ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

সামরিক গণহত্যা নাকি অর্থনৈতিক গণহত্যা?


প্রকাশ: 28/06/2022


Thumbnail

আধুনিকতা প্রবাহমান, সভ্যতার একদমই অগ্রসময়ে থেকেও আমরা প্রতিনিয়িত ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। বিশ্বজুড়ে মানুষের রাজনৈতিক অভিবাসন এবং উদ্বাস্তু অভিবাসীর সংখ্যা ইতিহাসের যেকোন সময়ের থেকে বিংশ শতাব্দী শুরুর পরে বিভিন্ন সময়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধ শুরু হবার পরে ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তু সমস্যা, রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু হবার পরে সবেচেয়ে আধুনিকতম উদাহরণ।

ইংরেজীতে migration এবং refugee শব্দ দুটির আপেক্ষিক অর্থ কাছাকছি হলেও রিফিউজি শব্দটা আরো জোড়ালোভাবে নৃশংসতা এবং যুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। মানে যাদের জোড় করে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গ, আসলেই মনে আসে একাত্তরের কথা, পৃথিবী এর আগে এবং পরে এতো বড় উদ্বাস্তু সংকট আর দেখেছে কি? এরপরে, ভূ-রাজনৈতিক বিভিন্ন পালাবদলের সাথে সাথে বদলেছে যুদ্ধের ধরণ ও অর্থনৈতিক কাঠামো। এরই ফলশ্রুতিতে আমরা এখন এমনই এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যখন পৃথিবীর এক প্রান্তের ছোট কোন পালাবদলেও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে গিয়ে দোল দেয়। সেখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধের তকমা না পেলেও আদতে তা ভিন্ন কিছু নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর সময়ে ‘স্নায়ু যুদ্ধ’ শুরুর পর থেকে একমাত্র রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই বৈশ্বিক সংকটের সূচনা করেছে যা এই সময়কালীন অন্য কোনো যুদ্ধ পারে নি। যুদ্ধ হচ্ছে শুধু ইউক্রেন ভূখণ্ডে কিন্তু যুদ্ধের প্রভাব ছড়িয়ে পরেছে বিশ্বের প্রতিটি সাধারণ মানুষের ঘরে। তাহলে আমার দাবী নিশ্চয়ই অন্যায্য হবে না যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের নব রূপান্তর।

এমন তো হওয়াই স্বাভাবিক। পৃথিবী যে এখন বৈশ্বিক গ্রাম। তাই আমার অবিধায় বিশ্ব এখন এক নৈরাজ্যময় গ্রাম। বলা যেতে পারে “আমেরিকান হেজেমনি’র” প্রভাবে “গ্লোবাল এনার্কি” শুরু হয়েছে। আরও স্পস্ট করে বললে বলা যেতে পারে “অর্থনৈতিক অরাজকতা”।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যেমন তেল ও জ্বালানি সংকট শুরু হয়েছে দেশে দেশে তেমনি শুরু হয়েছে খাদ্য সংকট। রাশিয়া-ইউক্রেনের গমের রপ্তানি হ্রাস ও দাম বৃদ্ধির প্রভাব এসে পরছে বাংলাদেশের রিক্সা/ভ্যান চালকদেরও পেটেও। সকালবেলা যে ব্যক্তি দুই ঘন্টা কাজের পরে চায়ের দোকানে গিয়ে চা, রুটি/কেক দিয়ে নাস্তা করত ১৫টাকায়, সম্প্রতি সেটাই গিয়ে ঠেকেছে ন্যূনতম ২২ টাকায়। এই যে রাতারাতি বিশ্বজুড়ে গমের সরববারহ হ্রাস ও দামবৃদ্ধি তা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণ হয়ে আমাদের সাধারণ জনজীবনে এসে পরছে। একে বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব বললে কি ভুল বলা হবে! 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তা ‘তেতাল্লিশের মন্বন্তর’ নামে খ্যাত। বিশ্বায়নের এই সময়ে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা এবং আন্তদেশীয় সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির খাতিরে না খেয়ে রাস্তায় মরে পরে মানুষ থাকবে না মানুষ। সেকথা সত্য হলেও, এই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে প্রচণ্ড বিপাকে ফেলবে। নির্দিষ্ট আয়ে, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি! তা তো বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক গৃহযুদ্ধেরই ইঙ্গিত দেয়। 

রাজনৈতিক উদ্বাস্তু সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে অর্থনৈতিক অভিবাসন সমস্যা। এই সমস্যার প্রভাব আমাদের সামনে বর্তমানে প্রকট না হলেও ভবিষ্যতে প্রকটাকার ধারণ করতে পারে। 

সেই প্রসঙ্গত মিশরীয় তাত্ত্বিক শেরিফ হেটাতার রচনা “ডলারাইজেশন, ফ্রাগমেন্টেশন, এন্ড গড” এর আলোকে বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করলে সেই একই ঘটনা নজরে আসে। ডলারাইজেশনের বিপরীতে পুতিন প্রণীত “রুবলাইজেশন” রাশিয়ার অর্থনৈতিক ভিত কিছুটা শক্ত করলেও আদোতে তা বিশ্ববাসীর জন্য নতুন আরেক সমস্যা। বিশেষ করে উঠতি অর্থনীতির দেশ বা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা জাতিরাষ্ট্রগুলোর জন্য। 

Fragmentation বা বিভাজন নীতি তো আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের আরেক নতুন এবং কার্যকরী কৌশল। যে কৌশলে পুরো ইউরোপ এখন একত্র হয়ে রাশিয়াকে বর্জন করার ডাক দিয়েছে। কারা ‘কোয়াড’ সৃষ্টি করে বৈশ্বিক বিভাজনে লিপ্ত তা আমাদের সামনে স্পস্ট। নির্বাসিত মাদুরোকে যারা আবার নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতায় আনার পরিকল্পনা নিয়ে বৈশ্বিক বিভাজনের নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারাই তো সেই ঈশ্বর! চীনের আর্থ-সামাজিক আগ্রাসন রোধের নামে তাইওয়ানকে উস্কে দেয়া, উত্তর কোরিয়াকে মোকাবিলায় দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি সবকিছু তো শেরিফ বর্ণিত ঈশ্বরের প্রতক্ষ্য মদদেরই ফলাফল। 

আবার ফিরে আসি গণহত্যায়। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানীদের গণহত্যা, পরবর্তীকালে সিরিয়া, ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও অভিবাসী সমস্যা, হালের সময়ে রোহিঙ্গা অভিবাসী সমস্যা, যেসব রাজনৈতিক পালাবদ্লের ফলে গত ৫০/৫৫ বছরে বিশ্বজুড়ে যে সব উদ্বাস্তু সমস্যার শুরু হয়েছে, সেই উদ্বাস্তু পুতুলনাচের পরিচালক কিন্তু ঈশ্বর নিজেই। 

আমাদের সামনে চোখের সামনে কিছু রাজনৈতিক গণহত্যা দৃশ্যমান। কিন্তু বিশ্বের মানুষ অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার, যার ধারাপাত সাম্প্রতিক অতীতে সহ বর্তমানের তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বে, আফ্রিকা, এশিয়ায় অর্থনৈতিক গনহত্যাকে নীরবে সমর্থন জানায়।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭