ইনসাইড থট

লী কুয়ানের দেশে


প্রকাশ: 30/07/2022


Thumbnail

'If government workers are adequately paid,
they deserved to be punished with severe penalties when they take bribes'. 
-- LKY
প্রথমবার সিঙ্গাপুরে যাই ২০১১ সালে। বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (BPATC)'র প্রশিক্ষণার্থী দলের সদস্য হয়ে। চাকরির মাঝামাঝি সময়ে এসে MAT ( Management Aptitude Test) কোর্সের একজন  অংশগ্রহনকারী হিসেবে। এতে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত কয়েকজন জেলা প্রশাসকও অংশ নিয়েছিলেন। আমি ছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার জেলাপ্রশাসক। 

তখন শরৎকাল। আকাশে সাদা মেঘের খেলা। আবহাওয়া আমাদের জন্য বেশ সহনীয়। দীপাবলি বা দেওয়ালি পার্বনে সিঙ্গাপুরে ভারতীয়দের অভয়ারণ্য খ্যাত লিটল ইন্ডিয়া অপরূপ রপে সজ্জিত হয়ে আছে। আশ্বিন মাসের ত্রয়োদশীতে শুরু হয়। এটি হিন্দু ধর্মীয় উৎসব হলেও জৈন এবং শিখরাও এতে অংশ নেয়। যাকে বলে লাল নীল দীপাবলি। সমগ্র সেরাঙুন (serangoon) রোডের দু'পাশে চোখ ঝলসানো আলোকসজ্জায় অভিভূত হয়েছিলাম। বিদ্যুতের এমন বর্ণিল আয়োজন ইতোপূর্বে আর কোথাও দেখি নি। লিটল ইন্ডিয়ায় দক্ষিণ ভারতের তামিল বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ীদের আধিপত্য নজরে পড়ার মতন। তারাই ফি বছর এ দীপাবলির আয়োজক। একই সড়কে অবস্থিত 'ব্রডওয়ে নামের একটি মাঝারি মানের হোটেলে আমরা উঠি। আমার রুমমেট সহকর্মী ও বন্ধু মুকুল। সে তখন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক। সপ্তাহতিনের আনন্দঘন ছুটাছুটি আর সময়ের সঙ্গে সারাক্ষণ প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার বিড়ম্বনাও নেহায়েত কম ছিল না। এক ছুটির দিনে নাস্তার টেবিলে হঠাৎ সিদ্ধান্ত হল-- মুকুল বললো, চল পুরোটা ঘুরে দেখা যাক। প্রায় সাত শ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট নগর রাস্ট্র এটি। টেক্সিতে বসলে প্রান্ত রেখায় পা রাখতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না। আমরা দু'জন তা-ই করলাম। ঘন্টা দেড়েক পরেই মালয়েশিয়ার সীমান্ত ঘেঁষে দীর্ঘ সংযোগ সেতুটি কাছে গিয়ে দেখলাম। অন্য প্রান্তে অল্পবিস্তর ফসলের জমি থাকলেও খুবই গুরুত্বহীন মনে হয়েছে। মুকুল বললো দ্যাখ, একটাও ফলের গাছ পাবা না এখানে। লী কুয়ান নাকি একবার ফরমান করেছিলেন,' ফলের গাছে পাখি আসবে আর এদের বিষ্ঠায় রাস্তা ও পরিবেশ বিনষ্ট হবে। যেখানে ৫০ লক্ষেরও কম মানুষের দেশ, আমরা এসব উৎপাদন করে সময় নষ্ট করবো কেন? এগুলো করবে পার্শ্ববর্তীরা। আমাদের থাকবে প্রযুক্তি আর অঢেল  অর্থ। সকাল বেলা সব তরতাজা জীবন্ত ফলফলাদি,পানীয়জল পাউরুটি, মাছ,সবজি ঘরে পৌঁছে যাবে। আমরা বসে থাকব বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার উচ্চতর শিখরে। পৃথিবী অবাক তাকিয়ে দেখবে'। আজ এতদিন পরে আধুনিক বিশ্ব মনে হয়  তা'ই দেখছে। 

২) পুরো সময়টা মুকুল ডুবেছিল সিঙ্গাপুরের রূপকার ও কিংবদন্তি রাস্ট্রনায়ক তথা লৌহমানব Lee Kuan Yew এর আত্মজীবনীমূলক  From Third World to First : The Singapore story, 1965 - 2000 বইটি নিয়ে। বেডে শুয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ পড়ে পড়ে সে আমাকে শোনাতো। বইয়ের নানা পৃষ্ঠায় তার হাতের আন্ডার লাইন করা অংশ আমিও পাঠ করে ভীষণ উজ্জীবিত বোধ করেছিলাম। যদিও পরবর্তীতে লী'র আরও দুয়েকটি বই আমার হাতে এসেছিল।  The Wit & Wisdom Of Lee Kuan Yew বইটা আমার স্নেহভাজন ও অনুজ সহকর্মী রাশেদ চৌধুরী   সিঙ্গাপুর থেকে এনে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। লী কুয়ানের একটি কথা স্মরণে রাখার মত, "আমি বলছিনা আমি যা কিছু করেছি সবই ঠিক, কিন্তু আমি সব কিছুই করেছি একটা মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য "। লী মূলতঃ আধুনিক সিঙ্গাপুরের স্থপতি ও স্বাধীনতার মহানায়ক। বলা যায়, ১৯৫৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাস্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর দল People’s  Action Party ছিল উন্নয়নের নেপথ্যের মূল চিন্তক ও শক্তি। তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স (LSE) এবং ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে অর্থনীতি ও আইন শাস্ত্রে ডিগ্রিধারী ছিলেন। সৎ, সাহসী ও নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক নেতার আরেক নাম ছিল লী কুয়ান ইউ। উল্লেখ করা যায়, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বেশ অনুরাগী ছিলেন। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীকার আন্দোলনকে মনেপ্রাণে সমর্থন করতেন। 

৩) ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া পশ্চাৎপদ এক জেলে পাড়া (fishing village) হতে আজকের প্রায় ৯৪ হাজার সিং ডলারের মাথাপিছু আয়ের দেশ সিঙ্গাপুর। এবং সবই তাঁর যাদুকরী হাতের ছোঁয়ায় সম্ভব হয়ে উঠেছিল। ১৯২৩ সালে জন্মগ্রহণকারী এ নেতা ৯১ বছর বয়সে ২০১৫ সালে ২৩ মার্চ পরলোক গমন করেন। আশ্চর্য, একেবারেই কাকতালীয়। ২০১৫ সালের ঐদিনটিতে চাঙি এয়ারপোর্টের ট্র্যান্জিট যাত্রী হিসেবে আমি ট্রলি হাতে ঘুরছিলাম। যাব ইন চিয়ন এয়ারপোর্টে। দেখেছি শোকে আর বেদনায় প্রায় নিমজ্জিত সমগ্র জাতি। কর্মচারিরা সবাই কালোব্যাজ ধারণ করে আছেন। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতই সকলের কর্ম ব্যস্ততা। কোথাও বিরতি নেই। আবেগের লেশমাত্র নেই। এয়ারপোর্টের সর্বত্র ইলেকট্রনিক কালো ব্যানারের ওপর সাদা লেখায় ঝুলছে 'Tribute to Lee Kuan Yew'। সেদিন আরও একটি বিষয় সবিস্ময়ে দেখলাম, নিজের সন্তান দেশের সরকারপ্রধান অথচ এমন লিজেন্ডের চির প্রস্হানের দিনও ব্যতিক্রম কিছু নেই। 

৪) দ্বিতীয়বার সিঙ্গাপুরে যাই ২০১৬ সালে। সরকারের যুগ্মসচিব হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলাম।  তবে একান্তই পারিবারিক কারণে। স্ত্রী জেবু'র লিভারে একটা জটিলতা ধরা পড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে লিভার এনলার্জমেন্ট। আমাদের বন্ধুবর ও বরেণ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রফেসর মাহতাব আল মামুন (স্বপ্নীল) এর পরামর্শ নিয়ে সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত Mount Elizabeth Hospital এ যাই । সেবার সঙ্গে ছিল আমাদের ডাক্তার কন্যা মৌরিন। সে মা'র সহযাত্রী হল। চাঙি থেকে আমরা সোজা লিটল ইন্ডিয়ার কাছাকাছি Park Royal হোটেলে। পাশেই বহুল পরিচিত মোস্তফা সেন্টার। বিশ্ববিখ্যাত এ শপিংমলটি সংলগ্নে থাকায় কারণে অকারণে উঠানামা করে সময় পার করা যাবে। পরদিন যথাসময়ে সিঙ্গাপুরের অরচার্ড রোডে অবস্থিত পৃথিবীর বিখ্যাত মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে গিয়ে হাজির হই। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা, পেপার প্রদর্শন,বাংলাদেশের ডায়াগনোসিস সবই উপস্থাপন করা হল। পরামর্শ মতে প্রায় সব কিছুই নতুন করে শুরু করতে হবে। তবুও ডাক্তারদের আন্তরিকতা, ধৈর্যের সঙ্গে সময় দেয়া,শেষাবধি  শোনার সংবেদনশীলতা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। 
আমাদের অবস্থান করতে হবে এক সপ্তাহের মতন। 

ডাক্তারদের মতামত পাওয়া এবং মেয়েটা সফরসঙ্গী  থাকায় আমি বেশ নির্ভার হয়ে এক খন্ড বোহেমিয়ান সময় পেয়ে গেলাম। কখনো তিনজন কখনো একা গোটা লিটল ইন্ডিয়াব্যাপী বিক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরি করি। একবার খাবার একবার ঔষধ পানি ইত্যাদি কিনতে যাই। ডাক্তার জেবুর ওজন হ্রাস করতে বলায় প্রতিবার মাউন্ট ই তে যাবার সময় তার ইচ্ছের বিপক্ষেও তাকে অনেকটা পথ হাঁটাতে বাধ্য করি। অরচার্ড লিটল ইন্ডিয়া থেকে ৪ কিঃ মিঃ মতন হবে। 

৫) একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল হিসেবে মাউন্ট এলিজাবেথ ১৯৭৯ সালেই যাত্রা শুরু করে। ৩৫০ বেডের এ হাসপাতাল বেসরকারি ব্যবস্হাপনায় পরিচালিত। সিঙ্গাপুর সরকারের মেডিকেল কাউন্সিলের স্বীকৃতি নিয়ে মার্কিন কোম্পানি পার্কওয়ে
এটি চালায়। সিঙ্গাপুরে চায়নিজ বংশোদ্ভূত বৌদ্ধদের সংখ্যা প্রায় ৭১% হলেও মাউন্ট এলিজাবেথে বিদেশি চিকিৎসকের আধিপত্য নজরে পড়ে। পৃথিবীর নানা ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী এখানকার চিকিৎসক এবং কর্মচারিগন। জানা যায়, ৩১টি বিষয়ের ওপর বিখ্যাত চিকিৎসকগন কাজ করে চলেছেন। তবে হৃদরোগ, ক্যানসার, লিভার, কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্হাপনের কাজে তারা অনেককে ছাড়িয়ে গেছে। কেবল এশিয়া বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নয় ; এখন প্রায় সারা দুনিয়ার মানুষই একমুঠো উন্নততর স্বাস্থ্যসেবার প্রত্যাশায় এখানে এসে আশ্রয় নেন। আবার কেউ কেউ শেষ আশ্রয় নিয়েও চলে যায়। বলা হয়, সিঙ্গাপুরে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি হয় এ হাসপাতালেই। পুরো দোতলা জুড়ে বিরাট ডিসপেনসারি। শত শত প্রকার ঔষধের ছড়াছড়ি। দেখেছি, হাসপাতালটি ঘিরে প্রতিদিন শতশত অসুস্থ মানুষের বাঁচার কী মর্মস্পর্শী আকুতি। ট্রলি আর এম্বুলেন্সের নিরন্তর আগমন ও বহিঃগমনে অনেক সময় পারিপার্শ্বিকতায় নেমে আসে স্তব্ধতা ও বিষন্নতা। 

৬) আমাদের রোগীর জন্য উদ্বীগ্ন হওয়ার মত বিশেষ কোন বার্তা না থাকায় একটু ফুরসত পেলাম। স্বস্তির লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নেমে আসি। বেরিয়ে আসার সময় নিচ তলায় হঠাৎ মুখোমুখি বাংলাদেশ সরকারের একজন সচিবের সঙ্গে। তিনি খালি গায়ে ইটিটি কক্ষ থেকে বের হলেন মাত্র। '৮২ ব্যাচের এ কর্মকর্তা আমাকে দেখে বিস্ময়ভরা চোখে - আরে মান্নান এখানে যে? সংক্ষেপে বললাম সব কিছু। তিনি সরকারি কাজে এসে সময় নিয়ে নিজের প্রিয়তম দেহটার খোজ-খবর নিলেন। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। খুব নিরিবিলি সজ্জন ও সচেতন মানুষ তিনি। এ জন্যই বোধ করি, ভদ্রলোক আমার চয়েও অন্তত পাঁচ বছর বেশি চাকরি করেছেন। 

এবার কন্যার ইচ্ছেয় একে একে ম্যারিনা বে, স্যান্টুসা, আর্ট-সাইন্স মিউজিয়াম, মালয়েশিয়ার বর্ডার এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর পালা। মালয়েশিয়ার  সীমান্তের কাছে এক উন্মুক্ত জলাশয় জুড়ে অনেক মানুষের মাছ ধরার দৃশ্য অবলোকন করে অনেকটা সময় কাটাই। সারাদিন এদিক ওদিক কাটিয়ে আমাদের ভারতীয় ও বাঙালি খাবারের মূল ঠিকানা লিটল ইন্ডিয়ায় ফিরে আসার কোন বিকল্প ছিল না। সব কিছুর পরে ভাতের মতন অমৃত আমাদের যে চা-ই। কোথাও এর স্হান পূরণীয় নয়। 

১৫ শ্রাবণ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, 
পাঠক সমাবেশ 
ঢাকা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭