ইনসাইড থট

বিশ্ববিদ্যালয় কি বিবেকের শাসন থেকে আমলাদের শাসনে যাচ্ছে


প্রকাশ: 26/08/2022


Thumbnail

ছাত্রদেরকে নীতিবিদ্যা পড়াই। সেখানে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, কান্ট প্রমুখ দার্শনিকের নীতিবিদ্যা পড়তে হয়। আমরা যদি অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে চাই তবে নীতিবিদ্যা সকলেরই পড়া প্রয়োজন। সামাজিক অবক্ষয় থেকে জাতিকে বাঁচাতে হলে নীতিবিদ্যার প্রতি যে জোর দেয়া হয় সরকারি বক্তব্যে তা আসলে আরও জোরালো হওয়া প্রয়োজন কর্মকান্ডে।

নীতি-নৈতিকতা সম্ভব হয় যদি একজন মানুষ স্বাধীন হয়। আমাদের মহানবী সেই স্বাধীনতার কথা বলেছেন। আর তাই তিনি দাসত্বের বন্ধন থেকে আমাদের মুক্তির দর্শন দিয়েছেন। তিনি প্রয়োজনে একজন দাসীকে বিবাহ করবার পরামর্শ দিয়েছেন দাসত্বের অবসানকল্পে। ১৭৫৭ সালে মীর জাফরের বেঈমানিতে আমরা ব্রিটিশদের দাসে পরিণীত হয়েছিলাম। আর ধর্মান্ধতার কারণে ১৯৪৭ সালে আমার পাকিস্তানের দাসে পরিণীত হই। সেই দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। আর তাই ৭ মার্চ পল্টনের ময়দানে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেছেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশবাসী পাকিস্তানী গণহত্যা এবং রাজাকারদের বেঈমানিকে পরাস্ত করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছিল। কিন্তু কেন জানি আমাদের সেই স্বাধীনতাকে বারবার একটি মহল শৃঙ্খলিত করতে চায়। আমাদেরকে আবার দাসে পরিণত করতে চায়। পাকিস্তান আমলে আমার ছিলাম ২২ পরিবারের দাস আর এখন ২২ শত পরিবারের দাস হয়েছি যেন।

এই দাসত্ব করবোনা বলে আমি শিক্ষকতার পেশা নির্বাচন করেছিলাম। কিন্তু আমার দেখছি আমাদের আমলারা নিজেদেরকে স্বাধীন রাখার জন্য আমাদেরকে দাসে পরিণীত করতে চাইছেন। আদালত রায় দিয়েছেন- ওনাদেরকে গ্রেফতার করতে এখন আর অনুমতি লাগবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের বিবেকের শাসন দিয়ে চলবেন। এই বিবেকের শাসনের কথা বলেছেন দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। ব্যক্তি তারা শাসনের আইনটি বিবেক থেকে নির্মাণ করবেন এবং স্বাধীনতাকে ভোগ করে সমাজের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে না জড়িয়ে জীবন যাপন ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু সেই বিবেকের শাসনের জায়গাটি দিন দিন সীমিত হয়ে আমাদের আমলাতন্ত্রের দেশে পরিণত হতে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সেখানে এখন যারা উপাচার্য বা বিভিন্ন পদে তারাও আমলাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তিনি ভুলে  থাকছেন শিক্ষকরা স্বাধীন ও বিবেক দিয়ে চলবেন- কারণ তাকে সফল হতে হবে। আর গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে স্বাধীনতা জাতির পিতা দিয়ে গেছেন সেটাকে এখন শূন্যের কোঠায় নিয়ে যাচ্ছেন একটি মহল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের অভিন্ন নীতিমালা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পে স্কেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরণের ভাতার নীতিমালা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারি কলেজে পরিণত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। কিন্তু কেন? কিসের ভয়?

২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় সামরিক-আমলার শাসন থেকে মুক্ত করতে আইন ভঙ্গ করতে শিক্ষকরা পিছুপা হননি। আজকের সরকার সেই শিক্ষকদের প্রতিবাদের ফসল বললে কি ভুল হবে? ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে কি শিক্ষকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেনি? যদি সেদিন তারা বিবেকের শাসন মেনে আইন ভঙ্গ করে প্রতিবাদ না করতেন তবে বাংলাদেশের সরকার পাকিস্তানিদের মতো হতো না কি? আমরা শিক্ষকরাও ভুলে যাই এবং ওই বিবেকের শাসন ভুলে আমলাদের শাসনের পক্ষে সাফাই গাই। কিন্তু কেন? তাহলে কি আমাদের শিক্ষার মাঝে ভুল আছে যে কারণে আসলে আমরা প্রকৃত শিক্ষক হতে পারিনি!

বিশ্ববিদ্যালয় দিন দিন কলেজের পর্যায়ে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে। জনগণের টাকার হিসেবে দিতে হবে। আর সেই সুবাদে এখন জেলা প্রশাসক চান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার হতে। জনগণের টাকার হিসেব অবশ্যই আমাদের দেয়া উচিত। কিন্তু সেটার জন্য যেভাবে আচরণ করা হয় সিন্ডিকেট বা সিনেট মিটিং এ সেটা নিন্দনীয়। বঙ্গবন্ধু যে মুক্তির কথা বলেছিলেন তাহলো - দাসত্ব থেকে মুক্তি , অভাব থেকে মুক্তি , অজ্ঞতা থেকে মুক্তি। সেই মুক্তি অর্জনে বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। দয়া করে সেই স্বাধীনতাকে কেড়ে নেবেন না। শোকের মাসে আমাদের সকলের কর্তব্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে নিজের কর্মকান্ডে প্ৰতিফলন ঘটানো।

একজন শিক্ষক উপাচার্য নির্বাচিত হন সরকারি ও জন প্রতিনিধিদের ভোটে। সেই নির্বাচন থেকে একজন উপাচার্য নিয়োগ দিতে ৯৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তেমনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট গত ১৪ আগস্ট নির্বাচিত করেছে তিনজনকে। শোনা  যাচ্ছে তাদের সম্পর্কে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য সংগ্রহ করছেন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারকে সহযোগিতা করতে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কেন এই আমলাতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে? বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট জেনেই তিনজনকে নির্বাচিত করেছে। তাহলে কেন এরকম গোয়েন্দা রিপোর্ট সংগ্রহ? আমি ভাবতে চাই এমন তথ্য মিথ্যা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাধীনভাবে চলতে দিন। দেশের উন্নয়নে একটি নির্মাণ কাজে প্রায় তিনগুণ ব্যয় বহন করছে জনগণ। সেখানে শিক্ষকদের সামান্য কিছু ভাতা নিয়ে জাতীয় নীতিমালা স্রেফ বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার কথা বলেছেন তার বিরোধিতা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে স্বাধীনভাবে চলবার সুযোগ করে দিয়েছে বলেই আজ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া উন্নত জাতির স্বীকৃতি লাভ করেছে। যে জাতি  যত বেশি স্বাধীনতাকে মূল্য দেয় সেই জাতি ততটা উন্নত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ ও উপাচার্যরা হবে স্বাধীন এবং উপাচার্য তিনিই হবেন যিনি সবচে বিবেকবান। বিবেকবান মানুষ খুঁজতে গোয়েন্দার প্রয়োজন নেই। ছাত্ররাই বলতে পারে কোন শিক্ষক বিবেকবান। উপাচার্য হবেন সাহসী। তিনি শিক্ষকের উদ্ভাবনী চ্যালেঞ্জকে মূল্য দিতে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

উপাচার্য আইনের দাসত্ব না করে প্রয়োজনে আইন করবেন সৃজনশীলতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে। সৃজনশীল কর্মকান্ড অসম্ভব হয়ে যায় যদি স্বাধীনতা না থাকে। উদ্ভাবনের অনিবার্য শর্ত স্বাধীনতা। জবাবদিহিতার নাম করে বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাপিয়ে দেয়া হয় তবে আমরা খুব সহজেই দাসত্বকে আলিঙ্গন করবো যে দাসত্বকে আমাদের মহানবীর, মহামানবের এবং বঙ্গবন্ধু চ্যালেঞ্জ করেছেন। আমরা শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক কথা বলছি। আমাদের আমলারা নিজেদেরকে বঙ্গবন্ধু প্রেমিক প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে শোষণ মুক্ত সমাজ চেয়েছেন, মানুষের স্বাধীনতার কথা বলেছেন, দাসত্বের অবসান চেয়েছেন তা কি আপনারা বাস্তবে করছেন? আপনারা ভুল পথে হাঁটছেন বলে উন্নয়ন হয়ে যাচ্ছে কালিমাযুক্ত- থাকছে রক্তের দাগ অথবা ঘামের গন্ধ। আমরা যারা উপরতলার মানুষ বলে গর্ব করি তাদের কর্তব্য স্বাধীনতাকে অর্থবহ করবার চেষ্টা করা। আমাদের সমাজে যে সংকট আছে সেগুলো সৃষ্টি হচ্ছে স্বাধীনতাকে বুঝতে না পারার জন্য। উন্নয়ন হোক স্বাধীনতার পাটাতনে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭