ইনসাইড থট

দেওয়ান লালন- ‘লোকে যারে নাহি ভুলে’


প্রকাশ: 15/07/2022


Thumbnail

বাংলাদেশ ট্যুরিষ্ট পুলিশের এসপি দেওয়ান লালন আহমেদ বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) দুপুরে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ‘জন্মিলে মরিতে হবে’ এই কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু দেওয়ান লালনের মৃত্যু আমাদের হতবাক করেছে। শুধু পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নয়, লেখক, গীতিকার হিসেবেও তিনি ছিলেন বিশেষ প্রতিভার অধিকারী। ৪৪ বছর বয়সী এই অকাল প্রয়াত মানুষের শোক গাঁথা রচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। যদিও শোকাতুর চিত্তে আমি আমার অনুজপ্রতিম লালন-কে নিয়ে লিখতে বসেছি। পুলিশের একজন অতিরিক্ত ডিআইজি কর্মকর্তা ড. ইকবাল আমাকে যখন এই দুঃখজনক খবরটি দিলেন আমি সাথে সাথে একটা কথাই ভাবছিলাম- এরকম অল্প বয়সী ও প্রতিভাধর, দায়িত্বশীল মানুষদের আমরা বাঁচাতে বা বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না কেন? 

আমার জানামতে, লালনের উচ্চ রক্তচাপ ছিল ও তাঁর ডায়াবেটিস ছিল অনিয়ন্ত্রিত। আমি এসব নিয়ে তাঁকে প্রচুর বকাঝকা করেছি (সে অধিকার আমার ছিল)। পেশাগত কারণে লালন দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে ছিল; গত চার বছর তাঁর পোস্টিং ছিল খুলনায়। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কারণে তাদের তাঁর কাছে নিয়ে রাখতে পারেনি। ফলে পরিবারের সান্নিধ্য ও সম্পর্কের আনন্দে সে উপস্থিত থাকতে পারতো না। সরকারী চাকুরীর নিয়ম মেনে সে এই অবস্থান রক্ষা করে কর্তব্যকাজে সামান্য শৈথিল্য দেখিয়েছে বলে আমি অন্ততঃ মনে করি না। তাঁর বিভাগের চোখে তাঁকে দেখার সুযোগ আমার ছিল না কিন্তু পুলিশের চাকুরীর বহিরাঙ্গনের যেই লালন আমার সাথে নানা আলোচনায় বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ আর এই স্বাধীন দেশের জন্যে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তাঁর করণীয় কী সেটাই বুঝতে চেয়েছে দিনের পর দিন, সেখানেও সে ছিল একশত ভাগ খাঁটি। আমি আমার ক্ষুদ্র জগতের ভাবসঙ্গে লালনের জন্যে একটি ভালোবাসা তুলে রেখেছিলাম যার পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশের আগেই সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আর সে প্রস্থান একটি অমীমাংসিত আক্ষেপের সাথে আমাকে মেনে নিতে হয়েছে। জানাজায় আমিও ছিলাম। বিউগলের সম্মানের সাথে পুলিশের আইজি মহোদয় যখন দেওয়ান লালনের শবদেহের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রথা অনুযায়ী কুর্ণিশ করছিলেন, আমার মনে হলো লালন তাঁর প্রাপ্যের সবটুকুই পেয়ে গেল।  

কিন্তু আমাদের আক্ষেপ অন্য জায়গায়। দেওয়ান লালনের মতো দায়িত্বশীল মানুষেরা যদি উচ্চ রক্তচাপে ভুগে বা তাঁদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে সেটা দূর করতে আমাদের যথাযথ করণীয় কি সেটা ঠিক করে নিতে পারছি না কেন? এসব অসংক্রামক রোগ তো একদিনে হয়না। শরীরে দানা বাধতে সময় নেয় কিন্তু সেই শরীরের খবর আমরা রাখিনা কেন? অনেকেরই মনে আছে, শাশুড়ির চিকিৎসা করাতে সিঙ্গাপুর যেয়ে হুমায়ুন আহমেদ নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালেন আর গুরুতর পর্যায়ে চলে যাওয়া ক্যান্সারের খবর পেলেন। এরকম শত শত উদাহরণ আছে ক্যান্সার, কিডনি, মস্তিস্কের রক্তক্ষরণ আর হৃদরোগের। এসবের খবর যখন পাওয়া গেছে তখন আর কিছুই করার থাকে না আর এ-ও জানা যায় এসবের সাথেই উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের সম্পর্ক আছে। যে সবের পরিণতি আমাদের অনেক সুনামধারী মানুষজনকে বিনা অপরাধে পৃথিবী থেকে অকালে তুলে নিয়েছে। এই সেদিন ক্যান্সারে ভুগে চলে গেলেন অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ ও সুরকার আলম খান। যে বয়সে এসে মানুষের পরিপূর্ণ দেবার কথা সমাজে, দেশে ও পরিবারে, সে বয়সে এসব বোঝা রোগে কেনই বা আমাদের মরতে হচ্ছে!

এর কারণ বোঝা সহজ- ‘অবহেলা’। আমরা বেশি মনযোগী মনের আনন্দের জন্যে, শরীরের নয়। অথচ এই শরীর ছাড়া আপনার-আমার কোনই মূল্য নেই। না তাগিদের, না কর্তব্যের। বছরে একবার শরীরটা দেখে নিলে কী হয়? সারা বছর তো মন নিয়ে পরেই থাকি, একবার না হয় শরীরের দিকে তাকাই- রক্তের একটা সিবিসি বা কাউন্ট করে দেখা কোথাও কোন অনিয়ম হচ্ছে কী না আর একটা এক্স-রে, বুকের ভেতরটা ঠিক আছে কী না সাথে একটা পেটের আল্ট্রাসাউন্ড, মেয়েরা স্তনের একটা আল্ট্রাসাউন্ড করবেন। সব মিলিয়ে খরচ হবে হাজার চারেকের মতো। আজকাল ঘরে বসে রক্তচাপ, রক্তে শর্করার মাত্রা সবই দেখে নেয়া যায়। কেন আমরা এ কাজগুলো করিনা? শেষে তো আর সময় থাকে না, পুরো পরিবার, দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যে একটা দায়ের বোঝা রেখে যাই, এটা কি আমাদের নাগরিকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে?

দেওয়ান লালন আহমেদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তাঁর বইয়ে আছে পিতার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শনে শুনেই সে দেশকে ভালোবেসেছে। তাঁর গানে আছে ‘মা আর মাতৃভূমি’ কেমন করে এক হয়! তাঁর বন্ধুদের হাহাকারে আছে হারিয়ে ফেলার শিশুকালের কষ্ট। এমন হবার কথা ছিল? কত পাখিদের গান এসে ভর করতে পারতো যদি দেওয়ান লালন আর কিছুদিন সময় দিতো, কত দায় এই সমাজের শৃঙ্খলার জন্যে, লালন সে কর্তব্যের মাথা উঁচু করে দিতে পারতো তাঁর সহকর্মীদের জন্যে। সামান্য একটা শরীরের অসুখ মায়ের সাথে দু’টি অবুঝ শিশু সন্তানদের নিথর করে দিয়েছে। 

তবুও আমি আমার স্নেহ, ভালোবাসা, সাধুভক্তি সব ফেলে চলে যাওয়া লালনের উদ্দেশ্যে রাতজাগা পাখিদের কানে কানে বলি-
“সেই ধন্য নরকুলে,
লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্ব্বজন”

সবাই জানুক দেওয়ান লালন সেই দলের একজন ‘মানুষ’ ছিলেন। তাঁকে আমরা কখনোই ভুলবো না।

ই-মেইলঃ rezasalimag@gmail.com


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭