ইনসাইড থট

কোরবানির পশুর বর্জ্যকে সম্পদে রুপান্তর


প্রকাশ: 07/07/2022


Thumbnail

সীমিত আয়তনের জনবহুল বাংলাদেশে ব্যাপক জনগোষ্টির খাদ্য সংকুলান করতে সীমিত আবাদী জমির উপর চাপ বাড়ছে। জমির অতিকর্ষণে ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। টপসয়েলের আস্তরণ কমে যাচ্ছে। একই জমি বারবার একই ফসল চাষ করার ফলে মাটির গুণগতমানের নেতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে এবং অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে। বেশী ফলনের জন্য উচ্চ ফলনশীল শস্যবীজ রোপন করা হচ্ছে যাতে প্রচুর সার, কীটনাশক ও সেচের প্রয়োজন। শুষ্ক মৌসুমে ইরি চাষের জন্য প্রচুর সেচের প্রয়োজন হয়। এতে ১২০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়।

বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে কৃষির অন্যতম উপাদান সার আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্যাস, ডিজেল, কয়লার অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। যার ফলে কৃষিতে প্রয়োজনীয় সেচ বাধাগ্রস্থ হবে। সার এবং সেচের অভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে। ব্যাপক জনগোষ্টির এদেশে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করবে। টাকা থাকলেও আমদানির জন্য বিশ্ব বাজারে চাল, গম পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। 

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আতংঙ্কিত না হয়ে নিজেদের সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং শ্রমের মাধ্যমে খাদ্য সংকট মোকাবেলা করতে হবে। এ সংকট উত্তরণে পশুর হাটের গোবরসহ অন্যান্য বর্জ্য এবং  কোরবানির পশুর মাংস ও চামড়া ছাড়া অবশিষ্টাংশ বিশেষ করে পশুর গোবর ও পাকস্থলীর অহজমকৃত বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে রাখা, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা কর্তৃক আলাদাভাবে পরিবহন ও সংরক্ষণ করা। পরবর্তীতে এসব বর্জ্য জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করা। স্থানীয় সরকার বিভাগ বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদকে জরুরি নির্দেশনা প্রদান এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের সহযোগিতা কামনা করতে পারে। 

ইসলাম ধর্মালম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব হচ্ছে ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানির ঈদ। ঈদ-উল-আযহায় ইসলামের বিধান অনুযায়ী ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ পশু কোরবানি করেন। করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য, জনগণের যাতায়াত, পশু পরিবহন, পশু বেচাকেনা, কোরবানির পশু জবাই, পরিবেশ সুরক্ষা এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলতা বিবেচনায় এবছরের কোরবানি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। করোনার উর্ধ্বমুখী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়ে মানুয়ের চলাচল ও কোরবানি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ  করা অত্যাবশ্যক। পশুর হাটে সবাইকে মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রবেশ করা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ৯৮ লাখ পশু কোরবানি হয়। তারপর থেকে ক্রমাগত বেড়ে ২০১৭ সালে ১ কোটি ৪ লাখ, ২০১৮ সালে  কোটি ৬ লাখ, ২০১৯ সালে ১ কোটি ৬ লাখ পশু কোরবানি হয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেশে করোনা সংক্রমন শুরু হলে ওই বছর কোরবানি কমে হয় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার। ২০২১ সালে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ, তার মধ্যে কোরবানি হয়েছে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার পশু। এবছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২১ লাখ, যা গত বছর বিক্রিত পশুর চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি।

কোরবানির মাত্র ৩ দিন বাকি। ঈদকে সামনে রেখে মানুষ ইতিমধ্যে গ্রামের বাড়িতে ছুটে যাওয়া শুরু করেছে। পাশাপাশি ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহর, বন্দর নগরী চট্রগ্রাম, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারি তথ্যমতে ৪৪৬০টি পশুর হাট বসবে। কোরবানির পশুর হাট, পশু কেনাবেচা ও পরিবহন করা, কোরবানির পশু জবাই, বর্জ্য অপসারণ ইত্যাদির মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার সমূহসম্ভাবনা রয়েছে। 

পশু কেনাবেচায় জনসমাগম এড়িয়ে অনলাইন হাটে বেশি সংখ্যক মানুষকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্র্তপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এলক্ষ্যে ডিজিটাল টেকনোলজি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সম্পৃক্ত করতে হবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনলাইন কেনাবেচা বৃদ্ধিতে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।

কোরবানিকে সামনে রেখে দেশের বাইরে থেকে গবাদিপশু আসা বন্ধে কঠোর নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে। যাতে আমাদের গো-খামারিরা এবং জনগণ কেউই ক্ষতির সম্মুখীন না হন। 

পশু পালন করতে গিয়ে অতি মুনাফালোভী খামারিরা পশু মোটাতাজাকরণে স্টেরয়েড ও হরমোন ব্যবহার করে থাকেন। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব পশুর মাংস খেয়ে স্বাস্থ্যহানি, স্থুলতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, অনাকাঙ্খিত বৃদ্ধি, হরমোন সমস্যা, কিডনী, লিভারসহ মারাত্মক রোগের শিকার হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এমনকি খামারিরাও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে কোরবানির পশু মোটাতাজা করা হয়েছে কিনা তা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা-উপজেলাসহ সারা দেশের পশুর হাটগুলোতে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

জবাইকৃত পশুর বর্জ্য - রক্ত, নাড়িভুড়ি, গোবর, হাড়, খুর, শিং সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনার অভাবে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্যের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে। পরিবেশসম্মত কোরবানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে করা হলে একদিকে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা, অন্যদিকে জবাইকৃত পশুর মাংস ও চামড়া ছাড়া অবশিষ্টাংশ সম্পদে পরিণত করা সম্ভব হবে। আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেয়া পশু হাড় থেকে শুরু করে শিং, অন্ডকোষ, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রথলি, চর্বি বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। হাড় বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। এ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মতে, জবাইয়ের পর গরুর আকার ভেদে ১৫ থেকে ২৫ কেজি হাড় ফেলে দেয়া হয়। হাড় দিয়ে ওষুধ, সিরামিক পণ্যসামগ্রী, বোতাম ও ঘর সাজানোর উপকরণ তৈরি করা হয়। এছাড়া হাড় দিয়ে ওষুধ ক্যাপসুলের কভার, মুরগির খাবার, জমির সার, চিরুনি তৈরি হয়। চীন ও থাইল্যান্ডে এসব হাড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। শুধু অসচেতনতা আর অবহেলার কারণে কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। কোরবানিসহ সারা বছর জবাইকৃত গরুর হাড়ের মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।

বর্তমানে দেশে জবাইকৃত গরু মহিষ ছাগলের মাংস ও চামড়া ছাড়া অবশিষ্টাংশ রপ্তানি করে আয় হচ্ছে ২৯০ কোটি টাকা। যদিও বর্তমানে মোট অবশিষ্টাংশের মাত্র ২০ শতাংশ সংগ্রহ করা হচ্ছে বাকি ৮০ শতাংশ পচে-গলে নষ্ট হচ্ছে এবং পরিবেশকে দূষিত করছে। পুরো অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা গেলে এ খাত থেকে বছরে ১ হাজার ৫ শত কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। গত অর্থ বছরে এখাত থেকে আয় হয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। গরু মহিষের নাড়িভুঁড়ি (ওমাসম) রপ্তানি করে প্রতি বছর আয় হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। কোরবানির সময় সংগ্রহ করা হয় মোট রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ।

পশু হাটের গোবর ও উচ্ছিষ্ট গোখাদ্য সার্বক্ষণিক সংগ্রহ এবং কোরবানির পর পশুর গোবর ও পাকস্থলীর অহজমকৃত বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে রাখা। এসব বর্জ্য সিটি করপোরেশন, পৌরসভা কর্তৃক আলাদাভাবে পরিবহন ও সংরক্ষণ করা। সংগৃহীত এসব বর্জ্য জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করা এবং এ সারের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। প্রতি কেজি সারের মূল্য ৫০ টাকা হিসেবে মোট মূল্য দাঁড়াবে ২ হাজার ২ শত ৭৫ কোটি টাকা। জবাইকৃত গরু মহিষ ছাগলের মাংস ও চামড়া ছাড়া অবশিষ্টাংশ যে সম্পদ, বর্জ্য নয় তা ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে এবং এগুলো সংগ্রহে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে।

জনপ্রতিনিধি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, স্থানীয়  প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আলেম-ওলামা, বাণিজ্যিক সংগঠন, যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক কর্মী, যুব ও ছাত্র সমাজসহ সর্বস্তরের জনগণ সম্মিলিতভাবে করোনার উর্ধ্বমুখী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও ঈদ ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম। শুধু প্রয়োজন পরিকল্পনা মাফিক প্রত্যেককে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করা। পাশাপাশি যারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা।

সরকারি বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি নিজেদের স্বার্থে অবশ্যই আমাদের সকলকে মানতে হবে। দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠির জীবন বিবেচনায় নিয়ে বিধিনিষেধ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আরো কঠোর হতে হবে। অন্যথায় আমাদেরকে ভয়ানক পরিণতি ভোগ করতে হবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭