ইনসাইড টক

'ডাক্তার আহতদের রেখে পালাতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না'


প্রকাশ: 21/08/2022


Thumbnail

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাচিপের সাবেক সভাপতি এবং সাতক্ষীরা-৩ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, সে সময় আমরা মিছিল করবো বলে একটু সরে এসেছিলাম। তারপর তো হঠাৎ ঘটনা ঘটলো। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে নেত্রীর গাড়িটা বেড়িয়ে যেতে দেখলাম। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না যে, নেত্রীর কি অবস্থা। অনেকে নানা ধরনের কথাবার্তা বলতে থাকলো। তারপরে আমি রিক্সা বা মোটরসাইকেলে করে (ঠিক মনে নেই) ৫ নম্বরে হাজির হয়েছিলাম। গিয়ে দেখি নেত্রী নিচে বসা। যে ছবিটা দেখা যায়, তখন ওই সময় সেই ছবিটি তোলা হয়েছিল। নেত্রীর অবস্থা তখন কল্পনা করা যায় না। বিভিন্ন জায়গা থেকে যেসকল খবর আসছিল, তাতে করে তখনকার অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। হাসপাতালে হাজার হাজার লোক। সেখান থেকে খবর আসছে ডাক্তার নেই। এখানে রোগী ওখানে রোগী। তখন আমি বসেছিলাম। আমাকে এবং বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদকে তিনি বললেন, তুমি ডাক্তার সাহেবদের নিয়ে যাও। আরও কয়েকজন ছিলেন। তাদেরকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে গেলাম। সেখানকার বর্ণনা ছিল অবর্ণনীয়। 

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিভিন্ন স্মৃতি তুলে ধরে বাংলা ইনসাইডার এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক এসব কথা বলেছেন। পাঠকদের জন্য অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক এর সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, তখন হাসপাতালে এমন একটা অবস্থা যে, ইমারজেন্সীতে ডাক্তার নেই। যারা চিকিৎসা করবে এমন কোনো ডাক্তারকেই কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন আমাদের যেসকল ডাক্তাররা যে যেখানে ছিল, সকলকে খবর দেওয়া হলো। আমাদের স্বাচিপের ডাক্তাররা, মানে আওয়ামী ডাক্তাররা একটি ভালো রোল প্লে করলো। সে সময় এনেসথেসিয়া দেওয়া, আই ভি দেওয়া, রোগীদের ম্যানেজ করা। এগুলো তখন তারা করেছিলেন। এরই মধ্যে আইভি আপাকে নিয়ে আসা হলো। তখন তো তার অবস্থা অনেক সিরিয়াস। পরবর্তী পর্যায়ে তো সিএমএইচ এ পাঠানো সিদ্ধান্ত হলো।

তিনি আরও বলেন, হাজার হাজার রোগী, সব জায়গা থেকে রোগী। তখন আমি যেহেতু ডাক্তারদের নেতৃত্বে ছিলাম, তখন আমাদের ছেলেমেয়েদের ঢাকা মেডিকেল কলেজে সেটেল করিয়ে আমি এবং ইকবাল বেরিয়ে পড়লাম। শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে আমরা গেলাম দেখতে। আমরা দেখতে পেলাম বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন সমস্যা। সে সময় কিছু ডাক্তারি করলাম, কিছু সমাজ সেবা করলাম। কে কোথায় আছে তার প্রত্যেকটা লিস্ট করলাম। আমরা তখন থেকে শুরু করে সারারাত বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি করলাম। তখন ঢাকা শহরের সব হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলো পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কে কোন ক্লিনিকে আছে সেটার খবর নিয়েছি।

অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বলেন, সেদিন রাত দেড়টা দুইটার দিকে ৪ নাম্বার রোডের ডেল্টা হাসপাতাল থেকে কেউ একজন টেলিফোন করলো যে, বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনের অবস্থা ভালো না। সে এখনই মারা যেতে পারে। আমি গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি তার পেটে ইনজুরি হয়েছে। সিরিয়াস অবস্থা। এই অবস্থায় অপারেশন করতে হবে। এই পারমিশন দেওয়ার সেই সময় কোনো লোক নেই। সে সময় সে তো কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। তখন আমি অথরিটি নিলাম। তোমরা অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাও এবং অপারেশন করো। সে সময় তাৎক্ষণিকভাবে অপারেশন করে তার পেটের ইনজুরি রিপেয়ার না করা হতো, তাহলে তো আর ঘণ্টাখানেক ওই অবস্থায় থাকলেই সে মারা যেতো। এমনি ভাবে কত জায়গায় যে, কত লোকের সেদিন সাহায্য করা হয়েছে।  

তিনি বলেন, আমি ভোর সাড়ে ৫ কি ৬ টা বাজে। আমি বাসায় মাত্র ঢুকেছি। একটু হাতমুখ ধুয়ে আবার বেরোবো। তখনই নাসিমা ফেরদৌসের ছেলে আমাকে ফোন করেছে যে, আংকেল আপনি কোথায়। আমি বললাম আমি তো এইখানে। সে বলে যে, আমি তো মেডিকেল কলেজে ছিলাম। এখন বাংলাদেশ মেডিকেলেজে এসেছি। আম্মার তো পা কেটে ফেলবে। আম্মা তো আপনাকে না দেখিয়ে পা কাটবে না। তখন আমি বললাম, তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি। পরবর্তীতে ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমি হাজির হলাম এবং আমি দায়িত্বটা নিলাম। পরবর্তীতে চিকিৎসা করে তার পা টা বেঁচে গেলো। এরকম বহু লোকের বহু কাহিনী। 

সেই সময় চিকিৎসা ব্যাহত করার জন্য তৎকালীন সরকার কি কোনো বাধা দিয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, সত্যি বলতে সে সময় আমার মাথায় এরকম কোনো বুদ্ধি ঢোকে নাই। আমি একজন ডাক্তার হিসেবে আমি এটা চিন্তা করতে পারি নাই বা আমি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারি নাই যে ডাক্তাররা নাই। ডাক্তাররা যে তাদের নির্দেশে বা আদেশে পালিয়েছে সেটা বিশ্বাস করতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। দুই-চারদিন পরে আমি বিশ্বাস করতে পেরেছি যে, এটা সম্ভব এবং এরা যে বাধা দেবে যে, চিকিৎসা কোরো না, এটা যে সম্ভব এটা আমি কল্পনার মধ্যে তখন আনতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে যা শুনেছি তাই। কিন্তু তখন তারা যে বাধা দিচ্ছে কা কিছু এরকম চিন্তা আমার মাথায় আসার কোনো সুযোগ ছিল না। তখন আমরা ব্যস্ত মানুষকে বাঁচানোর জন্য। পরবর্তী পর্যায়ে নেত্রী আমাকে, ইকবালকে দায়িত্ব দিলো যে, সমস্ত রোগীদের তালিকা তৈরি করার এবং কাকে দেশে চিকিৎসা করাতে হবে, কাকে বিদেশে চিকিৎসা করাতে হবে, এর সমস্ত দায়িত্ব স্বাচিপের ডাক্তারদের ওপর পড়লো। আমি আমার সাধ্য মতো সেগুলো করেছি। আমি কয়েকবার কোলকাতায় গিয়েছি, দিল্লিতে গিয়েছি। আপা খরচ পত্র দিয়েছে রোগীদের জন্যে। আপার কাছ থেকে আমি কখনো আমার খরচ নেইনি।

তিনি আরও বলেন, মানুষ যে এত নিষ্ঠুর হতে পারে, ডাক্তার যে আহত মানুষকে রেখে পালিয়ে যেতে পারে, এটা আমি না দেখলে, কেউ বললে বিশ্বাস করতাম না। এটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতো না যে, একজন আহত রোগী ফেলে ডাক্তার পালিয়ে গেছে চিকিৎসা করবে না বলে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭