ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

রনিল বিক্রমাসিংহে সুবিধাবাদী, নাকি ত্রাণকর্তা


প্রকাশ: 24/07/2022


Thumbnail

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। দেশটির আইন অনুসারে ক্ষমতায় থাকবেন ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। তবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি দেশের ভেঙ্গে পড়া অর্থনৈতিক অবস্থা কিভাবে পুনরুদ্ধার করবেন সেটাই এখন সবত্র আলোচিত।

নির্বাচিত হওয়ার পর রনিল বিক্রমাসিংহে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে বিভেদ দূর হয়েছে। আমাদের এখন একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ তবে রনিলের এ বক্তব্য মানতে নারাজ দেশটির সাধারণ মানুষ। তাঁদের ভাষ্য, সরকার থেকে হটানো রাজাপক্ষে পরিবারকে রক্ষা করতেই ক্ষমতায় আনা হয়েছে রনিলকে। 

এদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই বিক্ষোভকারীদের শক্ত হাতে দমন করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রনিল। বলেছেন, ‘যদি আপনারা সরকার পতনের চেষ্টা করেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখলের চেষ্টা করেন, এটা কোনো গণতন্ত্র হবে না; বরং আইনবিরোধী হবে। আমরা এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী শক্ত পদক্ষেপ নেব।’

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষক অ্যালান কেনান বলেন, গত কয়েক মাসে রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গে রাজাপক্ষে পরিবারের সম্পৃক্ততা তাঁর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নিজের গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা হলেও বাঁচিয়ে রাখতে রনিলের উচিত নির্বাহী প্রেসিডেন্টের পদ বিলুপ্ত করতে সংবিধান সংশোধনে সমর্থন ও সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশ দেওয়া।

বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রনিল বিক্রমাসিংহের উদ্দেশে এই গবেষক বলেন, নতুন প্রেসিডেন্ট যে বুকে দেশের স্বার্থই ধারণ করছেন, সে বিষয়ে বিক্ষোভকারীদের আশ্বস্ত করতে রনিলকে অনেক কাজ করতে হবে।

২০১৭ সালে রনিল ক্ষমতায় থাকাকালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বেশ উন্নতি হয়েছিল। সে বছর ছয় দশক পর প্রথমবারের মতো দেশটিতে সরকারি ব্যয়ের চেয়ে রাজস্ব আয় বেশি হয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে চীনকে সঙ্গে নিয়ে ভালো কাজ করেছিলেন রনিল। তখন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গেও তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। ভারতের সঙ্গেও গড়ে তুলেছিলেন উষ্ণ সম্পর্ক।

গত মে মাসে ক্ষমতায় আসার পরও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য ধরে রেখেছেন রনিল। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি চীন ও ভারতের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমাদের পক্ষ নেননি তিনি।

তবে ক্ষমতা ধরে রাখতে রনিল সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে। এমনই একজন শ্রীলঙ্কাভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ফ্যাকটামের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক উদিতা দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, রনিল একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক। সংসদীয় রাজনীতির খুঁটিনাটি বোঝেন। বিভিন্ন পরিস্থিতি নিজের সুবিধার জন্য কাজে লাগিয়ে দেখিয়েছেন তিনি।

২০১৫-১৯ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেও রনিলের বিরুদ্ধে রাজাপক্ষে পরিবারকে রক্ষায় কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। উদিতা দেবপ্রিয় বলেন, ২০১৫ সালে রনিল যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন রাজাপক্ষে পরিবারকে ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত একটি পরিবার হিসেবে দেখা হতো। তিনি রাজাপক্ষেদের সাজার মুখোমুখি করার আদেশ দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার সময় এলে থেমে যান।

রনিল সরকারের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত রনিলের সঙ্গে কাজ করেছিলেন শিরাল লাখথিলাকা নামের একজন আইনজীবী। তিনি বলেন, সে সময় যদি কেউ রনিলের বন্ধু হতেন, তাহলেই তাঁকে সরকারি পদে দেখা যেত। এটা স্বজনপ্রীতি।

এদিকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট রনিল সামাল দিতে পারবেন না বলে বিশ্বাস করেন দেশটির ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির শিক্ষাসচিব পুবুদু জায়াগোদা। এর জন্য তিনি দায়ী করেছেন গত চার দশকে দেশটিতে কার্যকর করা আর্থিক নীতিকে। আল-জাজিরাকে জায়াগোদা বলেন, ‘সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারীকরণের মধ্য দিয়ে আমরা জ্বালানির ওপর আমাদের সার্বভৌমত্ব হারিয়েছি। জাতীয় সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়াও এর জন্য দায়ী।’

ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির এই রাজনীতিক বলেন, ‘আমি পুরোপুরি মৃত কোনো অর্থনীতির কথা বলছি না। আমাদের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তবে আমি মনে করি, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে জ্বালানি খাতের।’

রনিলকে নিয়ে আরেকটি সমালোচনা রয়েছে যে তিনি তাঁর দল ইউএনপির নতুন নেতাদের বেড়ে ওঠার সুযোগ দেননি। ২০১৯ সালে তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় জ্যেষ্ঠ নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা ইউএনপি ছেড়ে নতুন দল গড়ে তোলেন।

২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রেমাদাসার প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হয়নি। ওই সময় রনিল ও প্রেমাদাসা বিভিন্ন নীতিগত বিষয়ে প্রকাশ্যে ঝগড়ায় জড়ান।
এ অভিজ্ঞতায় এমন ধারণা জন্মে, সাজিথের পরিবর্তে রনিল বেছে নিয়েছিলেন গোতাবায়াকে। কেননা যদি সাজিথ প্রেসিডেন্ট হতেন, তবে রনিলকে তাঁর অধীন কাজ করতে হতো, বলেন ফ্যাকটামের উদিতা দেবপ্রিয়।

কিন্তু ওই পদক্ষেপ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রনিলের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর দল ইউএনপি ২০১৯ সালের নির্বাচনে দলটির ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ পরাজয় বরণ করে।

ক্ষমতায় থাকাকালে রনিল বুর্জোয়া হয়ে ওঠেন, এমন অভিযোগও রয়েছে। যদিও তিনি তা নাকচ করে দেন।

তবে দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়ানো রাজাপক্ষেদের মতো রনিল যেমন জনতুষ্টিকর কোনো প্রস্তাব রাখতে পারেননি, তেমন জনগণকে খেপিয়েও তুলতে পারেননি। উদিতা বলেন, ‘রনিল দেশের জনগণের অনুভূতিতে টোকা দিতে সক্ষম হননি। আর এটাই রনিল ও যাদের (রাজাপক্ষেদের দল) আশীর্বাদে তিনি এখন প্রেসিডেন্ট, তাদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় ফারাক।’

‘ইউএনপির জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করার ইতিহাস রয়েছে। ১৯৭৭ সালে জয়াবর্ধনে একটি মুক্ত স্বাধীন অর্থনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেননি; বরং এসেছিলেন একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে,’ বলেন বিশ্লেষক উদিতা দেবপ্রিয়।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭