ইনসাইড থট

মহিবুর রহিম বাবুল- আমাদের কালের এক অভিমানী সংগঠক


প্রকাশ: 25/07/2022


Thumbnail

সত্তুর দশকের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ও পরবর্তী জীবনে আওয়ামী লীগের এক প্রতিশ্রুতিশীল কর্মী ছিলেন মহিবুর রহিম বাবুল যার কথা আজকাল অনেকেই ভুলে গেছেন। লক্ষ্মীপুরের এক রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য আমাদের প্রিয় বাবুল ভাইয়ের আজ ২৫ জুলাই একাদশতম মৃত্যু বার্ষিকী। ২০১১ সালের এইদিনে ক্যান্সারে আক্রান্ত মহিবুর রহিম বাবুল আমাদের ছেড়ে চলে যান। একজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষের প্রস্থান যতোই কষ্টের হোক, আমাদের তা মেনে নিতে হয়েছে কিন্তু তাঁকে বছরে একবার স্মরণ করবো না এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত ছিল।

মহিবুর রহিম বাবুলের বাবা মরহুম জিল্লুর রহিম বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন ছিলেন ও বৃহত্তর নোয়াখালীর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে লক্ষ্মীপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আজন্ম আওয়ামী লীগের সমর্থক এই পরিবারের সকল সদস্য নিজেদের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত করে রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছেন। জিল্লুর রহিম সাহেবের বড় ছেলে সমাজসেবক ও আইনজীবী মরহুম কামালুর রহিম ছাত্র জীবনে রাজনীতিতে যোগ দেন ও চৌমুহনী কলেজের ছাত্র-সংসদের নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন; পরবর্তীতে নোয়াখালী বারের ৫ বার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাবুল ভাইয়ের ছোট দুই ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। এক ভাই মিজানুর রহিম বর্তমানে লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, আর এক ভাই হাসিবুর রহিম ছাত্রলীগের সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

মহিবুর রহিম বাবুল ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ১৯৭৭ সালের শেষের দিকে যখন আমি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসি। আমার বন্ধু জাফর ওয়াজেদ (বর্তমানে পি আই বি-র মহাপরিচালক) আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাবুল ভাইয়ের নাম আমাদের কাছে পরিচিত ছিল কারণ তিনি লেখালেখি করতেন ও ’৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পৈশাচিকতার পরে জাফর ওয়াজেদ ও বাবুল ভাই অসংখ্য গোপন প্রতিবাদী রচনা ও বক্তব্য চিঠি ও লিফলেট আকারে নানা জায়গায় পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। সেসব লিফলেটের নীচে লেখা থাকতো ‘মহিবুর রহিম বাবুল কর্তৃক প্রচারিত’। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তখন তাঁর একটি অসাধারণ সাহসী প্রকাশনা ‘আমি তোমাদেরই লোক’ ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। জিয়াউর রহমানের কারফিউ সময়ের সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানাতে যেয়ে বাবুল ভাই পুলিশি নির্যাতনের মুখে পড়েন ও শহীদ মিনার থেকে গ্রেফতার হন। এই বিষয়টি আমাদের মধ্যে যথেষ্ট আলোড়ন তৈরি করেছিল তাই বাবুল ভাইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছিলাম ও তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই সৌভাগ্য আমার জীবনে গেঁথে ছিল। এখনও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয় কারণ বাবুল ভাই আমাদের কালে শুধু একজন সংগঠক বা ছাত্রনেতাই ছিলেন না তিনি ছিলেন একজন সংবেদনশীল উচ্চ মাপের মানুষ। তাঁর সততা ও নিষ্ঠার জন্যে তিনি আমাদের ভক্তি অর্জন করেছিলেন বিশেষ করে আমি, জাফর ওয়াজেদ ও রাগেবুল আহসান রিপু (বর্তমানে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) যথাসম্ভব বাবুল ভাইয়ের সান্নিধ্য পেতে আগ্রহভরে ক্যাম্পাসে অপেক্ষা করতাম।। আমার ছাত্র জীবনে ১৯৭৯, ‘৮০ ও ‘৮২ সালে পর পর তিনটি ডাকসু নির্বাচন হয় যেখানে বাবুল ভাই ছাত্রলীগের জয়ের জন্যে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন যদিও সে সময়ে ছাত্রলীগ পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ ছিল ছিল বহুমুখী। ১৯৮১ সালে তিনি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হলে তাঁর রাজনৈতিক ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আমার খুব মনে আছে ১৯৮৩ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক হয়ে সে সম্মেলন সফল করতে তিনি দিবারাত্র অমানুষিক পরিশ্রম করেন তাঁর ছায়াসঙ্গী জাফর ও রিপুকে নিয়ে।    

এই বাবুল ভাই ১৯৮৬ সাল থেকে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ব্যাক্তিগত সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ডের অন্যতম সহকারী ছিলেন বাবুল ভাই। ’৭৫ পরের রাজনীতির নানারকম সমীকরণ ও ষড়যন্ত্র কোন কিছুই তাঁকে টলাতে পারেনি। শেখ হাসিনার প্রতি অসীম আনুগত্য তাঁকে আমাদের কাছে একজন আদর্শবান ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর মর্যাদায় তুলে ধরেছিল।

১৯৯১-৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি লেখালেখি ও পত্রিকা সম্পাদনার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। ‘প্রতিশ্রুতি’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। মূলত মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ধারার মূল্যায়নধর্মী রচনাই সে পত্রিকায় প্রকাশ করতেন। পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রাঞ্জল ভাষা-কৌশলের কলাম রচনাগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর অন্যতম গ্রন্থ 'বঙ্গবন্ধুঃ দ্বিতীয় বিপ্লবের আদর্শ' আমাদের জন্যে ছিল একটি প্রেরণাদায়ক বই যা সে সময়ে বঙ্গবন্ধু অনুসারিদের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াতো। আমার বিশ্বাস সাহসী এই মহিবুর রহিম বাবুল-কে অন্তত ‘আমি তোমাদেরই লোক’ প্রকাশনার জন্যে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ইতিহাস স্মরণ করা উচিত।

রাজনীতির কাছে বাবুল ভাইয়ের কিছু চাইবার ছিল না যদিও নানা সময়ে তিনি কূট-কৌশলের কাছে পরাস্ত হন। তাঁর পিতার ধানমন্ডি বাড়ি, লক্ষ্মীপুরে পিতৃসূত্রের অগাধ জমিজমা কোন কিছুই এই নির্লোভ মানুষটিকে আকৃষ্ট করেনি। সংসারীও হতে পারেননি। অভিমানে ও কষ্টে ‘৯৫ সালে তিনি তাঁর ছেলে অভি-কে নিয়ে দেশান্তরী হন। কানাডায় ছিলেন ও সেখানে গড়ে তুলেন ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার বাস্তবায়ন কমিটি’ যার আহবায়ক হিসেবে উত্তর আমেরিকায় জনমত গড়ে তুলতে আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন। ২০০৯ সালে কানাডায়ই তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ে ও ২০১১ সালের আজকের এই দিনে তিনি লোকান্তরিত হন।

আজ আমার অগ্রজসম এই অনুপ্রেরকের জন্যে আমার বিনীত শ্রদ্ধার্ঘ্য! 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭