ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

সম্পর্কের শীতলতা ঝেড়ে হঠাৎ কেনো সৌদির ঘনিষ্ঠ হতে উদগ্রীব তুরস্ক?


প্রকাশ: 24/06/2022


Thumbnail

২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে সাংবাদিক জামাল খাসোগজির হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষুব্ধ তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান খোলাখুলি আঙ্গুল তুলেছিলেন যুবরাজ মোহামেদ সালমানের দিকে।

তারপর খুব দ্রুত মুসলিম বিশ্বের দুই প্রভাবশালী দেশের সম্পর্কে ধস নামতে শুরু করে। বছরে খানেকের মধ্যে সম্পর্ক এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকে যে সৌদি আরব অনানুষ্ঠানিকভাবে তুরস্কের পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

অন্যদিকে, বহুদিন পর্যন্ত সুযোগ পেলেই সৌদি রাজপরিবারকে একহাত নিতে ছাড়েননি মি. এরদোয়ান। দুই দেশের সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় নিয়মিত দুই সরকারের মধ্যে প্রকাশ্যে নিয়মিত কাদা ছোঁড়াছুড়ি চলেছে অনেকদিন।

কিন্তু এপ্রিলে হঠাৎ মি. এরদোয়ানের সৌদি আরব সফর এবং জেদ্দায় যুবরাজ সালমানের সাথে তার করমর্দনের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর ইঙ্গিত মেলে হাওয়া বদলাতে শুরু করেছে।

গত কয়েক মাসে দুই দেশের সম্পর্কে উষ্ণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ব্যবসা, বিমান চলাচলে বিধিনিষেধ উঠে গেছে। সৌদি আরবে তুর্কি টিভি সিরিজের সম্প্রচার শুরু হয়েছে । দু দেশের মিডিয়ার পরস্পরের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা চলছিল তা বন্ধ হয়েছে। এরপর বুধবার যুবরাজ মি. এরদোয়ানের বিশেষ আমন্ত্রনে যুবরাজ সালমান তুরস্কে যাওয়ার পর এটি এখন পরিষ্কার যে আঙ্কারা এবং রিয়াদের সম্পর্কের জমাট বরফ গলছে।

কেন হাত বাড়ালেন এরদোয়ান?

আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই যে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানই সৌদি আরবের সাথে নতুন করে সুসম্পর্ক তৈরিতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন।

"আমি বলবো মি. এরদোয়ান কিছুটা হলেও নতজানু হয়েছেন। গত কয়েক মাস ধরে বিশেষ করে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে চটে যাওয়া সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে তিনি উঠে-পড়ে লেগেছেন," বিবিসি বাংলাকে বলেন লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশন্যাল ইন্টারেস্টের প্রধান সাদি হামদি।

কিন্তু কেন মি. এরদোয়ান তার চিরাচরিত যুদ্ধংদেহী ভাবমূর্তি আড়ালে রেখে নতজানু হচ্ছেন? সাদি হামদি মনে করেন, প্রথম এবং প্রধান কারণ তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকট।

তুরস্কের মুদ্রা লিরা একরকম মুখ থুবড়ে পড়েছে। রয়টার্স বার্তা সংস্থার খবর অনুয়ায়ী ২০২১ সালে এক বছরেই ডলারে বিপরীতে লিরার মূল্যমান অর্ধেক হয়ে গেছে। মুদ্রাষ্ফীতির হার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। 



"নির্বাচনের মাত্র এক বছর বাকি। নির্বাচনের আগে উপসাগর থেকে বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে বিনিয়োগ ফিরিয়ে এনে অর্থনৈতিক সংকট কিছুটা হলেও সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন মি. এরদোয়ান," বলেন মি. হামদি।

গত সপ্তাহে মি. এরদোয়ান বলেন, তিনি এবং সৌদি যুবরাজ "দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কতটা উচ্চতায় নেওয়া সম্ভব" তা নিয়ে কথা বলবেন। তার সরকারের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, সৌদি যুবরাজের সফরের ফলে দুই দেশের মধ্যে "সংকট পূর্বকালীন (২০১৮ সালে খাসোগজি হত্যাকান্ডের আগে) সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্টিত হবে এবং সম্পর্ক পুরোপুরি স্বভাবিক হবে।"

জানা গেছে, জ্বালানি, ব্যবসা এবং নিরাপত্তা বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হবে। সেই সাথে, তুর্কি স্টক মার্কেটে সৌদি বিনিয়োগ নিয়ে কথা হবে। সৌদি আরবের কাছে তুরস্কের তৈরি সামরিক ড্রোন বিক্রি নিয়ে কথা হবে।

অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুনের নির্বাচনের আগে তুরস্কের অর্থনীতির দুরাবস্থা কাটাতে মি.এরদোয়ান সৌদিদের কাছ থেকে ব্যবসা এবং বিনিয়োগ চাইছেন।

পিছু হটছেন এরদোয়ান?

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্সের গত মাসে প্রকাশিত একটি প্রকাশনায় গবেষক স্টিভেন এ কুক লিখেছেন - মি. এরদোয়ান তার 'স্বভাবসুলভ আগ্রাসি' পররাষ্ট্রনীতি থেকে হয়তো পিছু হটছেন।

"তার অনর্থক আগ্রাসি পররাষ্ট্র নীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ধনী উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলেছিলেন তিনি। তাতে তুরস্কের কোনো লাভ হয়নি," বলছেন মি. কুক।

২০১৩ সালে মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের পর প্রেসিডেন্ট সিসির ওপর প্রচণ্ড খেপে যান মি. এরদোয়ান। তখন থেকেই মিশরের বিরোধী রাজনীতিকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। ইস্তাম্বুলে বসে সিসি সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাতে দিয়েছেন।

সৌদি আরব মিশরের ঐ সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থন করলে সৌদি রাজপরিবারের ওপর ক্ষেপে যান মি. এরদোয়ান। ফলে, ২০১৭ সালে সৌদি আরব, ইউএই সহ চারটি উপসাগরীয় দেশ কাতারের ওপর অবরোধ দিলে কাতারের সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তুরস্ক।



এরপর ২০১৮ সালে খাসোগজি হত্যাকান্ডের পর সৌদি আরব এবং ইউএইকে একহাত নেওয়ার সবরকম চেষ্টা করেন মি এরদোয়ান। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, খাসোগজির হত্যাকাণ্ডের বিচারের চেয়ে মি. এরদোয়ানের প্রধান লক্ষ্য ছিল ঐ ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে সৌদি আরবকে ঘায়েল করা।

ফলে, ক্রমশ চটে যেতে থাকে সৌদি আরব, ইউএই এবং মিশরের মত মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে তুরস্কের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক।

সম্পর্কে চিড় ধরার আগে সৌদিরা ছিল তুরস্কে স্থাবর সম্পত্তির সবচেয়ে বড় ক্রেতা। একশো'রও বেশি তুর্কি কোম্পানি সৌদি আরবে ব্যবসা করছিল। এক লাখের মত তুর্কি নাগরিক সৌদি আরবে কাজ করে।

সৌদি অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আমাল আব্দুল-আজিজ আল-হাজানির দেওয়া হিসাব মতে তুরস্ক ২০২৩ সালের মধ্যে ২,৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সৌদি বিনিয়োগ টার্গেট করেছিল, আর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২,০০০ কোটি ডলারে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সেসব টার্গেট ভেস্তে যায়।

'বন্ধু কমছে, শত্রু বাড়ছে'

সাদি হামদি বলেন, তুরস্কের ভোটারদের কাছে পররাষ্ট্রনীতির চেয়ে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির গুরুত্ব অনেক বেশি। "অনেক মানুষের ভেতর এমন ধারণা শক্ত হচ্ছে যে মি. এরদোয়ানের কারণে তুরস্কের বন্ধু কমছে, শত্রু বাড়ছে।"

সম্প্রতি একটি ভিডিও ফুটেজ তুরস্কের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় যেখানে দেখা যায় ব্যবসায়ীদের এক সম্মেলনে এক নারী উদ্যোক্তা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে বলছেন সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক চটে যাওয়ার তার ব্যবসা লাটে ওঠার পথে।



শুধু অর্থনীতিই নয়, ভূ-রাজনীতিতে তুরস্ককে পাল্টা ঘায়েল করতে সৌদি আরব এবং ইউএই তৎপরতা শুরু করেছিল। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মজুদ জ্বালানির মালিকানা নিয়ে তুরস্কের সাথে বিরোধে সাইপ্রাস ও গ্রিসের সমর্থনে এগিয়ে আসে মিশর, সৌদি আরব আরব এবং ইউএই।

২০২০ সালে গ্রীষ্মে গ্রীসের বিমানবাহিনীর এক মহড়ায় অংশ নেয় সৌদি এবং আমিরাতে বিমান বাহিনীর পাইলটরা।

এসব ঘটনা তুরস্ককে উদ্বিগ্ন করে তুলছিল।

স্টিভেন এ কুক তার বিশ্লেষণে বলেন, "এরদোয়ান সরকার এখন উপলব্ধি করছে যে আঞ্চলিক দেশগুলোর ওপর তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার মত শক্তি তাদের নেই।"

আর এসব প্রেক্ষাপটেই দৃশ্যত উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছেন মি এরদোয়ান।

যেসব ছাড় দিয়েছে তুরস্ক

সম্প্রতি খাসোগজির বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।

মিশরের বিরোধী বেশ কিছু রাজনীতিক ইস্তাম্বুলে বসে প্রেসিডেন্ট সিসির সরকারের বিরুদ্ধে যে তৎপরতা চালাচ্ছিল তা প্রায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের পরিচালিত অনেক টিভি চ্যানেলে তালা ঝোলানো হয়েছে। মিশরীয় সরকার বিরোধীদের পরিচালিত বেশ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া সাইটও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের অনেককে তুরস্ক ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তাহলে মি. এরদোয়ান তার পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে অনুশোচনা করছেন? ভুল স্বীকার করছেন? সাদি হামদি মনে করেন ভুল স্বীকার না করলেও মি. এরদায়ান মেনে নিচ্ছেন যে তিনি যেমনটা চেয়েছিলেন তা হয়নি।

মি হামদির মতে - নির্বাচনের আগে তিনি তুরস্কের মানুষকে দেখাতে চাইছেন যে অভ্যন্তরীন বিষয়গুলোকে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে তিনি মনে করেন না যে মি. এরদোয়ান তার বিদেশ নীতি বর্জন করছেন, বড়জোর "স্বল্প মেয়াদে অগ্রাধিকার বদলাচ্ছেন।"

সৌদি আরবের দিতে হাত বাড়িয়ে এরদোয়ানের শক্তিশালী ভাবমূর্তি চোট খেয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু একইসাথে এটাও সত্যি যে তুরস্ক এখনও সদম্ভে লিবিয়ায় রয়েছে। মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বাড়াচ্ছে। ভূমধ্যসাগরে এখনও তুরস্ক অনেক বড় শক্তি। সিরিয়া থেকে তারা নড়বে বলে মনে হয়না। এমনকি সাব-সাহারা অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের পথ থেকে সরে যাবার কোনো লক্ষণ তারা দেখাচ্ছে না।

মি. হামদি মনে করেন, সম্ভবত সৌদি আরব এবং ইউএই বা মিশরের নেতারাও মি. এরদোয়ানের মনোভাব সম্পর্কে এখনও সন্দিহান।

"প্রথম যখন এরদোয়ান সৌদি এবং আমিরাতিদের কাছে যান, তারা উৎসাহ দেখায়নি। তাদের আস্থা অর্জন করতে গত কয়েকমাসে অনেক ছাড় দিয়েছেন এরদোয়ান। তারপরও মিশর এখনও তার ব্যাপারে শীতল।"

মি. হামদি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিশ্লেষক বলছেন এবং লিখছেন যে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ঘুচলে এবং নির্বাচন পেরুলে মি.এরদোয়ানের পুরনো রূপ ধারণ করবেন।

কেন সাড়া দিচ্ছে সৌদি আরব

এমন সন্দেহ থাকা সত্বেও সৌদি আরব বা ইউএই কেন সাড়া দিচ্ছে?

প্রথম কথা, খাসোগজি হত্যাকান্ডের পর গোত্তা খাওয়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন যুবরাজ সালমান। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাকে খানিকটা হলেও সুযোগ করে দিয়েছেন।

তবে একইসাথে সাদি হামদি মনে করেন, বর্তমান অথনৈতিক সংকটে সস্তায় তুরস্কের সম্পদে অংশীদার বা মালিক হওয়ার সুযোগ সৌদি আরব ছাড়তে চাইছে না।

তাছাড়া, তিনি বলেন, তুরস্কের সমাজ ও রাজনীতির অন্যান্য অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ পেয়েছে সৌদি আরব এবং আমিরাত।

"মোহাম্মদ সালমান এবং মোহামেদ বিন জায়েদ হয়তো মনে করছেন এরদোয়ান দীর্ঘদিন থাকবেন না এবং তুরস্কের বিরোধীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের এটাই সুযোগ।" সূত্র: বিবিসিবাংলা 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭