ইনসাইড থট

বঙ্গমাতার জন্মদিনে সশ্রদ্ধ সালাম


প্রকাশ: 08/08/2022


Thumbnail

৮ আগস্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। খুবই পরিতাপের বিষয়, ঠিক তার জন্মদিনের সাতদিন পরে অর্থাৎ ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে। সেদিন বঙ্গবন্ধু ছাড়াও নিহত হন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। এছাড়াও তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনসহ নিহত হন আরো ১৬ জন। সুতরাং আগস্ট মাসটা শোকের মাস। একই সঙ্গে এই মাসে বঙ্গমাতার জন্মদিন। সুতরাং শোকের মাসের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বঙ্গমাতার সম্পর্কে আমি কয়েকটি কথা বলতে চাই। বঙ্গমাতার সাথে আমার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় মাঝে মাঝে দেখা হতো। আমি সাহায্যের জন্য তার কাছে যেতাম। তিনি যেভাবে আমাকে সাহায্য করতেন, ঠিক তেমনিভাবে মাঝে মাঝে কিছু কাজও দিতেন। বঙ্গমাতাকে আসলে অনেকভাবে মূল্যায়ন করা যায়। আমি প্রথমে মূল্যায়ন করবো মা হিসেবে। আগামী ১০০ বছরে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার মতো কোনো দার্শনিক পাবে না। সেই দার্শনিকের মা তিনি। তার গর্ভে শুধু এই দার্শনিক শেখ হাসিনা জন্মগ্রহণ করেননি, তাকে লেখাপড়া থেকে শুরু করে রাজনীতি মূলত তিনিই শিখিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তরুণী শেখ হাসিনার মাধ্যমেই রাজনৈতিক বিষয়ে খোঁজ-খবর, অনেক সময় নির্দেশনা দেওয়া, অনেক সময় নির্দেশনা পাওয়া, এই কাজগুলো তিনি করিয়েছেন। যদি তার বয়সের কথা চিন্তা করেন তাহলে চিন্তা করতে হবে যে, এই বয়সের একজন তরুণীকে দিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করিয়েছেন। যে কাজে একটু এদিক-ওদিক হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশই প্রতিষ্ঠিত হতো না। অর্থাৎ তিনি এখন যে রাজনীতি করছেন সেটা এই ধরনের কাজের মাধ্যমেই শিখেছেন। বঙ্গমাতা তখনই তাকে দিয়ে এই মাপের রাজনীতি করিয়েছেন। সুতরাং একমাত্র বঙ্গমাতা ছাড়া পৃথিবীতে কোনো মা এত অল্পবয়স্ক কোনো তরুণীকে এত গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বপূর্ণ কাজ এবং যেখানে অনেকগুলি কাজের মধ্যে দার্শনিক বিষয়গুলিও পড়ে, সেগুলি করিয়েছেন। এটা চিন্তা করলে অবাক হতে হয়। তার মানে, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নিজে কতটুকু দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে চলতেন এবং তিনি কীভাবে আরেকজন দার্শনিক তৈরি করেছেন।

বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে যখন জেলের বাইরে থাকতেন, বড় মেয়ে হিসেবে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। তিনি তার রাজনৈতিক গুরু এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যদি বাস্তবিক কথা বলতে হয়, তাহলে রাজনীতির অলিগলি, রাজনীতিতে দর্শনের পথ, জনগণের প্রতি ভালোবাসার পথ, কি করে কঠিন সময়ে কঠিন রাস্তায় চলতে হবে সেই পথ, এটা শিখিয়েছেন বঙ্গমাতা। এটা বঙ্গমাতার অবদান। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা একজন দার্শনিক এবং একজন দার্শনিকের কোনো মৃত্যুচিন্তা থাকে না। মৃত্যুচিন্তা থাকলে তিনি দার্শনিক হন না। যত দার্শনিক দেখা গেছে তারা সত্যের জন্য জীবন দিতে পিছপা হননি। কারণ কোনো দার্শনিককে কোনো কিছু দিয়ে কেনা যায় না। কোনো কিছু দিয়ে বশ করা যায় না। কোনো কিছু দিয়ে তার পথ থেকে সরানো যায় না। সুতরাং দার্শনিক হিসেবে শেখ হাসিনাকে প্রতিষ্ঠিত যদি না করা যেতো, যদি বঙ্গমাতা তখন থেকেই শুরু না করতেন এবং জাতির পিতা তাকে না শেখাতেন তাহলে আজ তিনি দার্শনিক হয়ে উঠতেন না। ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত জাতির পিতা ছিলেন দেশের সবকিছু। সেই সাথে বঙ্গমাতা তার ক্ষমতা কোনোদিন না দেখালেও সবাই জানতো যে তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। সেই সময় দার্শনিক শেখ হাসিনাকে তো কোনো রাজনৈতিক কাজে বঙ্গমাতা যোগ করেননি। বরং স্বামীর সাথে সংসার করতে পাঠিয়েছেন। এইখানেই বঙ্গমাতার সাথে বিশ্বের যেকোনো মাতার পার্থক্য। সুতরাং বঙ্গমাতাকে বিচার করতে হবে সেইভাবে। বঙ্গমাতা একজন দার্শনিককে জন্ম দিয়েছেন, তাকে লেখাপড়া থেকে শুরু করে দর্শনের জন্য যা যা প্রয়োজন সমস্তভাবে প্রস্তুত করেছেন। সুতরাং বলা চলে, জাতির পিতার মতো বঙ্গমাতাও দার্শনিক শেখ হাসিনার রাজনৈতিক গুরু। সুতরাং শুধুমাত্র জাতির পিতার কথা বললে এবং বঙ্গমাতার কথা না বললে, আমার মনে হয় ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এজন্য আমাদেরকে দায়ি করবেন। আমাদের দায়িত্ব থেকে অন্তত কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়ার জন্য এই কথাগুলি সবাইকে জানানো গুরুত্বপূর্ণ।

বঙ্গমাতার সাথে ১৯৬১ সালে পরিচয় হলেও সেই পরিচয়টা ঠিক অতটা গভীর ছিল না। কিন্তু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় আমার লিফলেটের টাকার প্রয়োজন ছিল, তাই একজনের বুদ্ধিতে আমি তার কাছে টাকাটা আনতে গেলাম। তিনি আমাকে ১০০ টাকা দিলেন। তখন সম্ভবত স্বর্ণের ভরি ২৫ থেকে ৩০ টাকা। তার মানে কত টাকা এটা বুঝতে হবে। সেই লিফলেটটি ছাপাতে এবং বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে সে সময় আমার লেগেছিল ৬৫ টাকা এবং অনেক পরে জেনেছি যে, সেই টাকাটা তিনি তার গহনা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তার মানে এইভাবে তিনি আগরতলা মামলার সময় দলকে চালিয়েছেন। আগরতলা মামলার আরেকটি ঘটনা আমি যেহেতু জানি, তাই বলছি। কিন্তু আমার স্মৃতি অতটা প্রখর না, সুতরাং এটা ভুলও হতে পারে। আমার যতদূর মনে আছে সালাম খানকে তিনি মামা বলতেন এবং তিনি রাজনৈতিকভাবে তখন বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে সমর্থন করছেন না। কিন্তু বঙ্গমাতা তার বিবেচনায় মনে করলে যে, সালাম খান যদি এই মামলাটা পরিচালনা করেন তাতে যে আর্গুমেন্ট দিবেন তাতে দেশবাসি আগরতলা মামলা সম্বন্ধে শুধু জানবে না, দেশবাসীর কাছে একটা বার্তা যাবে এবং জনগণের ভেতরে একটা অনুভূতি হতে পারে। তিনি এটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন এবং আমি জেনে বলছি, প্রথমে সালাম খান মামলাটি পরিচালনা করতে রাজি হননি। কিন্তু বঙ্গমাতা তখন মামা বলে তাকে রাজি করিয়েছিলেন। এই বঙ্গমাতার জন্যই সালাম খান মামলাটি পরিচালনা শুরু করেন এবং যখন মামলার প্রসিডিংস ইত্তেফাকে বেরোতে থাকে, তখন তরুণ থেকে বৃদ্ধরা পর্যন্ত আগরতলা মামলায় সালাম খানের যে আর্গুমেন্ট, সেই আর্গুমেন্টও আমাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছিল। তার সাথে আমাদের রাজনৈতিক পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাস ইতিহাসই। এই ইতিহাসের গোড়াপত্তন কে করলেন? তিনি হলেন বঙ্গমাতা।

বঙ্গমাতার আরেকটা উদাহরণ দেই, আমি ১০ দিন বা ২ সপ্তার মধ্যে একবার অবশ্যই যেতাম। তিনি কথা কম বলতেন, গম্ভীরই থাকতেন। তিনি আমাকে একদিন বললেন যে, কামালউদ্দিন যে রাজসাক্ষী বৈরি হয়েছে সে এবং তার স্ত্রীর ভাই এদের দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে একটা কেবিনে রাখা হয়েছে। তাদের এমন অত্যাচার করেছে যে, যাতে তারা বৈরি না থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধাচরণ করে। তোমার এতে কোনো দায়িত্ব নেই। এমনকি তারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোথায় আছে না আছে, এর সম্বন্ধেও তুমি কিছু জানার চেষ্টা করবে না। আমি যে তোমাকে বললাম এইটা তুমি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু তোমার একটা দায়িত্ব আছে। দায়িত্ব হচ্ছে, কামালের স্ত্রী মগবাজারে একটি বাসায় থাকে। তুমি ঠিকানাটা বের করে তার খোঁজ-খবর নিবে। আমি তা বের করলাম, ছোট একটা দোতলা বাড়ি। দোতালায় থাকেন তিনি। আমার যতদূর মনে পড়ে তার নাম হাসিনা । এই হাসিনা আপার সাথে আগে কোনো পরিচয় ছিল না। তাকে বললাম যে, আপা কোনে প্রয়োজন আছে কিনা। বললেন না ভাই। তুমি ছোট ভাই হিসেবে এসো। এরপর আমি এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম যে প্রায় এক দিন পর পরই আপার বাসায় যেতাম। কারণ তার ব্যবহার আমার খুব ভালো লাগতো। আমি তখন জিনিসটা পুরো বুঝিনি। পরে বুঝেছি একটা কাজের মাধ্যমে। তার বাসায় একজন ১৮-১৯ বছরের তরুণী ছিলেন। তার সঙ্গে কথা না হলেও ২-১ বার দেখা হয়েছে। তো হসিনা আপা বললেন যে, এই যে মেয়েটিকে দেখছো না, ও কথা বলতে চাইলে ওর সাথে বেশি তোমার কথা বলার দরকার নেই। তুমি মেডিকেলে পর বা তুমি যে শেখ মুজিবকে চেনো এইসব কোনো রকম কোনো কথা বলবে না। কারণ ওর বাবা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একজন সাক্ষী। তাকে এখানে আমি এনে রেখেছি। আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয় তাই। হাসিনা আপা তাকে এনেছেন যাতে তাকে দিয়ে প্রভাব খাটানো যায় এবং তার বাবা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যেনো ঠিকমত সাক্ষী না দেয়। অর্থাৎ এখন বুঝি যে, এটা বঙ্গমাতা জানতেন। যদিও বঙ্গমাতা এই সম্বন্ধে দ্বিতীয় কোনদিন আমার সঙ্গে আলাপ করেন নি। অর্থাৎ আমার বিশ্বাস যে, তিনি এই সমস্ত খবরই জানতেন। বঙ্গমাতার অবদান এই জাতি কোনদিন শোধ করতে পারবে না। যেরূপ বঙ্গবন্ধুর অবদান কোনোদিন শোধ করা যাবে না।

আমার একটি ছোট্ট বিষয় আছে যার জন্য আমি নিজেকে খুব গর্বিত মনে করি, সেটা হচ্ছে গোপালগঞ্জে যে হাসপাতালটা এখন হয়েছে এটা প্রথম শুরু করি ১৯৯৬ সালে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সাথে আলাপ করেন। তিনি বললেন যে, দেখেন এটাকে কি একটি স্থায়ী রূপ দেওয়া যায় কিনা। তারপর সাইড সেভার্স বা আরসিএসবি সহায়তা নিয়ে একটা কাজে আসলো। তারা চাইলো যে, তারা মোবাইল আই ক্যাম্প করতে চায় এবং এইটাতে সরকারের অনুমতি লাগবে। আমি বললাম অনুমতি দিয়ে দিতে পারবো কিন্তু একটা কন্ডিশন আছে। এই প্রোজেক্টের নাম দিতে হবে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আই ক্যাম্প প্রজেক্ট। তার রাজী হয়ে গেল। আমি এটাকে গ্রহণ করলাম। একটা সিলেটে এবং আরেকটা গোপালগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে। প্রথম মোবাইল আই ক্যাম্পটা হলো। যাতে রোগীদের এনে একটা ক্যাম্প সিচুয়েশনে অপারেশন। কারণ নেত্রী ভাবলেন যে, স্কুলে বা যেকোনো জায়গায় ক্যাম্প করে অপারেশন করলে কিছু দৃষ্টি ফেরত পায় ঠিকই, অনেক ইনফেকশনও হয়। আর যদি অপারেশন থিয়েটারটা ভালো হয়, তাহলে তো বিষয়টা ভালো হয়। এই জিনিসটায় মূল অবদান তার এবং তার কর্মী হিসেবে আমি কাজটা করেছি। তারপরে যখন সুযোগ আসে তখন গোপালগঞ্জে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আই হাসপাতাল হয়েছে।

বঙ্গমাতার জন্মদিনে আমার একটি আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে যে, বঙ্গমাতার নামে প্রতিষ্ঠিত শেখ ফজিলাতুন্নেছা আই হাসপাতালে আই কেয়ারের হেড অফিস হবে এবং আমরা যে আই ভীষন সেন্টার করেছি, সেই হাসপাতালটাকেই আমরা হেডকোটার করবো। যেটা পরিশেষে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হবে। আমি বঙ্গমাতার আত্মার প্রতি এবং ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ যারা শহীদ হয়েছেন সকলের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। আমাদের দেশকে দার্শনিক শেখ হাসিনার মতো একজন দার্শনিক তৈরি করে দেওয়ার জন্য বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতি আমরণ কৃতজ্ঞ থাকবো।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭