ইনসাইড বাংলাদেশ

লক্ষ্মীপুরে সরকারি বীজতলায় আগ্রহ কম, বেসরকারি নার্সারির বিপ্লব


প্রকাশ: 24/07/2022


Thumbnail

গ্রাম কিংবা শহরে আড়া ও বাগান তৈরি ছাড়া লক্ষ্মীপুর জেলায় কোন নতুন বাড়ি তৈরির কল্পনাই করা যায় না। ফলে চারাগাছের চাহিদা থাকায় জেলার প্রতিটি বাজারে সারা বছরই হাটের দিন কিংবা ভ্যানে ফেরি করে চারা গাছ বিক্রি হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। চাহিদা মিটাতে গিয়ে জেলার ৫ উপজেলা জুড়ে রয়েছে গড়ে উঠেছে অসংখ্য নার্সারি। এসব নার্সারিতে বছরে প্রায় দুই কোটি বিভিন্ন প্রজাতির চারা গাছ উৎপাদন ও বিক্রি হয়। যার গড় বাজার মূল্য একশো কোটি টাকার বেশি। এ সবুজ বিপ্লবে জেলার তিন হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দিন দিন বেসরকারি নার্সারি ব্যবসা সম্প্রসারণ হচ্ছে। নার্সারি ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

এসময় নার্সারি মালিক ও চারা গাছ ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কাঠ ও অর্থকরী ফল উৎপাদনে লক্ষ্মীপুরে নীরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে বেসরকারি নার্সারিগুলো। তবে স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানিয়েছে, লক্ষ্মীপুরে বেসরকারি নার্সারির রমরমা উৎপাদন ও ব্যবসা থাকলেও আগ্রহ কম জেলার এক মাত্র সরকারি নার্সারি লক্ষ্মীপুর বীজতলা কেন্দ্রে।

চারা গাছের গ্রাহক, জেলার সচেতন মানুষ এবং নার্সারি মালিকদের দাবি, বেসরকারি নার্সারিগুলোতে সরকারি সংস্থার মাধ্যমে উন্নত মানের কাঠের বীজ ও ফলের বীজ এবং মাতৃগাছ সরবরাহ করা গেলে আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে জেলায় মান সম্মত কাঠ ও ফল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারবে। নতুবা গাছে ভরপুর হলেও মানসম্মত কাঠ ও চাহিদানুপাতে ফল উৎপাদন সম্ভব হবে না।

স্থানীয় ভাবে তথ্য নিয়ে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলার প্রতিটি বাড়িতে কাঠ গাছ, বিভিন্ন জাতের ফলের গাছ এবং অর্থকরী ফল নারিকেল ও সুপারি বাগান রয়েছে। জেলার বহু উদ্যোক্তা বাণিজ্যিক ভাবে বরই, কমলা, মাল্টা, আম, পেয়ারা, ড্রাগন চাষ শুরু করেছেন। জেলায় কাঠের চাহিদা বড় একটি অংশ নিজস্ব উৎপাদিত কাঠ থেকে মেটানো হয়। কাঠ বাগান ও ফল বাগানের গাছের চাহিদা মেটায় স্থানীয় নার্সারিগুলো। এসব নার্সারিতে প্রাকৃতিক বনের বীজ ও উন্নত ফলের বীজের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও সরকারি সংস্থা ছাড়া সেগুলো পাওয়া যায় না।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালালবাজার এলাকার সুন্দরবন নার্সারিতে প্রবেশ করতেই মনে হলো যেন সত্যিকারের সুন্দরবন। হাজার হাজার গাছের চারায় কানায় কানায় ভর্তি সুন্দরবন নার্সারির প্রতি ইঞ্চি জায়গায়। ক্রেতাদের ভিড় সারাক্ষণ লেগেই ছিল।

সুন্দরবন নার্সারির মালিক মোঃ মামুনুর রশিদ জানান, প্রায় তিন একর জায়গায় তিনি বছরে অন্তত পাঁচ লাখ গাছের চারা উৎপাদন ও বিক্রি বিক্রিতে ১০-১২ জন মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। সুন্দরবন নার্সারিতে সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে ফল গাছের চারার। এছাড়া তিনি মেহগনি, সেগুন, গর্জন, আকাশমণি নামের কাঠের চারা এবং অর্থকরী ফল নারিকেল ও সুপারিগাছের চারাও উৎপাদন করেন। এ নার্সারিতে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার চারা গাছ বিক্রয় হয় বলে জানান তিনি।

একই এলাকার মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে উপকূলীয় বন বিভাগ নোয়াখালীর অধীন লক্ষ্মীপুর বীজ তলা কেন্দ্র নামের একটি সরকারি নার্সারিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির পুরো এলাকা ঝোপ জঙ্গলে পরিপূর্ণ পুরো ভুতুড়ে পরিবেশ। লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার দালাল বাজার এলাকায় ৪ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত এ নার্সারি।

এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আলা উদ্দিন সাজু (৪২) জানায়, ছোট বেলা দেখেছি এ নার্সারি থেকে লাইন দিয়ে মানুষ চারা গাছ কিনতো। কিন্তু গত প্রায় একযুগ যাবত তিনি এ নার্সারিতে চারা উৎপাদন হতে দেখেননি।

সাজু জানান, বৃহৎ জায়গায় দখল করে থাকা সরকারি নার্সারিটি এখন মুমূর্ষু। কিন্তু বছরে কমপক্ষে ৫ লাখের অধিক চারা গাছ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এ অবস্থা কেন এমন প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির রেঞ্চ কর্মকর্তা চন্দন ভৌমিক জানায়, লক্ষ্মীপুর বীজ তলা কেন্দ্রে তিনটি ভবন, ৬ জন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে কিছু চারা গাছ উৎপাদন হয় বলে তিনি দাবী করলেও স্থানীয় কয়েকজন এলাকাবাসীর অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে জেলাবাসীর কোন উপকারে আসছে না।  

সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ থানার সামনে মায়ের দোয়া আল আমিন নার্সারি। প্রায় সাড়ে তিন একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত এ নার্সারিতে দেশীয় ফলের পাশাপাশি বিদেশী জাতের অনেক ফল গাছের চারা উৎপাদনও বিক্রি করা হয়। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারতের কেরালা নারিকেলের চারা উৎপাদন হয় সেখানে। আছে বারমাসি কাঁঠাল, আমড়া, জাম, কামরাঙাসহ অনন্ত ২৫টি বারমাসি ফল গাছের চারা। নার্সারির মালিক নুর উদ্দিন (৬৫) জানান, তার নার্সারিতে বর্তমানে প্রায় একলক্ষ ফল গাছের চারা রয়েছে, যেগুলোর বাজার মূল্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানে ২৫ জন শ্রমিক রয়েছে যাদের মাসিক বেতন ৩ লাখ টাকার মতো। নার্সারি ব্যবসায় ৩২ বছরের অভিজ্ঞ এ ব্যক্তি জানান, তিনি নিজ উদ্যোগেই বিদেশী ও দেশী উন্নতমানের ফলের বীজ সংগ্রহ করে চারা উৎপাদন সরাসরি নার্সারিতে, বিভিন্ন বাজার ও ছোট নার্সারির নিকট তিনি চারা বিক্রি করেন। বীজ সংগ্রহ ও চারা বিপণনে তিনি কখনো সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কোন পরামর্শ পাননি।

তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন বৃক্ষরোপণ অভিযানের কারণে লক্ষ্মীপুরে প্রচুর গাছ রোপণ হয়েছে। তার মতে, এখন দরকার উন্নত মানের ফল ও কাঠের গাছ রোপণ করা। আর মানসম্মত কাঠের বীজ ও ফলের বীজের জন্য বন গবেষণা কেন্দ্র কিংবা সরকারি অন্য কোন সংস্থার মাধ্যমে নার্সারি মালিকদের বীজ বিক্রি জরুরী বলে জানান তিনি।

সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ এলাকায় জামাল নার্সারি। প্রায় ৫ একর জমিতে এ প্রতিষ্ঠান এ বছর প্রায় ২ লাখ চারা উৎপাদন করেছে। সবগুলোই কাঠ গাছের চারা। জামাল উদ্দিন জানান, তিনি স্থানীয় ভাবে সংগ্রহ বীজ থেকে শুধু কাঠ ও সবজি চারা উৎপাদন করেন। মেহগনি, সেগুন, আকাশমণি, চাপালিশ এবং কড়ই জাতীয় কাঠগাছের চারা তিনি উৎপাদন করেন।  তিনি জানান, বন গবেষণা ইনস্টিটিউট বা অন্য কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যদি বীজ সংগ্রহ করা যেত তাহলে ভালো মানের কাঠ গাছ তিনি সরবরাহ করতে পারতেন। কিন্তু এখন স্থানীয় বীজে ভালো কাঠের গাছ তারা দিতে পারছে না। এতে দেশেরই ক্ষতি হচ্ছে। তার দাবী স্থানীয় ভাবে সংগ্রহ বীজে উন্নত কাঠ ও বারমাসি ফল আশা করা যায় না।

একই এলাকার কবির ব্রিকস ফিল্ড মাঠে গড়ে উঠেছে আনোয়ার নার্সারি। মালিক মোঃ মোরশেদ আলম জানায়, তার নার্সারিতে শুধুমাত্র ফুল ও ফল গাছ উৎপাদন করেন তিনি। এক একর জমিতে গড়ে উঠা এ নার্সারিতে বর্তমানে প্রায় আড়াইশ জাতের ৫০ হাজার ফুল গাছ রয়েছে। খুচরা বিক্রির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন বাসাবাড়ি সাজানো, অফিস সাজানো এবং ছাদ বাগান তৈরি করার চুক্তিতে করে থাকেন। এ নার্সারিতে তার ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।  

কমলনগর উপজেলার করইতোলা এলাকার মায়ের দোয়া নার্সারির মালিক আনোয়ার জানায়, নার্সারিতে ব্যবহারের জন্য এ বছর ৫ হাজার ঘনফুট মাটি সংগ্রহ করেছেন। বর্তমানে মাটির দাম, প্লাস্টিক প্যাকেট, সার, কীটনাশক ও কর্মচারীদেরও মজুরি মূল্য বেশি হওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তিনি আরো জানান, তারা স্থানীয় ভাবে সংগৃহীত কাঠ ও ফলের বীজ থেকে চারা উৎপাদন করেন। কিন্তু সবজি বীজ উৎপাদনে বিভিন্ন কোম্পানির বীজ কিনে তা থেকে চারাগাছ উৎপাদন করেন। তিনি অভিযোগ করে জানান, বিভিন্ন বাজারে গাছের চারা বিক্রির জন্য তারা নিদিষ্ট জায়গা পান না। বিভিন্ন বাজারে তাদের থেকে বেশি খাজনা নেয়। এসব কারণে তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তিনি গাছের চারা বিক্রির জন্য টোল ও খাজনা মুক্ত সুবিধা চাচ্ছেন।

লক্ষ্মীপুর বীজ তলা কেন্দ্রের কর্মকর্তা চন্দন ভৌমিক জানায়, জেলায় কতটি নার্সারি রয়েছে সে বিষয়ে তাদের নিকট কোন তথ্য নেই।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোঃ জাকির হোসেন জানায়, জেলা কৃষি বিভাগ থেকে প্রায় ১শ ২০টি নার্সারি লাইসেন্স নিয়েছে।

লক্ষ্মীপুর জেলা নার্সারি মালিকদের অন্যতম নেতা নুর উদ্দিন জানায়, জেলা প্রায় দেড় শতাধিক বেসরকারি ও একটি সরকারি নার্সারি রয়েছে। বেসরকারি নার্সারি গুলোতে বছরে কমপক্ষে ২ কোটি কাঠ, ফল,ফুল এবং সবজি চারা উৎপাদন করা হয়। যেগুলোর বাজার মূল্য কমপক্ষে একশো কোটি টাকা। এ ব্যবসায় ৩ হাজারের মতো মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে । স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত বীজ থেকেই নার্সারি মালিকরা চারা উৎপাদন করে থাকে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭