ইনসাইড বাংলাদেশ

আকবর আলি খানের স্মরণে ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’


প্রকাশ: 08/09/2022


Thumbnail

দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি একাধারে একজন অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক এবং আমলা। তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর এরকম একটি নিবন্ধ হলো ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’। আকবর আলি খানের স্মৃতির স্মরণে বাংলা ইনসাইডারে পাঠকদের জন্য লেখাটি প্রকাশ করা হলো।

বাংলাদেশে করোনা সংকটের সময় দুর্নীতি একটি আলোচিত বিষয়। বিশেষ করে, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছিল। এ সমস্ত দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছিল সরকারি কর্মকর্তাদের নাম। দুর্নীতি বাংলাদেশে একটি বহু চর্চিত এবং বহু আলোচিত বিষয়। অনেক সময় ঘুষ লেনদেন করা হয় কাজের গতিকে বেগবান করার জন্য। আবার এরকমও দেখা গেছে যে, ঘুষ নিয়েও অনেকে কাজ করেন না। বাংলাদেশে ঘুষের প্রকৃতি প্রকরণ নিয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান তার ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ গ্রন্থে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যে প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘শুয়রের বাচ্চাদের অর্থিনীতি’। বর্তমান সময়ে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এই প্রবন্ধের চুম্বক অংশটুকু পাঠকদের জন্য এখানে উপস্থাপন করছি-

…চাণক্যের অর্থশাস্ত্রের বয়সও প্রায় দু হাজার বছর হবে। চাণক্য লিখেছেন, সরকারী কর্মচারীরা দু’ভাবে বড়লোক হয়: হয় তারা সরকারকে প্রতারণা করে, অন্যথায় প্রজাদের অত্যাচার করে। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে সরকারী কর্মচারিদের চল্লিশ ধরনের তছরুপের ও দুর্নীতির পন্থা চিহ্নিত করা হয়েছে। দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে সজাগ থাকা সত্ত্বেও চাণক্য রাজস্ব বিভাগে দুর্নীতি অনিবার্য মনে করতেন। অর্থশাস্ত্রের দুটি অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ ইংরেজি রূপান্তর করা হয়েছে।

Just as it is impossible not to taste honey or poison that one may find at the tip of one’s tongue, so it is impossible for one dealing with government funds not to taste, at least a little bit of the king’s wealth. Just as it is impossible to know when a fish moving in water is drinking it, so it is impossible to find out where government servants in charge of undertaking misappropriate money.

(জিহবার ডগায় বিষ বা মধু থাকলেও তা না চেটে থাকা যেমন অবাস্তব তেমনি অসম্ভব হলো সরকারের তহবিল নিয়ে লেনদেন করে একটুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা। জলে বিচরণরত মাছ কখন জল পান করে তা জানা যেমন অসম্ভব তেমনি নির্ণয় সম্ভব নয় কখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারিরা তহবিল তছরুপ করে)।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মত বাংলাদেশেও ব্যাপক দুর্নীতি ছিল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে দুর্নীতির জীবন্ত বর্ণনা রয়েছে। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম লিখেছেনঃ  

                “সরকার হইলা কাল              খিল ভুমি লিখে লাল

                              বিনা উপকারে খায় ধুতি’’

সরল ভাষায় এর অর্থ নিম্নরূপঃ রাজস্ব কর্মকর্তা (সরকার) অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনাবাদী জমিকে কর্ষিত জমি গণ্য করছে (যার ফলে অতিরিক্ত খাজনা দিতে হবে) এবং ধুতি ঘুষ নিয়েও সঠিকভাবে কাজ করছে না। মুকুন্দরামের লেখা পড়ে মনে হয় ঘুষ দেওয়াতে তাঁর দুঃখ নেই। তাঁর দুঃখ হল ধুতি উৎকোচ দিয়েও কাজ হচ্ছে না। ষোড়শ শতকের বাঙ্গালী কবি ও ক্যারিটের বর্ণিত পাঞ্জাবী ঠিকাদারের নালিশ একইঃ “ শুয়র কা বাচ্চারা” জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। বাংলা লোক সাহিত্যেও  এই ধরণের দুর্নীতির উল্লেখ রয়েছে। মলুয়া লোকগীতিতে স্থানীয় কাজী সম্পর্কে নিম্নরূপ বর্ণনা দেখা যায়ঃ

              “বড়ই দুরন্ত কাজী ক্ষেমতা অপার

        চোরে আশ্রা দিয়া মিয়া সাউদেরে দেয় কার

               ভাল মন্দ নাহি জানে বিচার আচার

             কূলের বধূ বাহির করে অতি দুরাচার।’’

(বড় দুরন্ত কাজীর অপার ক্ষমতা রয়েছে। সে চোরকে আশ্রয় দেয়, সাধুকে দেয় কারাবাস, ভাল মন্দ বা আচার বিচার জানে না। সে এতই খারাপ যে কুলের বধূদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে)।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ ধারণাই স্পষ্ট হয় যে, দুর্নীতি এ দেশে মোটেও অভিনব নয়। অন্যান্য সমাজেও দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি রয়েছে। দুর্নীতি একটি অতি পুরানো ও জটিল সামাজিক সমস্যা হওয়া সত্ত্বেও অর্থনীতিবিদরা তাঁদের তত্ত্বে দুর্নীতির ক্ষতিকর দিকসমূহ দীর্ঘদিন ধরে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। এই উপেক্ষার কারণ দুটিঃ একটি ঐতিহাসিক ও অন্যটি তাত্ত্বিক।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, দুর্নীতির সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো বৈরিতা নেই। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, দুর্নীতির পঙ্কেই  বিকশিত হয়েছে পুঁজিবাদের শতদল। ইউরোপে অনেক পুঁজিপতিই  জীবন শুরু করেন একচেটিয়া  ব্যবসায়ের লাইসেন্সের এবং কর ইজারার মত সরকারী দায়িত্বের   অপব্যবহার করে। উনবিংশ শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাদেশিক ও  স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি বিশ্ব –বিশ্রুত। লুণ্ঠন হতে প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহ করে যারা বড়লোক হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তারাই দস্যু-কুবের (robber baron) নামে পরিচিত। চীন দেশে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছেঃ বড় ধরণের ডাকাতরা ব্যাংক স্থাপন করে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে দুর্নীতি সত্ত্বেও উন্নত দেশসমূহে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। তবে এ সব তথ্যের ভিত্তিতে দুর্নীতি ও উন্নয়নের মধ্যে কোন কার্যকারণ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

তাত্ত্বিক দিক থেকেও অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন যে, দুর্নীতি উন্নয়নের জন্য সহায়ক। পুঁজিবাদের বিকাশের পথে রাষ্ট্রযন্ত্রে যে সব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া তাদের অপসারণ সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে প্রশাসনিক অচলায়তনে দুর্নীতির মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে বিভিন্ন বাধা এড়ানো সম্ভব হয়। ঘুষের মাহাত্ম্যে লাল ফিতার দৌরাত্ম্যকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত পাওয়া সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শক হান্টিংটন তাই ফতোয়া দেন, অতি কেন্দ্রীভূত সৎ আমলাতন্ত্রের চেয়ে। অতি কেন্দ্রীভূত ঘুষখোরে আমলাতন্ত্র শ্রেয়। অবশ্য এ ধরনের যুক্তির দুর্বলতা রয়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্তের জন্য একবার ঘুষ দেওয়া শুরু হলে, ঘুষ ছাড়া কোন সিদ্ধান্তই পাওয়া যাবে না। ঘুষ না পাওয়া পর্যন্ত সকল সিদ্ধান্তই আটকে থাকবে। দীর্ঘ মেয়াদে দুর্নীতি দ্রুত সিদ্ধান্তের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।

হান্টিংটন সাহেবের বক্তব্যের সব চেয়ে বড় দুর্বলতা হল যে, তিনি দুর্নীতি- পরায়ণ আমলাদের নেহাত খারাপ লোক মনে করেন। কিন্তু তিনি ‘‘ শুয়রের বাচ্চা’’ পর্যায়ের আমলাদের কথা চিন্তা করেননি। আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ বলছেন, ঘুষ হচ্ছে এক ধরণের অলিখিত চুক্তি। আদালতের মাধ্যমে এ ধরণের চুক্তি কার্যকর করা সম্ভব নয়। বিশ্বাস ভঙ্গের সম্ভাবনা এখানে বেশি। তাই অর্থনীতিবিদরা দু’ ধরণের দুর্নীতির মধ্যে তফাৎ করে থাকেনঃ নির্ভরযোগ্য (predictable) দুর্নীতি ও অনির্ভরযোগ্য (unpredictable) দুর্নীতি। নির্ভরযোগ্য দুর্নীতি হলো সে ধরণের ব্যবস্থা যেখানে ঘুষ দিলে লক্ষ্য অর্জিত নিশ্চিত।  বিনিয়োগকারীদের এ ধরণের দুর্নীতিতে অরুচি নেই, বরং এ ধরণের দুর্নীতি তারা পছন্দ করেন, কেননা ঘুষ দিয়ে তাড়াতাড়ি  কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো অনির্ভরযোগ্য দুর্নীতি, যাকে মাইকেল ক্যারিট সাহেব “শুয়রের বাচ্চাদের” দুর্নীতি বলে অভিহিত করেছেন। অনির্ভরযোগ্য দুর্নীতি ঘুষ দিয়েও কার্যসিদ্ধির কোন নিশ্চয়তা নেই। বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, একনায়কত্ব ও কেন্দ্র্রীভূত শাসন ব্যবস্থা নির্ভরযোগ্য দুর্নীতির জন্য অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে। যেখানে ক্ষমতা খণ্ডিত সেখানে ঘাটে ঘাটে নজরানা দিতে হয়। এর ফলে ঘুষ বাবদ ব্যয় বেড়ে যায়। অন্যদিকে বহু সংখ্যক ব্যক্তি ঘুষের ক্ষেত্রে নিমকহালালি করবে তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাই ‘শুয়রের বাচ্চা’ কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেখা দিতে পারে।…

(সংক্ষেপিত)


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭