ভূতুরে শহর, ভূতুরে দ্বীপ, ভুতুরে বাড়ির কথা শোনা যায় হর হামেশাই। আর সেগুলোর সাথে নানান গাল-গল্পের ফিরিস্তি তো আছেই। এমনি একটি দ্বীপ হলো হাশিমা দ্বীপ। জাপানের নাগাসাকি থেকে প্রায় ১৫ কি.মি দূরে অবস্থিত এই হাশিমা দ্বীপ বর্তমানে ভূতুড়ে দ্বীপ নামে পরিচিত। এই দ্বীপটি জাপানি উপকূলের ঠিক সামনেই অবস্থিত যা দূর থেকে দেখলে মনে হবে সাগরে ভেসে থাকা কোন জাহাজ হয়তো। তাই এর আকৃতির উপর বিচার করে এই দ্বীপটির ডাকনাম রাখা হয়েছে ব্যাটলশিপ দ্বীপ।
অনেক কাল আগে এই দ্বীপটি গুরুত্বপূর্ণ কয়লা খনি হিসেবে সুপরিচিত ছিল যা ১৮৮৭ সালে আবিষ্কৃত করা হয়। এবং ১৮৯০ সালের পর, দ্বীপটি জাপানের দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পায়নের প্রতীক হয়ে ওঠতে থাকে। যেহেতু এই দ্বীপটি সমুদ্রের মাঝখানে তাই টাইফুনের হাত থেকে বাঁচানোর মতো করেই দ্বীপটি তৈরি করা হয়েছিল। দায়িত্বে ছিল মিতসুবিশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে জয় করে এখনও বেশ কিছু ভগ্নাংশ রয়ে গেছে এই পরিত্যক্ত দ্বীপে। কিন্তু দ্বীপটিতে গেলে গা ছমছম ভাব এমনিতেই চলে আসে পর্যটকদের মাঝে।

এই দ্বীপটি শুধুমাত্র একটি দ্বীপই নয়,বরং এই দ্বীপের সাথে জড়িয়ে আছে একটি অন্ধকার সময়ের সংযুক্তি। এখানে থাকা প্রত্যেকটি ভবন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বন্দী হওয়া বন্দীদের দিয়ে নির্মান করা হয়েছিল। ১৯৩০ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অব্ধি ভবনগুলি কোরিয়ান এবং চীনা বন্দীদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। এক কথায় বাধ্য করা হয়েছিল এই বন্দীদের । আর এই বাধ্যতামূলক শ্রমিকদের অবস্থা এখানে ছিল করুণ। এবং অনেকেই আর কখনো বাড়িও ফিরে আসেননি বলে জানা যায়। তাদের ভাগ্যে আদৌ কি ঘটেছিল তা এই দ্বীপের মাঝেই চাপা পরে হারিয়ে গিয়েছিল।যারা এখানে কাজ করেছিল তারা দ্বীপের নাম দিয়েছিল“জেল আইল্যান্ড” কিংবা “হেল আইল্যান্ড”। ১৯৫৯ সালের দিকে দ্বীপটির জনসংখ্যা ছিল সর্বাধিক। তখন হাশিমা দ্বীপে ৫,০০০ এরও বেশি লোক কাজ করত এবং বাস করত। এবং যেহেতু দ্বীপটি খুব বড় ছিল না, তার মানে তাদের প্রত্যেকের জন্য জায়গার বরাদ্দ ছিল মাত্র ৫ ফুট।
এরপর ১৯৭৪ সাল আসে, ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যেতে শুরু করে খনির কয়লা এবং খুব শীঘ্রই লোকেরা দ্বীপ ছেড়ে চলেও যায়। আর তার ফলে শীঘ্রই দ্বীপের জনবসতিহীন অংশগুলি প্রকৃতি দ্বারা আবৃত হতে থাকে,যেন প্রকৃতির কোলে ঘুমিয়ে যেতে থাকে এই দ্বীপটি। আর যেহেতু দ্বীপটি সমুদ্রের মাঝখানে অবস্থিত সেহেতু আবহাওয়ার পরিস্থিতি কংক্রিটকে প্রভাবিত করতে শুরু করে এবং ভবনগুলি ভেঙে পড়তেও শুরু করে। অনেকদিন জাপানিজ কর্তৃপক্ষ বিপজ্জনক বিধায় জনগনকে এখানে যাওয়ার নিরুৎসাহিত করতে শুরু করেছিল কিন্তু বর্তমানে ২০০৯ সালে এটি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে জাপান কর্তৃপক্ষ।
হাশিমা দ্বীপ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় গৃহীত হয়েছে। ২০১৫ সালে এটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করা হয়।যদিও উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিল তখন। কারণ অন্ধকার অতীতের কথা তারা ভোলেনি। কোরিয়া অবশেষে মাথা নত করে, কিন্তু তারা জাপানকে তাদের অপরাধ স্বীকার করার দাবি জানায়। তারা আরও চেয়েছিল যে জাপান তাদের সকলের জন্য দ্বীপে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করুক যাদের সেখানে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। জাপান শেষ পর্যন্ত রাজিও হয় কিন্তু হেরিটেজের খাতায় সাক্ষরের সাথে সাথে সেই স্মৃতিস্তম্ভের কথাও মিলিয়ে যায় সেই বন্দীদের ভাগ্যের মত।
ইতিপূর্বে এই হাশিমা দ্বীপ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচিত্র।এছাড়া জেমস বন্ডের স্কাইফলসহ বেশ কয়েকটি ছবির শুটিং হয়েছে এই হাশিমা দ্বীপে। এছাড়া নেটফ্লিক্সের 'ডার্ক ট্যুরিস্ট' ওয়েব সিরিজে এই ফাঁকা দ্বীপ নিয়ে একটি শো করেছেন ডেভিড ফেরিয়ার নামে নিউজিল্যান্ডের এক সাংবাদিকও।
পরিতক্ত্য দ্বীপ কথাটি থাকবে আর ভূতের গল্প থাকবেনা,এই ব্যপারটি তো হতেই পারেনা। হাশিমা দ্বীপকে নিয়েও রয়েছে এমন মুখরোচক গল্প। অনেক পর্যটক এখানে অতীতের প্রতিধ্বনি শোনার দাবী করেন। আবার সমুদ্রে কাজ করা জেলেরা দাবী করেন রাতের বেলা এই বিল্ডিংগুলোর ভেতরে চকচকে আলোর ফুল্কি তারা দেখেছেন। আবার অনেকে দাবী করেন তারা এখানে গিয়ে ঠান্ডা এক হাতের স্পর্শের অনুভূতি পেয়েছে। আর এসব মিলে হাশিমা দ্বীপ এখন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের পছন্দের জায়গা, দল বল নিয়ে তাই ক্যাম্পেইন করতে হর হামেশাই দেখা যায় উৎসুক দলকে হাশিমা দ্বীপের দিকে যেতে।