এডিটর’স মাইন্ড

হায় মানবাধিকার : তুমি কার?


প্রকাশ: 27/08/2022


Thumbnail

শেফালী রানী দাস। ২৩ বছর বয়সে পুকুরে পানি আনতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান। অপচিকিৎসার কারণে বাঁ পায়ের নিচের অংশ পচে যায়। পরে হাঁটুর ওপর থেকে তাঁর বাঁ পা কেটে ফেলা হয়। এক পা নিয়েই পঙ্গুজীবন যাপন করছিলেন চরফ্যাশনের দুই সন্তানের জননী শেফালী। কিন্তু ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর পঙ্গু শেফালী রক্ষা পাননি। সংসদ নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর রাতে সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে শেফালীদের গ্রামে। অন্য নারীরা যখন জল-কাদা ভেঙে পালিয়েছেন তখন ক্র্যাচের ওপর ভর করে শেফালী কোমরপানি পেরোতে পারেননি। একজন অসহায় পঙ্গু নারীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার বদলে সন্ত্রাসীরা তাঁকে ধরে ফেলে। কেড়ে নেয় তাঁর ইজ্জত। ২০০১ সালের অক্টোবর বাংলাদেশজুড়ে এ রকম ঘটনা ঘটেছে নির্বিচারে। ‘সন্ত্রাসীরা লুট করে যে মালামাল নিয়ে গেছে তা নিয়ে আমাদের এতটুকু দুঃখ নেই। কিন্তু গ্রামের নারীদের ইজ্জতের ওপর যে হামলা হয়েছে সেই লজ্জা আর অপমান কীভাবে ভোলা সম্ভব।’ ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চরঅন্নদাপ্রসাদ গ্রামের একজন হিন্দু নারী ২০০১ সালের নির্বাচনের পর এভাবেই তাঁর অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন।

আজ যখন বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে কিছু মহলের মাতম উঠেছে তখন ২০০১ সালের অক্টোবরের কথা খুব মনে পড়ল। এর মধ্যেই ‘আয়নাঘর’ নামে এক প্রামাণ্যচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। প্রামাণ্যচিত্রে একজন মালয়েশিয়াপ্রবাসী ব্যক্তি যেন হিন্দি ছবির নায়ক। চোখ বাঁধা অবস্থায় অবলীলায় তিনি বলে গেলেন তাঁকে কোথায় কীভাবে কোন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আরেকজন প্রায় অপ্রকৃতিস্থ সাবেক সেনা কর্মকর্তা বুক চিতিয়ে বললেন, বাবরের (লুৎফুজ্জামান বাবর) সময় কীভাবে তাঁকে বিভিন্ন ব্যক্তিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। রাজশাহী, চট্টগ্রামে তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড করেছেন, এমন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিলেন। কসম খেয়ে বললেন বিনা অপরাধে কাউকে তিনি হত্যা করেননি। বাঃ, কী অদ্ভুত! বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর তাহলে আদালত, আইন, বিচার ছাড়াই হত্যার নির্দেশ দিতেন? এ আয়নাঘর প্রচারের পর বিএনপি নেতারা ‘আয়নাঘর’ ‘আয়নাঘর’ বলে জিকির শুরু করেছেন। সুশীলসমাজ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় মুষড়ে পড়েছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন যেন এখন এক ভয়ংকর ইস্যু। আহারে কী কান্ড! সব দেখেশুনে মনে হলো, হায় মানবাধিকার! তুমি আসলে কার? মিশেল ব্যাচলেটের সুপারিশ আর আয়নাঘর-পরবর্তী কিছু ব্যক্তির চিৎকার-চেঁচামেচির কারণ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ প্রচারণা। এ প্রচারণার টার্গেট করা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীকে। এ প্রচারণা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের অস্তিত্ব এবং সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। এ প্রচারণার লক্ষ্য আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। বিতর্কিত করা।

২০২০ ও ২০২১ সালে একই রকম নোংরা খেলা শুরু হয়েছিল এলিট ফোর্স র‍্যাবের বিরুদ্ধে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আলজাজিরায় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ নামে একটি বিতর্কিত তথ্যচিত্র প্রচার করা হলো। বিতর্কিত এ প্রতিবেদনে তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু মনগড়া অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছিল। ওই বছর (২০২১) ১০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। যাঁরা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ নির্মাণের হোতা ছিলেন তাঁরাই আয়নাঘর বানিয়েছেন। সেই একই মুখ। এবার তাঁদের টার্গেট সেনাবাহিনী। বাংলাদেশে মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে মায়াকান্না শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়। ’৭৫-এর পর থেকে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি বিত্তবৈভবে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী অঙ্গীকারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ঘোষণা দিয়েছিল। সে সময় খুব কম মানুষই বিশ্বাস করেছিল রাঘববোয়াল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা যা বলেন, তা করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও তিনি অসীম সাহসের সঙ্গে শুরু করলেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা হায়দার আকবর খান রনো আমাকে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী না থাকতেন আওয়ামী লীগও যদি ক্ষমতায় থাকত তা হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো না।’ যা হোক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলেই বিপুল বিত্তের মালিক এই গোষ্ঠী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনকে ভাড়া করে। যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এরাই প্রথম বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন তোলে। তখন থেকেই ‘মানবাধিকার’ ইস্যু লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। এইচআরসির মতো সংগঠনগুলো বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে নানা তথ্য জানতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাস এসব তথ্য জানায়নি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছেও একাধিক চিঠি দিয়েছিল। জানতে চেয়েছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ কতটা সত্য। ৭৬ জনের তালিকা দিয়ে তাদের অবস্থান জানতে চেয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে তখন থেকেই ‘মিউজিক্যাল পিলো’ খেলেছে। আন্তমন্ত্রণালয় চিঠি চালাচালি প্রতিযোগিতা হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে সঠিক জবাব দেয়নি। ফলে ১০ ডিসেম্বর র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। এরপর শুরু হলো বাংলাদেশের দৌড়ঝাঁপ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বললেন, ‘তাই নাকি! আমি তো কিছুই জানি না।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলল, ‘এ তো ভীষণ অন্যায়।’ কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। যাঁরা র‍্যাবকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তাঁরা সফল হয়েছেন। এখন শুরু হয়েছে সেনাবাহিনীকে নিয়ে ষড়যন্ত্র। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলে গেলেন ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে।’ তিনি গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগগুলো সুরাহার স্বার্থে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করলেন। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল বাংলাদেশ এ প্রস্তাবের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কেন এ গড়িমসি? কেন এ উপেক্ষা?

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে আসেন। এসেই তিনি তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিনে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে মিলিত হন সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত ২০ ব্যক্তির সঙ্গে। ওই বৈঠকের আগেই ‘নেত্র নিউজ’ প্রকাশ করে ‘আয়নাঘর’। ২০ জন আমন্ত্রিত আয়নাঘরের ভাষায় কথা বলেন। মিশেল বিদায়ের কালে প্রচ্ছন্নভাবে জানিয়ে গেলেন, তাঁদের কথাই তিনি বিশ্বাস করেছেন। সাধারণত এ ধরনের ঘটনায় সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বৈঠক করেন শেষে। যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয় সরকারের পক্ষ থেকে তার জবাব দেওয়ার এক সুযোগ থাকে। কিন্তু মিশেলের বৈঠকে সরকার বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে সুযোগ রাখেনি, কেন? এটা কি অদক্ষতা নাকি ষড়যন্ত্রের অংশ?

১৫ আগস্টে কথিত মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের বৈঠক নিয়ে আমার কিছু কথা আছে। জাতীয় শোক দিবসে এ রকম একটি বৈঠকের আয়োজন করা হলো কেন? ওই বৈঠকে কি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছিল? ১৫ আগস্টের শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছিল? জাতীয় শোক দিবসে মানবাধিকার নিয়ে আলাপে যদি ১৯৭৫-এর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ না আসে, তাহলে বুঝতে হবে ওই বৈঠক উদ্দেশ্যপূর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট। ওই বৈঠকের পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে। ১৫ আগস্টের খুনিদের প্রেতাত্মারাই মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা হয়েছে।

১৯৭৫ সালে যখন জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো তখন কোথায় ছিল মানবাধিকার? জাতির পিতার হত্যার বিচার বন্ধ করে যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হলো তখন কোথায় ছিল মানবাধিকার? ১৯৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত গুম-হত্যাকান্ড ঘটেছে প্রতিনিয়ত। কর্নেল তাহের হত্যাকান্ড, বিনা বিচারে হাজার হাজার সৈনিককে কারাগারে হত্যা করা হলো। তখন কোথায় ছিলেন আমাদের মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা? ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে যে তান্ডব চালাল তার আঁচ করা যাবে সে-সময়কার সংবাদপত্রগুলো থেকে : ফেনী ও সোনাগাজীতে বিএনপি সন্ত্রাসীদের হাতে দুই আওয়ামী লীগ কর্মী খুন (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৪ অক্টোবর ২০০১)

নৌকায় ভোট দেওয়ায় মিরপুরে বিএনপি ক্যাডারদের তান্ডব। (দৈনিক সংবাদ, ৪ অক্টোবর ২০০১)

রাজধানীতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ অক্টোবর ২০০১)

মাদারীপুরে ছাত্রলীগ নেতার হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে বিএনপি কর্মীরা (দৈনিক প্রথম আলো, ১১ অক্টোবর ২০০১)

ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের কান্ড। সিরাজগঞ্জে বাড়িতে চড়াও হয়ে সংখ্যালঘু স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে ধর্ষণ। (দৈনিক প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর ২০০১)

এ রকম অসংখ্য শিরোনাম দিয়েই এ পত্রিকা ভরিয়ে দেওয়া যায়। সে সময় একজন পন্ডিতকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এই যে মানবতার লাঞ্ছনা, অপমান আপনি কী বলবেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘বিএনপিকে আরও সময় দিতে হবে।’ রাজনৈতিক নিপীড়ন, প্রতিপক্ষকে হত্যা-ধর্ষণ এসব না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে অপারেশন ক্লিনহার্টকে কী বলবেন? অপারেশন ক্লিনহার্টে মারা গেছেন ৫৮ জন। ২০ হাজারের বেশি মানুষ নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৮৬ দিনব্যাপী এ অভিযান চলার পর ‘দায়মুক্তি’র অধ্যাদেশ জারি করা হলো। এর মাধ্যমে ২০০২-এর ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর সব হত্যা ও নির্যাতনের বিচার রোধ করে দায়মুক্তি দেওয়া হলো। তখন মানবাধিকার নিয়ে কাউকে হাহাকার করতে দেখিনি। জাতিসংঘকে কোনো সুপারিশ দিতেও শুনিনি। যুক্তরাষ্ট্রও কারও ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কময় দিন। ওই দিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা হলো। তখন কোথায় ছিলেন আমাদের মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা? মানবাধিকার কি তাহলে শুধু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য অস্ত্র?

এখন ৭৬ জনের গুম নিয়ে হইচই হচ্ছে। এ গুম নিয়ে ‘আয়নাঘর’ থ্রিলার নির্মিত হয়েছে। আয়নাঘর নিয়ে বিএনপি এবং সুশীলরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন। আয়নাঘর দেখে আমার জজ মিয়ার কাহিনি নতুন করে মনে পড়ল। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জজ মিয়াকে আবিষ্কার করেছিল। তাকেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল হোতা বানিয়ে দেওয়া হলো। এখন জজ মিয়ার মতোই গুম-ফেরত আবিষ্কার করা হচ্ছে। তাদের দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে কথা বলে সেনাবাহিনীর অবমাননা করা হচ্ছে। সেই একই খেলা। একই কৌশল।

এখন বিএনপি নেতারা যখন আয়নাঘর এবং গুম নিয়ে কথা বলেন তখন আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে নির্বিচারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, নির্যাতন হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যা হয়েছে তা অন্য দেশে হলে তদন্ত হতো। বিচার হতো। দুর্ভাগ্য আমাদের। মানবতার বিরুদ্ধে এসব অপরাধ ‘রাজনৈতিক বাস্তবতা’ হিসেবে পার পেয়ে গেছে। এখন সুশীলসমাজের প্রধান ইস্যু মানবাধিকার। কদিন তাঁরা অর্থনীতি গেল বলে কোরাস তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁদের অভিভাবক বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ যখন বলল, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট নেই। ঠিক পথেই আছে অর্থনীতি, তখন তাঁরা অর্থনীতি থেকে মানবাধিকারে মনোনিবেশ করলেন। এই বিজ্ঞ পন্ডিতদের জ্ঞানের ব্যাপ্তি দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। কোন বিষয়ে তাঁদের পান্ডিত্য নেই! ডিম থেকে মুরগি। করোনা থেকে ম্যাডোনা। অর্থনীতি, পরিবেশ, মানবাধিকার। সব বিষয়ে তাঁরা সবজান্তা শমসের। মিশেলের আমন্ত্রণে শোক দিবসে যাঁরা মানবাধিকার চর্চা করতে গিয়েছিলেন তাঁদের একজন পরিবেশ আইনজীবী। তিনি হঠাৎ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলেন কীভাবে? কথক অর্থনীতিবিদও মানবাধিকার নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত দিলেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দেশে হাতে গোনা ২০-২৫ জন সুশীল-সভ্য মানুষ সব বিষয়ে সরকারের দোষ খুঁজতে ১২ বছর ধরে দুরবিন নিয়ে ঘুরছেন। যাঁরা পদ্মা সেতু হবে না বলেছিলেন, যাঁরা বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পাবে না বলে জ্যোতিষী হয়েছিলেন, যাঁরা করোনার সময় বাংলাদেশে মহামারি হবে বলে মুচকি হেসেছিলেন, অর্থনীতি ধ্বংস, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হচ্ছে বলে যাঁরা চিয়ার্স বলে রেড আর হোয়াইট ওয়াইনের গ্লাস ঠোকাঠুকি করেছিলেন তাঁরাই এখন মানবাধিকারের দোকান খুলে বসেছেন। কেন? শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য? কিন্তু শেখ হাসিনাকে পরাজিত করতে গিয়ে তো তাঁরা দেশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কি এতই ভয়াবহ? সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফক্স নিউজ সে দেশের নাগরিকদের ওপর এক জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপে ৬৭ ভাগ মার্কিন নাগরিক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি অনিরাপদ রাষ্ট্র। উপর্যুপরি বন্দুক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ফক্স নিউজ এ জরিপ করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফ্লোরিডার বাসায় এফবিআই কিছুদিন আগে অভিযান চালাল। ওই অভিযানের পর জো বাইডেন প্রশাসনকে ট্রাম্প মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বমোড়ল। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে কারও টুঁশব্দ করার নেই। কিন্তু পাকিস্তান, ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি তো ভয়াবহ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘পাকিস্তানে ন্যূনতম মানবাধিকার নেই।’ কই পাকিস্তানের ওপর তো কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই! পাকিস্তানকে তো স্বাধীন কমিশন করতে বলা হয়নি। এ সরকার এবং বাংলাদেশকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যেই মানবাধিকার ইস্যু এখন বেলুনের মতো ফোলানো হচ্ছে। এদের লক্ষ্য খুব পরিষ্কার। নির্বাচনের আগে এরা সেনাবাহিনী সম্পর্কে আরও ভয়ংকর অবিশ্বাস্য মিথ্যাচার করবে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় সেটাই এ ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত ধাপ। তারা যে এই ষড়যন্ত্রে অনেক দূর এগিয়েছে মিশেলের সংবাদ সম্মেলন তার একটা প্রমাণ। আগামী নির্বাচন যেন না হয় সেজন্যই পর্দার আড়ালে নানা ধরনের খেলা শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে কিছু নীতিগত বিপ্লব করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো সংবিধানে ৭(ক) যুক্ত করা। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের পথ তিনি চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন। আরেকটি নীরব বিপ্লব করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেটি হলো সেনাবাহিনীকে একটি নিরপেক্ষ, পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। পেশাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধির সব ব্যবস্থা করে তিনি সেনাবাহিনীকে রাজনীতির হাতিয়ার হওয়ার প্রবণতা থেকে দূরে রেখেছেন। এ কারণেই সেনাবাহিনী এখন দেশের রাজনৈতিক বিষয়ে নিজেদের দূরে রাখে। এখানেই সুশীলদের রাগ এবং ক্ষোভ। এ কারণেই প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় নানা রকম নালিশ যাচ্ছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রতিদিন গণতন্ত্র, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে সবক দিচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোও আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের অংশ নেওয়ার পর বিএনপি আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ফিরে গেছে।

জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিও এখন অচেনা মানুষের মতো আচরণ করছে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি যদি বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলে তারা নির্বাচন করবে না। তাহলে আবার ২০১৪ সালের মতো একটি একতরফা নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি হবে। এই সময়ে যদি সেনাবাহিনীর ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা যায় তাহলে সুশীলদের ক্ষমতা আরোহণের পথ সৃষ্টি হয়। আমি নিশ্চিত সুশীল ও রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত প্রধানমন্ত্রী জানেন। ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য তিনি কী করবেন? র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এখানেও ঘাপটি মেরে ষড়যন্ত্রকারীরা থাকতে পারে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নামের সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানটি অথর্বদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। এও আমলাদের চক্রান্ত কি না খতিয়ে দেখা দরকার। এখন জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলোকে ফাইলবন্দি করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বহু যোগ্য মানুষ আছেন। তাঁদের কাজে লাগাতে হবে। যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেছে। এ যুুদ্ধে শেখ হাসিনাকে জিততেই হবে। এ দেশের মানুষের জন্য। ‘বাংলাদেশ’ নামের রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭