ইনসাইড এডুকেশন

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা কেন বেপরোয়া হয়ে উঠছে?


প্রকাশ: 03/07/2022


Thumbnail

সম্প্রতি সাভারের হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরাফুল আহসান জিতু তারই শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ওই শিক্ষক। শিক্ষকের অপরাধ ইভটিজিংসহ আচরণগত সমস্যার কারণে শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান হিসেবে জিতুকে শাসন করা। জানা যায়, জিতু এলাকায় একটি কিশোর গ্যাং পরিচালনা করে বেড়াচ্ছিল। তার এভাবে বেড়ে ওঠার পেছনে অভিভাবকদের সমর্থন কিংবা নীরব ভূমিকা ছিলো। এ ধরণের কিশোর গ্যাং দেশে বেড়েছে বহুগুণে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বখাটে, মেয়েদের উত্ত্যক্তকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধমকি দেওয়া ব্যক্তিদের নাম গণমাধ্যমে উঠে আসে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে এমন বেপরোয়া শিক্ষার্থীর আতঙ্কে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই শিক্ষাজীবন কাটান, দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অনেকেই এ ধরনের বেপরোয়া শিক্ষার্থীর আচরণে বিব্রত হন। রাজনৈতিক পরিচয়ে এরা এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠার সুযোগ পায় বলেও জানান অনেকেই। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব হচ্ছে কেন?

এই বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, আমরা একটা অপসংস্কৃতির দিকে চলে যাচ্ছি। আগে সমাজের সব ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আলাদা একটা মর্যাদার জায়গা ছিল। নানা কারণেই আমাদের সমাজের এখন অবক্ষয় হয়েছে। এখন শিক্ষকরা মর্যাদা তো পায় না বরং তারা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন বিভিন্নভাবে। সাম্প্রতিক সময়ে সাভারে যে ঘটনাটি ঘটছে তা রীতিমতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। যে ছাত্র এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে তার নিজস্ব একটি কিশোর গ্যাং আছে। আমি মনে করি আমাদের ব্যর্থতার চেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও একটা বড় ব্যর্থতা আছে। যেভাবে শিশু কিশোররা গ্যাং তৈরি করছে। তা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। তাছাড়া এরা যে শুধু শিক্ষকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে না নয়, এরা হরহমাশেই বিভিন্ন মানুষের ওপর হামলা করছে। সেটা হয়তো কোনো ব্যবসায়ীর ওপর করছে কিংবা কোনো মহিলাকে হেনেস্তা করছে। যে গুলো হয়তো সেভাবে সামনে আসেনি।

এদিকে আবার ধর্মীয় কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত গুজবে বিশ্বাসী হয়ে একদল শিক্ষার্থী শিক্ষকদের অপদস্থ করতে মোটেও দ্বিধা করে না। নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে অপদস্থ করা, তিনজন শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়াসহ কলেজে ভয়ানক দাঙ্গা সৃষ্টির মতো পরিস্থিতি এর সাম্প্রতিক উদাহরণ। এর পেছনে অনেক শিক্ষক উসকানিদাতা ছিলো বলেই জানা যায়। অথচ ফেসবুকের সরাসরি ধর্ম-সংক্রান্ত নয় এমন একটি পোস্ট একজন শিক্ষার্থী শেয়ার দেওয়ার অপরাধে হিন্দু সম্প্রদায়ের কলেজশিক্ষকদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টি, শিক্ষককে এভাবে অপদস্থ করা, মেরে ফেলতে তেড়ে আসার বিষয়টি কতটা হিংসাত্মক মনোবৃত্তির পরিচয় বহন করে, তা সহজেই অনুমেয়।

কদিন আগে মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে তাঁরই শ্রেণীকক্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দেশে তুলকালাম ঘটিয়ে দিয়েছে। এর কয়েক বছর আগে একজন সংসদ সদস্য ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অপবাদ দিয়ে একজন প্রধান শিক্ষককে কান ধরিয়ে ওঠবস করিয়েছিলেন। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। শিক্ষককে অপদস্থ করার পেছনে কখনো ছাত্র, কখনো পরিচালনা কমিটি, কখনো স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ শিক্ষক অংশ নিচ্ছেন।

আবার উল্টো অভিজ্ঞতাও কম নয়। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, তাঁর কয়েকজন সহকর্মী এবং লম্পট ছাত্র, স্থানীয় রাজনীতির কিছু ব্যক্তি জড়িত থাকার অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায়ই শিক্ষকদের দ্বারা ছাত্রীদের যৌন হয়রানির কথা শোনা যায়। পত্রপত্রিকায় শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন, ছাত্রাবাসে ছাত্রদের বলাৎকার, যৌন হয়রানি ইত্যাদিতেও জড়িত থাকার অসংখ্য ঘটনা বাংলাদেশে প্রায়ই ঘটে থাকে। কিন্তু শিশু শিক্ষার্থীর বলাৎকারের বিষয়টি এখন সমাজে বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আইন, বিধিবিধান জানেন না, মানেনও না। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগেও রয়েছে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অযোগ্যদের নানা ফাঁকফোকর। শ্রেণিপাঠের পরিবর্তে কোচিং, নোটবই, গাইডবই এবং পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের নানা ব্যবস্থা।

জিপিএ-৫ পাওয়া, দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দৌড়ে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মনোযোগ যেখানে, সেখানে শিক্ষার্থীর মানসগঠন, সাংস্কৃতিক বোধ, সমাজ ও বিশ্ববাস্তবতার জ্ঞান আহরণ হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে শিক্ষার নামে যা চলছে তাতে মেধাবী, যুক্তিশীল, উদার মানসিকতা, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে। সেখানে ঝেঁকে বসেছে কার্যত অর্ধশিক্ষা, বখাটে হয়ে যাওয়া, বেকারত্ব এবং সমাজ ও সভ্যতাবিরোধী বিশ্বাসে বেড়ে ওঠা তরুণ-তরুণী। আর এর থেকে উত্তরণে পরিবার, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের নজরদারি এবং ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭