ইনসাইড থট

চাকরির নীল গরল


প্রকাশ: 07/09/2022


Thumbnail

চাকরিতে আপন বলে খুব বেশি কেউ থাকে না। বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিসে- মনে হবে সবাই বন্ধু, সুহৃদ,শুভাকাঙ্ক্ষী আসলে ফাঁকা। পরম বন্ধু মানে চরম প্রতিদ্বন্দ্বী। সর্বত্র শত্রু ভাবাপন্ন মনোবৃত্তি, চালাকি আর চাতুর্যতায় লিপ্ত সহকর্মীর নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনের আরেক নাম। এরা মুখোমুখি এক, আড়ালে আবডালে আরেক। মনে হয়, দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া সময়ের প্রবহমানতায় এখানে বড় হওয়ার সুযোগ কম থাকে। যা আগে এবং পরে সম্ভব হয়ে উঠে। ঐতিহ্যের ধারা মতেও এখানে একজন আরেকজনকে ল্যাং মারতে সিদ্ধ-হস্ত। ভালো পদায়ন বা পদোন্নতির নিমিত্ত তারা সবই পারেন। এ ক্ষেত্রে তারা কখনো কখনো নিজের ব্যক্তিত্ব বা বিবেক বিবেচনাকেও তুচ্ছ জ্ঞান করেন। এমনকি গভীরতম নিচে নেমে যেতেও কুণ্ঠিত হন না। প্রকাশিত সত্যকেও নির্বাসনে পাঠাতে তারা বেশ পটু। আকারে-আচরণে, বলনে-কথনে, নীতিতে-নতিতে এরা খুব কম সময়ের ব্যবধানে বদলে যেতে পারদর্শী। এদের বিষয়ে বাইরের শত্রুতা কখনো মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারেনা বরং অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্ধিতাই যথেষ্ট। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক নাকি লেখক আহমদ ছফাকে একবার এমন একটা কথা বলেছিলেন, 'ইনাদের বিরুদ্ধে আপনার খ্যাপে যাওয়ার দরকার কি? ইনারা তো নিজেরাই একে অপরের বিরুদ্ধে সারাক্ষণ লেগে আছে'।

২) ২০০৫ সালের শেষ দিকে দেশের একটি নদী- বিধৌত জেলার এডিসি হিসেবে আমার পদায়ন হয়। সচিবালয় থেকে যথারীতি অবমুক্ত হয়ে সেখানে যোগ দিতে যাই। তখনকার সময় পর্যন্ত সড়কের চেয়ে নৌপথের যোগাযোগ অধিকতর সুবিধাজনক ও নিরাপদ ছিল। আমি তা-ই করি। যোগদানের দু'চার দিন বাদেই কানে আসে এখানে আমার বদলির আদেশটি নাকি যথাযথ হয়নি। এমনকি বাতিল হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। আমি খানিকটা দুশ্চিন্তায় আছি। কিছু দিন আগেই তো পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিলাম। তখন মা'কে হারিয়েছিলাম। এখন অশীতিপর বাবাও অসুস্থ, আবার কি হয় -কি জানি। '৮২ বিশেষ ব্যাচের জেলা প্রশাসকও কিছুটা আভাস ইঙ্গিত পেয়েছেন। তাঁর  বাঁকা চোখের ভাষা ও বাক্য বিনিময়ের মধ্যেই প্রতিফলিত। কারণ বিষয়টা জেলার তরুণ মন্ত্রী তাঁকে অবহিত করে রেখেছেন।

৩) আরও কয়েকদিন অতিবাহিত হলে জানতে পারি, একই জেলায় কর্মরত আমারই এক ব্যাচমেট ও অন্তরঙ্গ বন্ধু এ পদটির জন্য জোর তদবির করে এসেছিলেন। এবং তাঁরই হওয়া উচিৎ, কারণ সে সময়ের হিসেবে তার অতীত শিকড়টা এ পদের জন্য  বেশ মানানসই ছিল। কিন্তু আকস্মিক ভাবে আমার আদেশ হয়ে যায়। এতে আমিও কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। এদিকে রাগে, ক্ষোভে,অভিমানে আমার বন্ধু মন্ত্রী মহোদয়ের ঢাকার বাড়িতে গিয়ে হাজির হন।

মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরমভাব সবারই জানা ছিল। কাজেই একান্ত সান্নিধ্যে উপাসীন হতে কোনো বেগ পেতে হয়নি তাঁর। সেদিনই মন্ত্রীকে জানানো হল, কাকে নিয়ে এসেছেন, তার ব্যাক-গ্রাউন্ড জানেন? জনতার মঞ্চের নেতা, বঙ্গবন্ধু হত্যার রায়ের দিন সচিবালয়ে আনন্দ মিছিল করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার দেখুন, জেলাপ্রশাসক তাকেই দিয়েছেন জেলার বিচারের দায়িত্ব! অর্থাৎ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ক'দিন বাদে আপনারা টের পাবেন স্যার।

মন্ত্রীমহোদয় যেন হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়লেন। বলেন কী! এ তো দেখছি  সর্ষের ভেতরে ভূত লুকিয়ে আছে। আমলাতন্ত্র নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ও ক্ষুব্ধ হলেন মন্ত্রী। তিনি এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের গোষ্ঠী উদ্ধার করে লিখেন এক দীর্ঘ উপানুষ্ঠানিক পত্র। এতে অবিলম্বে আমার পদায়ন বাতিলপূর্বক বন্ধুর পদায়নের বিশদ ফিরিস্তি ছিল। যা পরদিন সকালে তিনি নিজেই বহন করে মন্ত্রণালয়ে পৌঁছাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।

৪) কী আশ্চর্য! পরদিন সকালে একটি কাকতালীয় এবং বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল। মন্ত্রীমহোদয়ের গুলশানস্থ বাসভবনে পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচীতে উপস্থিত হলেন, আমাদের সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত  ছাত্রনেতা। যিনি মন্ত্রীর চেয়েও বিখ্যাত ছিলেন। যদিও আজ সেখানে অপেক্ষমাণ একজন দর্শনার্থী। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা খোলা পত্রের দিকে তার নজর পড়ে। এবং কৌতূহলের বশে এটা পাঠ করে ফেলেন। এবার মন্ত্রী এলেন, তাকে নিয়ে জমজমাট আড্ডা ও আপ্যায়ন চললো। নানা প্রসঙ্গে কথা বলার ফাঁকে চিঠিতে বর্ণিত কর্মকর্তা অর্থাৎ আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বসলো।

মন্ত্রীমহোদয়ের অকপট ভাষ্য ছিল, "আমি তাকে চিনি না, তবে তাঁর সম্পর্কে আমার কাছে এসব বলা হয়েছে- তাই। তারই এক ব্যাচমেট জানিয়েছে"।
এবার ছাত্রনেতা বললেন, আমি কিন্তু তাকে চিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছোট বাম সংগঠনের একনিষ্ঠ কর্মী ছিল। একই হলে থেকেছি। এরা সৎ এবং নীতিবান মানুষ। যতদূর জানি, তাকে দিয়ে বড়ো কোনো অন্যায় কাজ করানো সম্ভব হবে না। সে করবেও না।
মন্ত্রী বললেন, বলো কী! আমার তো এমনই দরকার। যাক ভালো হল, ওনিই থাকবে। না, এ চিঠি যাবে না।

এখানে বলে রাখা ভালো। এই ছাত্রনেতার সঙ্গে পরেও আমার দু'চারবার এদিক ওদিক আকস্মিক দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে কৃতিত্ব নেয়ার জন্যে সে কখনো এ ঘটনার কথা উল্লেখ করেনি। এখানেই বোধ করি, তাঁরা কর্মচারীদের চেয়ে বড় এবং মহৎ। বরঞ্চ বদলি হওয়ার অল্প আগে কোনো এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রীমহোদয়ই আমাকে আমার প্রিয় বন্ধুর গল্প শুনিয়েছিলেন।


চলবে...
১২ ভাদ্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭