ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

মেলোনির হাত ধরে নব্য ফ্যাসিবাদের যুগে ইতালি


প্রকাশ: 27/09/2022


Thumbnail

সময়টা ২০১৯ সাল, শীতকাল। ইতালির নৈশক্লাবগুলো থেকে বাজনার তালে তালে ভেসে আসছিল—‘আমি জর্জিয়া, আমি একজন নারী, আমি একজন মা, আমি একজন ইতালীয়, আমি একজন খ্রিষ্টান।’ বক্তব্যটি ছিল জর্জিয়া মেলোনির। তাঁর এই বক্তব্য অনেকেরই নজর কেড়েছিল।

মেলোনি ইতালির রাজনৈতিক দল ফ্রাতেল্লি দি’ ইতালিয়ার (ব্রাদার্স অব ইতালি) নেতা। ২০১৯ সালের অক্টোবরে তিনি যখন ওই বক্তব্য দিয়েছিলেন, তখন তাঁর কট্টর ডানপন্থী দলটি বেশ ছোট ছিল। বক্তব্যটি নৈশক্লাবগুলোতে বারবার বাজানো হচ্ছিল মেলোনিকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করার জন্য।

সেই অবস্থান থেকে উঠে এসে আজ ইতালির প্রধানমন্ত্রী হলেন জর্জিয়া মেলোনি। মেলোনির অতিরক্ষণশীল ও জাতীয়তাবাদী আচরণ তাঁকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। তাঁর আপসহীন মনোভাব নেতৃত্ব নিয়ে দৃশ্যত হতাশ ইতালীয়দের মধ্যে নতুন জায়গা করে নিয়েছে। গত ১১ বছরে সাতটি সরকার দেখেছে ইতালির জনগণ। বর্তমান নেতাদের মধ্যে মেলোনিই একমাত্র আছেন, যিনি এখনো দায়িত্বে এসে জনগণের পরীক্ষায় পড়েননি।  

২০১৮ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে মেলোনির দল পেয়েছিল মাত্র ৪ শতাংশ ভোট। তখন থেকে তাদের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। ইতালির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাগি নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন জানাননি মেলোনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিরোধীদের কাতারে দাঁড়ানোর। তাঁর জোটের শরিক দল লিগ পার্টির নেতা মাত্তেও সালভানি ও ফোরজা ইতালিয়ার নেতা সিলভিও বেরলুসকোনি কিন্তু সরকারকে সমর্থনের পথেই হেঁটেছিলেন। পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, সরকারের সঙ্গে হাত না মেলানোই মেলোনিকে বড় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে।

মেলোনির যে দর্শন সেটি ‘ঈশ্বর, পরিবার ও স্বদেশ’ নীতিকে অনুসরণ করে। এই নীতির ভিত্তি খ্রিষ্টান পরিচয়, ঐতিহ্যগত পারিবারিক কাঠামো এবং ইতালীয় দেশপ্রেমিকদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটি জাতি।

মেলোনির এই দর্শন ইতালির নাগরিকদের দুই ভাগে ভাগ করবে বলে মনে করেন এদওয়ার্দো নোভেলি। তাঁর ভাষ্যমতে, মেলোনি প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর এই দর্শনের প্রভাব আসবে ইতালির আইন, সরকারি কর্মকাণ্ড ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।

সম্প্রতি নিজেকে খানিকটা উদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মেলোনি। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায়ও সমর্থন রয়েছে তাঁর। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নিন্দিত ফ্যাসিস্টদের ‘ঈশ্বর, মাতৃভূমি, পরিবার’ স্লোগানে আস্থা রয়েছে তাঁর। ইতালিতে অভিবাসীদের আগমন ঠেকাতে উপকূলে নৌ অবরোধ দেওয়ারও পক্ষে মেলোনি। রোমের লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক লরেঞ্জো কাস্তেলানি বলেন, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সুর বেশ নরম করেছেন মেলোনি। আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি তাঁর যে অবিশ্বাস ছিল, সেদিক দিয়েও নরম হয়েছেন।

সমালোচকেরা বলছেন, মেলোনির এই সুরবদল শুধুই লোক দেখানোর জন্য। ইতালির ইউনিভার্সিটি অব বোলোনিয়ার অধ্যাপক পিয়েরো ইগনাজি বলেছেন, ‘কোনো পরিবর্তন আসেনি। ইতালির ডানপন্থী রাজনীতির যে চরিত্র, তা নতুনভাবে দেখা যাচ্ছে। আর নব্য–ফ্যাসিবাদকে আরও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।’ তাঁর ভাষ্যমতে, মেলোনির সুরে যে পরিবর্তন, সেখানে ছদ্মবেশ রয়েছে।

এমন ধারণার কারণও আছে। নির্বাচনের আগেই সম্প্রতি এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভালো সময় শেষ হয়েছে। সেখানে সমালোচনা করেন গণহারে অভিবাসনের। নাগরিক স্বাধীনতার ওপর হাঙ্গেরির বিধিনিষেধের নিন্দা জানিয়ে গত শুক্রবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি প্রতিবেদনেও সমর্থন জানায়নি তাঁর দল।

ইতালির সংবিধানে একটি পরিবর্তন আনতে মেলোনির রাজনৈতিক জোটের প্রস্তাবের সমালোচনাও হচ্ছে। ওই পরিবর্তন এলে দেশটিতে জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পথ খুলে যাবে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট–শাসিত সরকারব্যবস্থার কাছাকাছি চলে যাবে ইতালির সংসদীয় গণতন্ত্র। তবে সংবিধানে কোনো পরিবর্তন এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে দেশটির বামধারার রাজনীতিকদের আপত্তি রয়েছে।

দেশটি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে কি না, এ নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিন ২০১৮ সালে চতুর্থ মেয়াদে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ওই সময় পুতিনকে অভিনন্দন জানাতে ইতালির কয়েকজন ডানপন্থী নেতাকে রীতিমতো তাড়াহুড়া করতে দেখা যায়। ব্রাদার্স অব ইতালি দলের প্রধান জর্জিয়া মেলোনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘রাশিয়ার এই নির্বাচন জনগণের ইচ্ছার দ্ব্যর্থহীন প্রতিফলন।’

মেলোনির সেই মন্তব্য সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ফের সামনে এসেছে।  ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা বন্ধে সামর্থ্যের সবকিছুই করে যাচ্ছে ইউরোপ। ঠিক সেই সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে এমন দলগুলোর সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা রোম মস্কোর ঘনিষ্ঠ হতে পারে এমন আশঙ্কা বাড়িয়েছে।

ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল স্টাডিজের (আইএসপিআই) রাশিয়াবিষয়ক কর্মসূচির প্রধান আলদো ফেরারি বলেন, এটি একটি যৌক্তিক বিতর্ক। কিন্তু (মস্কোর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের) গুরুত্ব অনুপাতে বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নির্বাচনী প্রচারণায় বিষয়টি ব্যবহার করা হচ্ছে।

ডানপন্থীদের উত্থানে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক ইতালীয়। ৬০ বছর বয়সী মালাতেস্তা তাঁদের একজন। গতকাল ভোট দিতে এসে তিনি বলেন, ‘এই ঐতিহাসিক মুহূূর্তে ভোট দেওয়া আমার দায়িত্ব। আমি ভীত, কারণ দেশের মানুষ ডানপন্থীদের দিকে ঝুঁকছে। আমি বেশ উদ্বিগ্ন।’

তবে ভিন্নমতও আছে। ৭৯ বছর বয়সী ভোটার লুসিয়ানো বলেন, ‘আমার মতে মেলোনিই একমাত্র রাজনীতিক, যিনি ইতালির অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন। তিনি সব সময় ইতালীয়দের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন।’

উগ্র ডানপন্থীদের অভিবাসীবিরোধী নীতির কারণে ইতালিতে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসী তথা অভিবাসীদের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ইতালিতে স্বামী-সন্তান নিয়ে বাস করা বাংলাদেশি নারী রোকসানা মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারণায় ডানপন্থীরা অভিবাসীদের কটাক্ষ করার পাশাপাশি কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। আমাদের ধারণা তারা ক্ষমতায় এলে অভিবাসীদের জন্য কঠোর আইন হবে।’

ইতালির এবারের নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা পাঁচ কোটি ১০ লাখ। এর মধ্যে নতুন ভোটারের সংখ্যা ২৬ লাখ। একজন ভোটার দুটি করে ভোট দেবেন। একটি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ ও অন্যটি নিম্নকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭