ইনসাইড পলিটিক্স

কোথায় দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগ?


প্রকাশ: 26/09/2022


Thumbnail

চলতি মাসের ৩ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের প্রায় ৪০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করেছিল ছাত্রলীগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি সম্মেলনও করেছিল সংগঠনটি। কিন্তু এই রাজনৈতিক সংগঠন প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে অভিভাবকসহ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা যায়। এবং পরে এই সংবাদের উপর ভিত্তি করে দেশের বেশ কিছু পত্রিকা পাবলিক জরিপ  নিলে দেখা যায় দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক তাদের আতঙ্ক এবং ভয়ের ব্যাপারে বলেছে এবং তারা কেউ ই এই সংগঠনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা চান না বলে জানান।

উপরের ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে সাধারণ মানুষের  ছাত্র রাজনীতিকে  ভয় নাকি ছাত্রলীগে তাদের ভয়? কোনটিই ফেলে দেয়ার মত কথা নয়। শুধুমাত্র দৈনিক পত্রিকা গুলোর দিকেই তাকালে দেখা যায় ছাত্র রাজনীতির  নামে ছাত্রলীগের অপকর্মের কথা। শুধুমাত্র ভয়ের কারণ  ছাত্ররাজনীতি নয়, বরং ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকান্ড গুলোই এই রাজনৈতিক সংগঠনটির উপর বিদ্বেষ তৈরি করছে। খুন, মারধর, ধর্ষণ, মাদক সেবন, সংঘর্ষ, কোন দিক দিয়েই পিছিয়ে নেই যেন এই সংগঠনটি। রাজনৈতিক  ছত্রছায়ায় কারা এই রাজনৈতিক সংগঠনটির ঐতিহ্যের ধারাকে কলুষিত করছে তাও একটি  ভাবনার বিষয়।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের কর্মী, এছাড়া  ২০১৯ সালের ৮ই অক্টোবর দৈনিক যুগান্তরে "১০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের যত খুন! শিরোনামে যে রিপোর্টটি বের হয় তাতে দেখা যায় ২০১০- ২০১৯ সেই ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়েছেন ২৪ জন শিক্ষার্থী। আর এই ২৪ জনের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজশাহীতে ৫ জন,  ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ৩ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।আর এসব হত্যাকাণ্ডের ১৭টি ঘটেছে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে! ২০১৯ সাল থেকে এখন ২০২২ এই ৪ বছরে আমরা আরও অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড দেখেছি তার পরিসংখ্যান বের করলে হয়তো আগের থেকেও সেই সংখ্যা ছাড়ায় যাবে। এই যদি হয় দেশের উচ্চ বিদ্যাপীঠে চলা ছাত্রলীগের কান্ড তাহলে নতুন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই রাজনৈতিক দলটির বিচরণ শুরু হবে ভেবে সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে সাধারণ অভিভাবক যে আতঙ্কিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।

ছাত্র রাজনীতিকে গৌরবান্বিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে সব থেকে বড় অবদানই তো ছিল ছাত্র আন্দোলনের। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি নাঈমুদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামের যে সংগঠনটির যাত্রা শুরু, তারই নাম এখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আর এই ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু এককভাবে যে অবদান রেখেছেন তার হাত ধরে ছাত্রলীগেরও অবদান রয়েছে অনেক। কিন্তু সেই ঐতিহ্যের ধারা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে চলা সেই রাজনৈতিক সংগঠনটি এখন এই পর্যায়ে কেন নেমে এল এটাও ভাবনার বিষয়।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বাণী উদ্ধৃত করা আছে। শেখ হাসিনা বলছেন: ‘উচ্চ আদর্শ এবং সাদামাটা জীবন- এই হোক তোমাদের জীবনাদর্শ’। কিন্তু ছাত্রলীগের বর্তমান প্রেক্ষাপটে  আদর্শিক নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  হাসিনার এই আদর্শ কতটুকু মানছেন তা নিয়ে প্রশ্ন এখন  থেকেই যাচ্ছে। ছাত্রলীগের অনেক কর্মী পেশাদারিত্ব, পরিশ্রমী মনোভাব তো রাখেনই না বরং তারা বিলাসী জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত।সাদামাটা জীবন বলতে কি বুঝায় তা যেন জানেনই না এইসব নেতা কর্মী। অনেক ছাত্রলীগ নেতার রয়েছে ঢাকায় বিশাল বাড়ি এবং দামী গাড়ি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়েই বিশাল সম্পত্তির মালিক যে হয়েছেন  তা না,তার সাথে  আছে ছাত্রলীগে কমিটিতে পদ পাইয়ে দিতে টাকার লেনদেনও।

মহাজোট আমলের পর থেকে ছাত্রলীগের বেপরোয়া গতি লক্ষ করা যায়। ছাত্রলীগে শুধুমাত্র ছাত্ররাই আছে কিনা তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে ইতিপূর্বেই। ছয় জুলাই ২০২২ এ দেশের একটি দৈনিক পত্রিকা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের চকবাজার এবং লালবাগ থানা শাখায় বিবাহিত ও একাধিক সন্তানের জনকদের সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনার খবর প্রচার করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী- কোনো বিবাহিত এবং সন্তানের বাবা ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল পদে থাকতে পারবেন না। কিন্তু এইখানেও একটি অনিয়মের সাক্ষর রাখল এই রাজনৈতিক দলটি। অনেক রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন এক শ্রেণীর নেতা-কর্মীরাই আছেন যারা এই রাজনৈতিক দলটিকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে খারাপের দিকে পরিচালিত করছে। যে দলটি  বাংলাদেশ গঠনের ঐতিহ্য  বহন করে তা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদকের কারবারসহ ধর্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্কিত ও অতিষ্ঠ করে তুলছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃশংস খুন-খারাবি, অগ্নিকান্ড, পিটিয়ে শিক্ষার্থী হত্যা, ছাত্রী ও নারী ধর্ষণের মত অসংখ্য অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়েছে ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী। এমন  কোনো অপকর্ম নেই যার অভিযোগ  সংগঠনটির বিরুদ্ধে উঠছে না।

২০২০ সালে করোনাকালে সিলেটের এমসি কলেজ চত্ত্বরে  এক নারীকে ৯ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর গণধর্ষণ করে। এছাড়া সম্প্রতি ভয়ভীতি দেখিয়ে তিন বছর ধরে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে বগুড়ার ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে। ব্যাপারটি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে এখন কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে সেখানে আগে মানুষ ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা খোজে। একটি পরিসংখ্যান বলছে ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত  এ সময়ে ছাত্রলীগের হাতে ছাত্রীরা-নারীরা ধর্ষিত, নির্যাতিত, শ্লীলতা হারিয়েছেন ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন অন্তত ৩১৫ জন। ২০১৯-২০২২ এর সঠিক পরিসংখ্যান করলে এর সংখ্যা হয়তো আরও বাড়বে।

ছাত্রলীগের এসব ঘটনার বাইরে অপ্রীতিকর ঘটনারও রয়েছে ভূরি ভূরি উদাহরণ। চলতি মাসের ১৯ সেপ্টেম্বর বরগুনার বেতাগী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বি এম আদনান খালিদের ইয়াবা সেবনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। ভিডিওতে দেখা যায় সাঙ্গপাঙ্গ মিলে তিনি ইয়াবা সেবন করছেন। এছাড়া গত ১৭ আগস্ট  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ছাত্রীদের ওয়াশরুমে প্রবেশ করে এক ছাত্রীকে অশালীন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন ও হেনস্থা করেন তানজিন আল আলামিন নামের আরেকজন ছাত্রলীগ নেতা। আবার ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা রেখে প্রাণনাশের ভয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে বাড়িতে চলে যান এবং পরে তিনি কুরিয়ারের মাধ্যমে তার অভিযোগ জানান। ছাত্রলীগ শুধুমাত্র এসকল কাজেই নয়, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি,দখল এসবের সাথেও জড়িত।

অনেকেই মনে করছেন সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে ছাত্রলীগ বেপরোয়া ভূমিকা পালন করছে। এতে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নেতারাই নন খোদ এক সময় প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। অনেকেই আবার ধারণা করেন ছাত্রলীগে শুধুমাত্র এখন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাই নেই বরং এখন এখানে বিভিন্ন সময় ছাত্রদল এবং ছাত্র শিবির থেকে আসা নেতা কর্মীরাও ঢুকে গেছে। এছাড়া বিএনপির সমাবেশে উৎসুক হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরাটাও অনেক নেতাকর্মী ঠিক চোখে দেখছেন না। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে  বিএনপির রাজপথে আন্দোলনের ব্যাপারে রাজনৈতিক অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার নির্দেশ  দিয়েছেন  সেখানে উৎসুক হয়ে বিরোধী দলের আন্দোলনে মারপিট এবং সংঘর্ষে জড়িয়ে পরা  আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সাফল্য এবং মানকে ক্ষুণ্ণ করছে।

ছাত্রলীগের এসকল অপকর্ম আওয়ামী লীগের সাফল্যমণ্ডিত শাসনে কালিমা লেপন করছে বলে মনে করছে অনেকে। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কাজে যতটুকু না সাফল্য এনে দিচ্ছে, তার থেকে বরং দেখা যায় এই সংগঠন এখন আওয়ামী লীগের গলার কাটায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান নেতার হাতে গড়া এই রাজনৈতিক সংগঠনের এহেন কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগের জন্য লজ্জারও বটে। আগামী নির্বাচনে যাতে আওয়ামী লীগ তাদের সুষ্ঠ চেতনা বজায় রাখতে পারে সে বিষয়ে ভাবাটা এখন জরুরি। ছাত্রলীগের এহেন কর্মকান্ডের লাগাম এখনি টেনে না ধরলে সরকারের জন্য এই সংগঠন  একদিন বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭