ইনসাইড থট

চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ ও কিসিঞ্জার


প্রকাশ: 02/08/2022


Thumbnail

(শোকের মাস চলছে। শোকের মাসের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষক লীগের রক্তদান কমৃসূচী উদ্বোধন করেন। ঐ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলেন। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায় মার্কিন দলিলে। পাঠকের জন্য এ সংক্রান্ত একটি লেখার চুম্বক অংশ প্রকাশিত হলো।)

কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালের অভিযোগ শেখ মুজিবকে শাস্তি দিতে তিনি খাদ্যসাহায্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তাই চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে নিক্সন প্রশাসনের ভূমিকার বিষয়টি আজও গবেষকদের মধ্যে কৌতূহল জাগিয়ে রেখেছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ও ব্রিটিশ গবেষক আলেকজান্ডার ওয়ালের কথায়, 'ওই সময় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যসাহায্য বন্ধ করে দেয়। আর সেটা ছিল হেনরি কিসিঞ্জারের নিষ্ঠুরতম সিদ্ধান্ত।

তিন মার্কিন অধ্যাপক জর্জ ডব্লিউ নর্টন, জেফরি আর আলওয়াং, উলিয়াম এ মাস্টার্স ২০০৬ সালে লিখেছেন:

১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারিভাবে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে ৩০ হাজার লোক মারা গেছে মর্মে সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হয়েছিল। তবে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। বেশির ভাগই একমত যে দুর্ভিক্ষের আগে বা পরে ক্ষুধা বা সে-সংক্রান্ত কারণে মৃতের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ১৯৮১ সালে যদিও লিখেছেন, '১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কারণ আর যা-ই হোক, সেটা খাদ্য কমে যাওয়ার কারণে ঘটেনি। তবে ওই সময়ে বাংলাদেশকে খাদ্য না দিতে মার্কিন প্রশাসনের রাজনীতিটাও অস্বীকার করা যাবে না। অধ্যাপক রেহমান সোবহান লিখেছেন, '১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এক প্রকট দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে খাদ্যসাহায্যকে ব্যবহার করল। সেই চাপ ছিল এমন একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার জন্য, যার ফসল হলো ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তন। ইলোরা শেহাবউদ্দিন ২০০৮ সালে লিখেছেন, 'রেহমান সোবহান যখন দুর্ভিক্ষের জন্য খাদ্য রাজনীতিকে দুষছেন, তখন এমা রথচাইল্ড (১৯৭৬) লিখছেন যে, কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক রদ না করা পর্যন্ত মার্কিন খাদ্যবাহী জাহাজ বাংলাদেশে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

১৯৭৪ সালের ৬ জুন কিসিঞ্জার এক তার বার্তায় লিখেছেন, কিউবায় পাট রপ্তানির সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ অবজারভার-এ ১৯৭৪ সালের ৪ মে প্রকাশিত হয়। এ থেকেই আমরা বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। তিনি এ ব্যাপারে আইনগত প্রশ্ন তোলেন। বলেন, পিএল ৪৮০-এর ১০৩ ঘ (৩) ধারার এর অধীনে বিষয়টি আটকে যেতে পারে। এটার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে খাদ্য সরবরাহ স্থগিত রাখার ইঙ্গিত দেওয়া হয়।

১০ জুন ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেডিস ইউজিন বোস্টার জানিয়েছেন, এইড সমন্বয়ক ও ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ অব মিশন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা সচিব সাইদুজ্জামানের (পরে এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী) সঙ্গে কথা বলেন। তবে দূতাবাস নিজস্ব সূত্রে জানতে পেরেছে, ৪ মে অবজারভার এর রিপোর্টের আগে বাংলাদেশ সরাসরি কিউবায় কোনো রপ্তানি করেনি।

অবজারভার শুধু পাটজাত পণ্যের উল্লেখ করেছে।

১৯৭৪ সালের ১১ জুন নিক্সন সরকারের রাজনীতি-বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জোসেফ জন সিসকোর প্রেরিত এক বার্তায় দেখা যায়, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হোসেন আলীকে কিউবায় পাট রপ্তানিসংক্রান্ত জটিলতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাঁকে এটাও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ পিএল ৪৮০-র নতুন গ্রহীতা, তাই অসাবধানতাবশত কিউবার সঙ্গে সে ওই বাণিজ্য করে ফেলতে পারে। ওই আইনে নির্দিষ্টভাবে কিউবা ও উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক করার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ইউএসএইডের ডোনান্ড ম্যাগডোনাল্ড এ নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম, রাষ্ট্রদূত বোস্টার এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে কথা বলেছেন।

১৩ জুন বোস্টার লিখেছেন:

পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম আজ আমাকে তাঁর সঙ্গে আলোচনার আমন্ত্রণ জানান। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই “জটিল” বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি জানাতে বলেছেন যে সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ পাটকল সংস্থা কিউবায় ৪০ লাখ চটের বস্তা রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক রপ্তানি হয়েছে। এমন রপ্তানি কেবল একবারের জন্যই। পিএল ৪৮০-সংক্রান্ত আইনি জটিলতা তাদের জানা ছিল না। এটা অজ্ঞতার কারণে ঘটেছে। নুরুল ইসলাম বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে কিউবায় রপ্তানি করতে দিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে দেখা যায়। কারণ, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা ভালো নয়।

লক্ষণীয় যে, এই বৈঠক সফল ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। বোস্টার বাংলাদেশের পক্ষে এক অসাধারণ সুপারিশ করেন। কিউবায় ভুল করে পাটজাত পণ্য প্রেরণের কারণে বাংলাদেশকে যাতে শাস্তি না দেওয়া হয়, সে জন্য তিনি মুজিব সরকারের সার্বিক অবস্থান তুলে ধরেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আর্চার ব্লাডের মতোই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাঁর মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি লিখেছেন :

আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করা উচিত যে বাংলাদেশের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে আমাদের লাভটা কী। সোভিয়েত ব্লক থেকে তাড়াতাড়ি বের হওয়া তার জন্য দূরূহ। তবে মুজিব সরকার তার পররাষ্ট্রনীতিতে যেভাবে সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে, সেটা মার্কিন স্বার্থের অনুকূল। বাংলাদেশ এক বছর ধরে সকল পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট রয়েছে। ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি লেইনজেন মি. হোসেন আলীকে যেমনটা বলেছেন, তেমনি আমিও তাঁকে (নুরুল ইসলাম) বলি যে, এ নিয়ে প্রকাশ্য বিতর্ক করলে কোনো সুফল মিলবে না। এখন আমি মনে করি না যে, কৌশলগতভাবে গুরুত্বহীন এমন একটি কৃষিপণ্যের রপ্তানি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে কোনো ফায়দা পেতে পারি।

তাছাড়া রাষ্ট্রদূত বোষ্টার সমস্যাটির আইনি সমাধানও বাতলে দেন। তিনি যুক্তি দেন যে, 'পাটজাত পণ্যের কোনো কৌশলগত গুরুত্ব নেই। তাই ওই আইনের আওতায় একে “অকৌশলগত কৃষিজাত পণ্য” হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ১৯ তবে বাংলাদেশে যখন অনাহারে মানুষ মরছিল, তখনো কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দিতে চাননি। এর সাক্ষ্য-প্রমাণ এখন মার্কিন দলিল থেকেই পাওয়া যাচ্ছে।

১৪ আগস্ট ১৯৭৪। বিকেল পাঁচটা। মিনেসোটা থেকে নির্বাচিত ডেমোক্রেটিক সিনেটর হুবার্ট হামফ্রে টেলিফোনে কথা বলছেন কিসিঞ্জারের সঙ্গে। হামফ্রে মার্কিন খাদ্য-কূটনীতি সম্পর্কে অত্যন্ত অভিজ্ঞ। ১৯৫০-এর দশকে ভারতে দুর্ভিক্ষের সময় হামফ্রে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের পাশে দাঁড়ান। এর ফলে কংগ্রেস ইন্ডিয়ান ইমার্জেন্সি ফুড অ্যাক্ট, ১৯৫১ পাস করে এবং ভারতকে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য ক্রয়ে ১৯০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে ট্রুম্যান সরকারকে অনুমতি দেওয়া হয়।

সিনেটর হামফ্রে ওই দিন কিসিঞ্জারকে রোমে অনুষ্ঠেয় আসন্ন বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে যোগদানের জন্য উৎসাহিত করেন। কিসিঞ্জার বলেন, 'আমিও আপনাকে ওই সম্মেলনে যোগ দিতে অনুরোধ জানানোর কথা ভাবছিলাম।' এ সময় তাঁদের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি উঠে আসে:

হামফ্রে: আমি মনে করি, ওই সম্মেলনে আপনার উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আজ আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বাংলাদেশ তো একটা 'বাস্কেট কেস'। তাদের জনগণের জন্য ত্রাণ সরবরাহে আমরা কি নির্বাহী বিভাগ থেকে কোনো অনুরোধ পেয়েছি?
কিসিঞ্জার: আমাকে এটা দেখতে দিন অবশ্যই আমাদের এটা করা উচিত।
হামফ্রে: আমি ভেবেছিলাম, বিষয়টি আপনার নজরে আনা উচিত।
কিসিঞ্জার: আমি খুবই সহানুভূতিশীল।

১০ জানুয়ারি ১৯৭৫। সন্ধ্যা ৭: ২০। টেলিফোনে কথা হচ্ছে কিসিঞ্জার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট টম এভার্মের মধ্যে:

কিসিঞ্জার: গত তিন দিন আমি প্রেসিডেন্টের কাছে আমাদের পিএল ৪৮০ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে চাইছি। কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে একটি ভালো কার্যপত্র পাইনি। প্রত্যেকটি কার্যপত্রে ইন্দোনেশিয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা ইন্দোনেশিয়াকে বাদ দেব না। ইন্দোনেশিয়াকে নয়, বাংলাদেশকে বাদ দিন।

১৯৭৫ সালের ১০ জানুয়ারি কিসিঞ্জার যেখানে বাংলাদেশকে বাদ দিতে বলছেন, সেখানে ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রদূত বোস্টার ঢাকায় মুজিবকে আশ্বস্ত করছেন। দুর্ভিক্ষের করাল থাবা তখন গোটা দেশে প্রসারিত। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি। প্রাপ্ত দলিলটিতে কোনো তারিখ নেই। দিনটি ছিল শনিবার। শেখ মুজিব এ দিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টারের সঙ্গে ৪০ মিনিট ধরে কথা বলেন। বোস্টারের সঙ্গে মার্কিন পলিটিক্যাল কাউন্সিলর কোচরান ছিলেন।

বোস্টার কিসিঞ্জারকে লিখেছেন:

পিএল ৪৮০-এর আওতায় আমি মুজিবকে অতিরিক্ত সাড়ে তিন লাখ টন। গম সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সিদ্ধান্তের কথা বললাম। মুজিব শুনে আশ্বস্ত হলেন। তিনি ভাবলেন, অন্তত জুন পর্যন্ত এই গম দিয়ে পরিস্থিতি সামলানো যাবে। তিনিও এ সময়ের মধ্যে সোয়া লাখ টন গম আনতে পারবেন বলে জানালেন।

সূত্র: মিজানুর রহমান খান, মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড, পৃষ্ঠা: ২২-২৬।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭