ইনসাইড থট

সাজাহান: সম্রাটের অসহায়ত্ব  


প্রকাশ: 14/09/2022


Thumbnail

প্রতিদিনের মতো আজও পাঠক সমাবেশের কর্ণার টেবিলের নির্ধারিত আসনে উপবিষ্ট হই। পূর্ববর্তী কোনো পাঠকের পঠিত বা কর্ষিত দুটো বই গ্লাসের টেবিলের ওপর পড়ে আছে। একটা William Dalrymple এর The Last Mughal: The fall of Dynasty। অপরটি 'সাজাহান' দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এর বিখ্যাত একটি ঐতিহাসিক নাটক। প্রথম বইটা পূর্ব থেকেই আমার দখলে রয়েছে বিধায় এবং এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে সামান্য ধারণা আছে বলে স্পর্শ করি নি। এতে মুঘলদের সর্বশেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বার্মা নির্বাসন এবং উত্তরাধিকার নিয়ে গবেষণামূলক আলোকপাত করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে বিখ্যাত একটি পুস্তক।  কিন্তু আমার আগ্রহ জন্মালো দ্বিতীয় বই 'সাজাহান' নিয়ে। যা মুঘল সম্রাট শাহজাহানের জীবন কাহিনির নাট্যরূপ। উল্লেখ্য, কলেজ জীবনে মুনীর চৌধুরী'র 'রক্তাক্ত প্রান্তর' নাটকের ইব্রাহিম কার্দি'র ডায়লগ মুখস্থ করার পরে আর কিছু মনে পড়ে না। এমনিতেও নাটকের বই পড়ার অভ্যেস বা অভিজ্ঞতা আমার খুব বেশি নেই বললেই চলে। 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যাঁকে বাঙালি পাঠকরা ডি,এল, রায় নামেই জানেন এবং চিনেন। কবি ও গীতিকবি হিসেবে তাঁর খ্যাতি রবীন্দ্রনাথের কাছেও ঈর্ষনীয় হয়ে উঠেছিল। ১৮৬৩ সালে জন্মগ্রহনকারী মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে প্রয়াত এ কবি কাব্যসাহিত্যের প্রতিভা বিচারে পঞ্চকবিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন। তাঁর দেশের গানের অতুলনীয় বাণী ও সুর এখনো বাঙালির চিত্তবিত্তের খোরাক। বলা হয়, বাংলা নাটকের ২০০ বছরের গৌরবময় ইতিহাসেও ডি, এল, রায় এক অনন্য সাধারণ স্থান দখল করে আছেন। বিশেষ করে তার ইতিহাসভিত্তিক নাটকগুলোর ট্রেজেডি কালোত্তীর্ণ হয়েছে। কেবল মুঘল যুগকে অবলম্বন করেই তিনি মোট পাঁচটি নাটক রচনা করেছিলেন। তবে তাঁর 'সাজাহান' ও 'নূরজাহান' আজও জনপ্রিয়তার নিরিখে ভাস্বর হয়ে আছে। সাজাহান একাধারে লাভ করেছে সমকালীন মঞ্চসাফল্য ও চিরকালীন নাট্যসাহিত্যের মর্যাদা। বলাবাহুল্য, গিরিশচন্দ্রের 'সিরাজুদ্দৌলা' আর দ্বিজেন্দ্রলালের 'সাজাহান' উভয় নাটকে বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুর চিরায়ত আবেগ ও দেশপ্রেমকে প্রবলভাবে মূল্য দেয়া হয়েছে। নাটকের প্রতিটি সংলাপ এবং স্বগত- সংলাপ তখনকার দর্শক শ্রোতার হৃদয়কে আন্দোলিত করতে সক্ষম হয়েছিল। যা শতাব্দী পেরিয়ে আজোবধি মঞ্চনাটকের প্রতীক চিহ্ন হয়ে আছে। সাজাহান নাটকের প্রধান চরিত্র চিত্রনে দেখা যায় ,ভারতবর্ষের সম্রাট শাহজাহান, তাঁর চার পুত্র, দু'জন নাতি, কন্যা জাহানারা, পুত্রবধূদ্বয় ও অন্যান্য কয়েকজন উপস্থিত  আছেন। 

মনে পড়ে,  সেই--কবে সত্তুরের দশকের প্রান্তে স্কুলের একজন ইতিহাসের শিক্ষক বলেছিলেন, "আওরঙ্গজেবের সোজা হইয়া দাঁড়াইবার মুরাদ নাই "। অর্থাৎ সম্রাট শাহাবুদ্দিন মুহম্মদ শাহজাহান (যিনি শাহজাদা খুররম নামেও পরিচিতি ছিলেন)। তাঁর চার ছেলের নাম মনে রাখার জন্যই এমন অসাধারণ বাক্যের জনশ্রুতি। বিস্ময়কর যে, আমিও মনে রেখে চলেছি অন্তত পঁয়তাল্লিশ বছর যাবৎ। নাটকের চরিত্র হিসেবে দারা, সুজা, আওরঙ্গজেব, মুরাদ ও জাহানারার উপস্থিতি মুখ্য। আমি সাজাহান নাটকের সংলাপ পড়তে পড়তে ভেতরে প্রবেশ করি। প্রায় এক'শ পৃষ্ঠার কাছাকাছি একখানা বই। চিরায়ত গ্রহ্ন সিরিজের অংশ হিসেবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এটি পুনঃপ্রকাশ করে। ডি, এল, রায়ের রচনায় তাঁর ভাষার যাদুকরী হাতের ছোঁয়া আমাকে দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করে তোলে। যেন কুশীলবদের কন্ঠস্বরে ধ্বনিত হয়েছে এক একটি শিক্ষণীয় বাক্য এবং কূটকৌশল। রাজ- রাজন্য ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে  উত্তরাধিকার নিয়ে সম্রাটের কঠিন সিদ্ধান্ত কিভাবে ভেস্তে যায় তারও বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে এ নাটকে। সম্রাটের চার ছেলের প্রকাশ্যে বিভক্তি এবং একজনের হাতে দু'জনের জীবনাবসান অপরজন আরাকানে পালিয়ে গিয়ে বাঁচে। এসব ইতিহাসেরই টুকরো কাহিনির অংশ। তবে এ নাটকের কাহিনিতে ট্রেজেডির স্থানই প্রাধান্য পায়। 

তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে গৃহবন্দী হওয়া মুঘলদের আলোচিত পঞ্চম সম্রাট যিনি ৭৪ বছরের জীবনকালের ৩০ বছর (১৬২৮-১৬৫৮) দিল্লির সিংহাসনের ঈশ্বর ছিলেন। চতুর্থ স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতির স্মারক হিসেবে ৫০ লক্ষ মুদ্রা ব্যয়ে ২০ হাজার লোক ২২ বছরে নির্মান করে বিশ্বের বিস্ময় তাজমহল, ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ময়ুর-সিংহাসন, মতি-মসজিদসহ বিচিত্র সব কর্মের জন্য কিংবদন্তি হয়ে আছেন। ১৪ সন্তানের জনক বন্দী জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হলে কন্যা জাহানারা ভাই আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার লক্ষে বাবাকে যেন অতীতের বীরত্বগাথা ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছেন, তাঁর সংলাপের অগ্নিবাক্য যেন ধনুকের মতো- "বাবা এই কারাগারের কোণে বসে অসহায় শিশুর মতো ক্রন্দন করলে কিছু হবে না ; পদাহত পঙ্গুর মতো বসে দন্তে দন্তে ঘর্ষণ করে অভিশাপ দিলে কিছু হবে না। উঠুন, দলিত ভুজঙ্গের মতো ফণা বিস্তার করে উঠুন; হৃতশাবক ব্যাঘ্রের মতো প্রমত্ত বিক্রমে গর্জে উঠুন ; অত্যাচারে ক্ষিপ্ত জাতির মতো জেগে উঠুন, নিবৃত্তির মতো কঠিন হউন, হিংসার মতন অন্ধ হউন ; শয়তানের মতো ক্রুর হউন। তবেই তার সঙ্গে পারবেন "।

সাজাহান নাটকের এমন সংলাপ আমাকে শিহরিত করে তোলে। আমি আপ্লূত হয়ে শেষাবধি গমন করি। আরও মজার ব্যাপার হলো, ডি, এল, রায়ের একটি গান অনেক দিন থেকে শুনি। যার বাণী ও সুরে বাঙালির আবহমানতার স্বাদ জেগে থাকে। দেখি গানটি সাজাহান নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে সংযোজিত।

'"বেলা বয়ে যায়--
ছোট্ট মোদের পানসীতরী সঙ্গেতে কে যাবি আয়।
দোলে হার -- বকুল যুঁথি দিয়ে গাথা সে,
রেশমি পাল উড়ছে মধুর মধুর বাতাসে ; 

কাজেই বইটা আজই আমার সংগ্রহে নিলাম। 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭