এডিটর’স মাইন্ড

জনশুমারি: সংখ্যালঘু নিপীড়নের দলিল


প্রকাশ: 31/07/2022


Thumbnail

গত ২৭ জুলাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের একটি তথ্য আতঙ্কিত করেছে। জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশের জনসংখ্যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীর হার কমেছে। সদ্য সম্পন্ন জনশুমারি অনুযায়ী, হিন্দু ধর্মাবলম্বীর হার জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এই ভূখণ্ডে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে পরিচালিত প্রথম জনশুমারিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এর পর থেকে দেশের জনসংখ্যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীর হার ক্রমেই কমছে। শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী নয়; বৌদ্ধ ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের আনুপাতিক হারও কমেছে। এটা স্পষ্ট- বাংলাদেশ ক্রমে মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুর হার কমে যাওয়া নিয়ে জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের পক্ষ থেকে দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করছে। দ্বিতীয়ত, হিন্দু দম্পতিরা তুলনামূলক কম সন্তান জন্ম দেন। প্রথম কারণটি সহজেই অনুমেয়। '৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর থেকে সংখ্যালঘু নিপীড়ন এই দেশে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণতি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পেয়েছিলাম, তা নষ্ট হয় জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে। '৭৫-এ শুধু জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়নি; মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও হত্যা করা হয়। সংবিধান থেকে উপড়ে ফেলা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রকাশ্যে বলা হতে থাকে- তোমরা ভারতে চলে যাও। কখনও অর্পিত সম্পত্তি আইনের মারপ্যাঁচে, কখনও সন্ত্রাস চালিয়ে চলতে থাকে দেশকে সংখ্যালঘুশূন্য করার ঘৃণ্য মিশন। নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নিয়মিতভাবে দেশত্যাগ করছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকরা। এটি রাষ্ট্রের জন্য নিশ্চয় লজ্জার বিষয়।

আমরা জানি, রাজনৈতিকভাবে বিএনপি মনে করে, সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের 'ভোটব্যাংক'। দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী যত কমবে, তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ ততই সুগম হবে- এই বিশ্বাস বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকর্মীর। জাতীয় পার্টি সংখ্যালঘু নিপীড়ন করে মূলত সম্পদের লোভে। হিন্দু সম্প্রদায়ের জায়গাজমি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দখল করেছে ক্ষমতায় থাকা জাতীয় পার্টির প্রভাবশালীরা। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে যুক্ত করার মাধ্যমে কার্যত হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে দেন এইচএম এরশাদ। '৭৫-এর পর আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করছে ১৮ বছরের বেশি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সময়েও ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপীড়ন বন্ধ হয়নি; বরং নিপীড়নের নতুন ধরন তৈরি হয়েছে। নির্যাতনের নতুন মাত্রা পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এ দমন-পীড়নে বৈধতা দেওয়ার এক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আশা করেছিল, এবার তাদের মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষিত হবে। ওই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কিছু দৃশ্যমান উদ্যোগও নেয়। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে বৈষম্য দূর করার আন্তরিক চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় এবং ফল ঘোষণা শেষ হতে না হতেই সারাদেশে দল দুটির নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সংখ্যালঘুদের ওপর। ২০০১ সালের ১ থেকে ১০ অক্টোবর নারকীয়তা নেমে আসে সংখ্যালঘুদের ওপর। এই ১০ দিনে সংখ্যালঘুদের ওপর যে বর্বরতা চালানো হয়েছিল, তা অনেক ক্ষেত্রে '৭১-কেও হার মানিয়েছিল। এর জের ধরে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেকে দেশ ত্যাগ করে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর থেকে টানা ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ। দলটি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করে বলে দাবি করে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলে। কিন্তু গত ১৩ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার পরও কি আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে পেরেছে? এই সময়ে আওয়ামী লীগ '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার মহামূল্যবান সুযোগও পেয়েছিল। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় এই সুযোগ করে দেয়। ওদিকে সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল আওয়ামী লীগের। তারপরও বর্তমান সরকার রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করতে পারেনি। এটা ঠিক, '৭৫-এর পর থেকে এ দেশে ধর্মান্ধ, মৌলবাদীরা সংঘবদ্ধ হয়েছে; বিত্তবান ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে। প্রশাসনের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ এরা বাসা বেঁধেছে। তাই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করা আওয়ামী লীগের জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এই সময়ে কি সংখ্যালঘুরা তাদের হূত মর্যাদা ফিরে পেয়েছে? তাদের ভয় কেটেছে? বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন আরও বেড়েছে। নড়াইলের বর্বরতা এর সর্বশেষ উদাহরণ।

এখন সংখ্যালঘু নির্যাতন যেন আরও পরিকল্পিতভাবে ঘটছে। বস্তুত নড়াইল, নাসিরনগর, কুমিল্লা, পীরগঞ্জের ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা। প্রথমে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির নামে ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। তাপরপর সেই অ্যাকাউন্ট থেকে ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট করা হয়। ব্যস, সবাই যেন ওঁৎ পেতে থাকে। পোস্ট দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় তাণ্ডব, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ। ঘটনার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন তামাশা দেখে। তাণ্ডব শেষ হয়ে যাওয়ার পর কর্তাব্যক্তিরা আসেন; মেকি সান্ত্বনা আর আশ্বাস দিয়ে দায়িত্ব এড়ান। এর পর সবাই ঘটনাটি ভুলে যান। কিন্তু যাঁরা সর্বস্ব হারান; যাঁদের ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়; তাঁরা গভীর বেদনা নিয়ে উপলব্ধি করেন- এই রাষ্ট্র তাঁর না।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গত কয়েক বছর ধরে যারা সংখ্যালঘু নির্যাতন, নিপীড়নে যুক্ত তারা ক্ষমতাসীন দলের সদস্য অথবা ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকে। এ জন্য তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক; তারা সংখ্যালঘুদের অধিকার দেয়- নির্যাতিত মানুষের হৃদয় থেকে এই বিশ্বাস ক্রমেই উবে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতির কারণ- গত এক দশকে আওয়ামী লীগে ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বিএনপি-জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বহু ব্যক্তি এখন আওয়ামী লীগের নানা পদে। বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও পাচ্ছে তারা। আস্তে আস্তে তাই আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাই হারিয়ে ফেলেছে।

জনশুমারি প্রতিবেদনটি আসলে সংখ্যালঘু নিপীড়নেরই পরিসংখ্যানিক দলিল। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য এটি অশনিসংকেত। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের একটা বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল- ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। 'বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান/ আমরা সবাই বাঙালি'- এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। 'ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার'- এই বাণীর বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চেয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু এবারের জনশুমারি জানিয়ে দিল- ওই আকাঙ্ক্ষা থেকে শুধু দূরেই না, বরং বিপরীত পথে হাঁটছি আমরা।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
সূত্র: সমকাল।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭