ইনসাইড পলিটিক্স

সাজেদা চৌধুরী এবং শাহ মোয়াজ্জেম: রাজনীতির এপিঠ-ওপিঠ


প্রকাশ: 15/09/2022


Thumbnail

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, একজন সাদামাটা রাজনীতিবিদ। পঁচাত্তর পূর্ববর্তী রাজনীতিতে কোনো আলোচনায় ছিলেন না তিনি। বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকরা হত্যার পর দেশের রাজনীতিতে অশনি সংকেত দেখা যায়। রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়ে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তখন দেশের বাহিরে। সংকটকালীন ওই সময় সাহসিকতার সঙ্গে সামনে আসেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। রাজনীতিতে তিনি শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দেশের রাজনীতির বাতিঘর হয়েই সামনে এলেন। ওই সময় রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়া আওয়ামী লীগকে পুনরুদ্ধার এবং পুনর্গঠনে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তখন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে পারবে না।’ আওয়ামী লীগের চরম কঠিন সময়ে তিনি যেমন নির্ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তেমনি শেখ হাসিনার প্রতি তার বিশ্বস্ততা এবং আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। যখনই কোনো সংকটে শেখ হাসিনা একাকী অনুভব করতেন তখনই তার পাশে গিয়ে দৃঢ়চিত্তে দাঁড়াতেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।

১৯৮২ সালে আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাকশাল গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে যায়। সেসময় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।যখনই কঠিন সময় এসেছে তখনই সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ছুটে এসেছেন শেখ হাসিনার কাছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় যখন শেখ হাসিনাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়, সেই সময়ে  জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে আওয়ামী লীগকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী রাজনৈতিক জীবনে কোনো ভ্রান্তি নেই, পদস্খলন নেই। পুরো রাজনৈতিক জীবনে তিনি একটি মুহূর্তের জন্যও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। বরং সারাটা জীবন তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অনুগত ছিলেন। আওয়ামী লীগের সংকটে তিনি দলকে আগলে রেখেছেন। আর যে কোনো বিভ্রান্তিতে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। রাজনীতিতে পাদপ্রদীপে না থাকলেও আদর্শে অবিচল থাকা, সঙ্কটেও আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়ে একনিষ্ঠভাবে দলের প্রয়োজনে কাজ করে যাওয়া এই রাজনীতিবিদ ইতিহাসে একজন মহান রাজনীতিবিদ হিসেবে পেয়েছে অমরত্ব।

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ঠিক বিপরীত মেরুতেই শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। বহু আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া এই নেতা ১৯৫২ সালে নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তার ঠিকানা ছিল মূলত কারাগার। ওই সময় রাজনীতিতে তিনি ছিলেন বেশ প্রভাবশালী এবং আলোচিত একজন নেতা। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের রাজনৈতিক হাতেখড়ি শুরু হয় ছাত্রলীগে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আনুকূল্যে তিনি ছাত্রলীগের নেতা হয়েছিলেন। ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও তিনবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পার্লামেন্টে প্রথমবারের মতো চিফ হুইপ নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর দ্বিতীয়বারের মতো চিফ হুইপ নির্বাচিত হন তিনি।

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এ দেশে অনেক প্রথিতযশা রাজনীতিক তৈরি করেছেন। কিন্তু এই তুখোড় এই রাজনীতিবিদ ওই সময় জনপ্রিয় হলেও তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত বিশ্বাসঘাতক এবং সুবিধাবাদী। তিনি কোনো আদর্শেই অবিচল ছিলেন না। তার আদর্শ ছিল বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা এবং হত্যা। আদর্শ নয় বরং ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে সবসময় প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যদিয়েই রাজনীতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের আসল রূপ প্রকাশ্য হতে শুরু করে। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড এবং জেল হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সঙ্গে ভালো সখ্যতা ছিল তাঁর। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁর রক্তের ওপর হেঁটে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। এরপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভা থেকে যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব, এরশাদ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ উপনেতা ও উপ-প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। এরশাদের পতনের পর সুবিধাবাদী এই রাজনীতিবিদ বিএনপিতে যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন যদি  রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি অবিচল থাকতেন তাহলে ইতিহাসের পাতায় হয়তো তিনি অমরত্ব লাভ করতেন। কিন্তু তাঁর আদর্শহীন, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক জীবন এবং বিভিন্ন সময় রাজনীতিতে ডিগবাজীর ফলে তিনি আজ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত।

রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি অবিচল থাকলে সাদামাটা রাজনীতিবিদও হতে পারেন রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনীতির বাতিঘর। যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। অন্যদিকে সম্ভাবনা থাকার পরও আদর্শহীন একজন রাজনৈতিক নিক্ষিপ্ত হন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে, যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭