই অপ্রতুল বা প্রায় নেই-এ সম্পর্কিত আলোচনা বা প্রকাশনা অনেক কম। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট “পাবলিক এক্সপেনডিচার রিভিউ” নামে ১৯৯৭-২০১৪ সময়কালের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় নিয়ে ২০১৫ সালে একটা প্রকাশনা বের করেছিল। অবশ্যই একটা ভালো উদ্যোগ। পরবর্তী সময়ের তথ্য সম্বলিত প্রকাশনা এখন প্রকাশের অপেক্ষায় আছে, ছাপাখানায়। ২০১৫ সালের উক্ত প্রকাশনার ব্যয় চিত্রে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যয় ১৯৯৭ সালে ৪৭% থাকলেও তা ২০১২ সালে ৩৬% এ নেমে এসেছে। পরবর্তী সময়কালের চিত্র এ গতিতে নেমেছে না বেড়েছে, তা অচিরেই জানা যাবে। তবে মাঠ পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য কর্মসূচির চিত্র বলে না যে এ অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়েছে।

দেশের জনসংখ্যা ১৯৭২ এর তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেলেও জন্মহার ও মৃত্যুহার কমেছে, শিশু বয়সী জনসংখ্যা কমেছে, পরিবারের আকার বা জনসংখ্যা কমেছে, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমেছে এবং সংক্রামক রোগ কমেছে। সংক্রামক রোগ কমানোর ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি সবচেয়ে ভালো অবদান রেখেছে। স্বাধীনতার পরে যেখানে শিশু বয়সী জনসংখ্যার (০-১৪ বছর) হার ছিল ৪৫.২%, এখন তা ২৬% নেমে এসেছে। বেড়েছে কর্মক্ষম জনসংখ্যা এবং বয়স্ক লোকের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই অসংক্রামক রোগের হার বেড়েছে দ্রুত গতিতে, যেখানে দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন প্রয়োজন। অথচ এখানেই আমাদের বাজেট ও কর্মসূচিতে ঘাটতি অনেক বেশি।

অসংক্রামক রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। বাংলাদেশ হেলথ এন্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভে (বিডিএইচএস), ২০১৭-১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ৩৫ বছর ও তদুর্ধ বয়সী নারীর ৪৫% উচ্চ রক্তচাপে এবং ১৪% ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০১১ সালে এ হার ছিল যথাক্রমে ৩২% ও ১২%। এ বয়সী পুরুষের ৩৪% উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, যা ২০১১ সালে ছিল ১১%। যেহেতু এ হার প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তাই বর্তমানের চিত্র আরো অনেক বেশি। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ৬৬% পুরুষ এবং ৫০% নারী জানেন না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। যারা জানেন, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রোগ নিয়ন্ত্রণে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না, আর একটি অংশ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না। শুধুমাত্র ১৫% নারী এবং ৯% পুরুষ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখেন। ফলে স্ট্রোক, হƒদরোগ, কিডনী রোগ, ¯œায়ুতন্ত্র ও চোখের রোগ এবং অন্যান্য রোগের প্রকোপ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসব রোগের কারণে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা। চিকিৎসক, নার্স এবং হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা বৃদ্ধি এ অবস্থা নিরসনে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনবে না। স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরী এবং রোগ প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি ছাড়া এসব লাগামহীন মারণঘাতী রোগের কাফেলাকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।

উদ্দীপন নামের এনজিও তাদের ১২৩ টি আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমে সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য ক্যাম্প পরিচালনা শুরু করেছে। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগী সনাক্ত এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবার এ কার্যক্রমে প্রোব বাংলাদেশ লি. তাদের ডায়াগনস্টিক সার্ভিস প্রদান করে। গত ১০ মাসে উদ্দীপন ৩৪৬ টি পুলিশ ফাঁড়ি/থানাসহ তৃণমূল পর্যায়ে মোট ১৭,২৬৮ টি স্বাস্থ্য ক্যাম্পে ২,৯৬,৬৪৯ জন মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দিয়েছে। এদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের হার ৪১% এবং ডায়াবেটিস বা উচ্চ মাত্রার সুগার আছে এমন সংখ্যা ২৫%। উদ্দীপনের স্বাস্থ্য ক্যাম্পে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের তথ্য প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন আইডিসহ উদ্দীপনের ডাটাবেজে সংরক্ষিত আছে। উদ্দীপনের এ কার্যক্রম দেশব্যাপী সম্প্রসারণের বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে। তাছাড়া প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য একটি ইউনিক হেলথ আইডির মাধ্যমে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ও রিপোর্ট সংরক্ষণ করে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমকে আরও সহজ ও সাশ্রয়ী করা যেতে পারে।

প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির বরাদ্দ ০.৯৫%। এ হার সবসময় জিডিপির ১% এর নীচেই থাকছে অব্যাহতভাবে। যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে কম। ফলে চিকিৎসায় জনগণের নিজস্ব/ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে। চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ব্যয় দক্ষিণ এশিয়া এবং সার্কভূক্ত দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব খরচের হার ক্রমাগত বেড়েছে কয়েক দশক ধরেই । ১৯৯৭ সালে এর হার ছিল ৫৫% যা এখন ৭৪% এ উন্নীত হয়েছে। ডায়াগনস্টিকের প্রয়োজনীয় সকল টেস্ট সরকারি হাসপাতালে করার সুযোগ না থাকা বা কোন কোন ক্ষেত্রে  সংশ্লিষ্ট যন্ত্র খারাপ থাকায় এ খাতে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুপুরের পরে সরকারী হাসপাতালে ল্যাব সার্ভিস পাওয়া যায় না। এসব কারণে রোগীর খরচ বাড়ছে এবং হাসপাতালে অবস্থান দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ভারতসহ অনেক দেশে মাঠ পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালেই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে দিবারাত্রি ডায়াগনস্টিক সেবা প্রদান করে। এতে যেমন খরচ কম হয়, তেমনি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সরকারের বাড়তি খরচ, দূর্নীতি বা অপচয় রোধ এবং মেরামত সংক্রান্ত সময়ক্ষেপণ কমানো য়ায়।

স্বাধীনতার পরে টিএফআর (টোটাল ফার্টিলিটি রেট) বা একজন মা কতজন সন্তান জন্মদান করেন তার সংখ্যা ছিল ৬.৩। এখন তা ২.২ এর নীচে নেমেছে। নারী শিক্ষা জন্মহার নিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা রেখেছে । বিডিএইচএস এর  প্রতিবেদন অনুযায়ী নিরক্ষর বা প্রাইমারী পাশ মায়েদের সন্তান সংখ্যা যেখানে গড়ে ২.৬ জন, সেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষিত মায়েদের গড় সন্তান সংখ্যা ২.২ জন। খুলনা বিভাগে টিএফআর ১.৯ অর্থাৎ রিপ্লেসমেন্ট লেভেলের নীচে নেমেছে। সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতো হবেই না, বরং কমবে। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে তা একটু বেশী। অথচ স্বাধীনতার পরে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠ পর্যায়ের যে জনবল ছিল, এখনও তা আছে। এ জনবলের একটা অংশকে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়নে নিযুক্ত করা যেতে পারে। বাড়ীতে এখনও ৫০% সন্তান প্রসব হয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্য কর্মীর মাধ্যমে প্রসব হয় ৫৩%, অপর ৪৭% অপ্রশিক্ষিত/প্রশিক্ষিত ট্রাডিশনাল বার্থ এটেনডেন্ট বা দাই এর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। পরিবার পরিকল্পনা খাতের মাঠ পর্যায়ের জনবলের একটা অংশকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মিডওয়াইফ হিসাবে রূপান্তর, শূন্য পদে মিডওয়াইফ নিয়োগ এবং এ খাতে বাজেট বরাদ্দ ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।

পুষ্টি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য খাত। মাঠ পর্যায়ে বা হাসপাতালে এ খাতের জনবল যেমন নেই, কর্মসূচিও তেমনি দৃশ্যমান নয়। ছোটকাল থেকে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস তৈরী এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যে স্কুল হেলথ কর্মসূচির কোন বিকল্প নেই। এ কর্মসূচিও খুবই অপ্রতুল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথভাবে স্কুল হেলথ কর্মসূচি গ্রহণ এবং এ খাতে বাজেট বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন আছে। এ সকল দিক ছাড়াও স্বাস্থ্য খাতের অনেক বিষয়ে বাজেট বরাদ্দ ও উন্নয়নের সুযোগ আছে, যা স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে এরূপ কর্মসূচিতে বরাদ্দ থাকলে স্বাস্থ্য বাজেট সুস্থ্য বাজেট হিসেবে অবদান রাখতে সহায়ক হবে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭