ইনসাইডার এক্সক্লুসিভ

অসহায় ক্ষুদ্র খামারিরা, পাচ্ছেন না কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা


প্রকাশ: 28/09/2022


Thumbnail

বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ খাতের যে ব্যাপক বিপ্লব আজ দৃশ্যমান এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ক্ষুদ্র অপ্রাতিষ্ঠানিক খামারিদের। কিন্তু এসমস্ত খামারিদের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ, তারা কোন রকম সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না। সরেজমিনে গিয়ে খামারিদের নানা প্রতিকূলতার দৃশ্য তুলে ধরেছেন বাংলা ইনসাইডারের বিশেষ প্রতিবেদক  আসাদুজ্জামান খান

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ইসলাম মুজাহিদ, থাকেন মোহাম্মদপুরে। নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে শখের বসেই একটি গরু কিনলেন। গরুর লালন-পালন সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তাঁর। তাই ইন্টারনেটের সহযোগিতায় গরু লালন-পালনের সম্পর্কে বিভিন্ন ভিডিও দেখে অনেক কিছু শিখেন এবং সে অনুযায়ী লালন-পালন শুরু করেন। ২০১৮ সালের কোরবানিতে সেই গরু বিক্রি করে বেশ লাভও করেন মুজাহিদ। উৎসাহিত হয়ে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে গরু মোটাতাজারকণের উপর প্রশিক্ষণ নেন এবং কিছু মূলধন জোগাড় করে ১০ টি গরু দিয়ে শুরু করেন গরু মোটাতাজাকরণ খামার। পড়াশোনা শেষে একজন বড় খামারি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন মুজাহিদ। ৱৰ্তমানে তার খামারে ৪১টি গরু রয়েছে এবং সামনের বছর কোরবানিকে কেন্দ্র করে আরও গরু কেনার পরিকল্পনাও করছেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার লক্ষ্মীনগর গ্রামের বেকার কিশোর রিমন আহমেদ। পড়ালেখা না থাকায় ভালো কোনো কাজও পাচ্ছিলেন না তিনি। তাই তাকে বিদেশে পাঠাতে চায় তাঁর পরিবার। কিন্তু রিমন বিদেশে যেতে চায় না, সে দেশে থেকেই কিছু একটা করবে বলে জানায়। রিমন এলাকার বিভিন্ন খামারিদের কাছ থেকে জানতে পারে যে, পোল্ট্রি খামার একটি লাভজনক ব্যবসা। এরপর রিমন কিছু টাকা জোগাড় করে অল্প পরিসরে একজন বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে পোলট্রি খামার শুরু করেন। সেখানে বেশকিছু টাকা লাভ হলে সেই টাকা জমিয়ে নিজ উদ্যোগে খামার আরও বড় করেন। কিন্তু হঠাৎ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খামারে থাকা ২ হাজার মুরগি মারা যায়। ফলে তাঁর লোকসানের পরিমাণ প্রায় তিন লক্ষ টাকা।

২০২১ সালে আমার একদিনে প্রায় ২ হাজার মুরগি মারা গেসে। ব্যবসার উপরে থাইকা মন উইঠা গেসে। ব্যবসা আর করতেই মন চায় না।

— পোলট্রি খামারি রিমন আহমেদ



মুজাহিদ, রিমনরাই দেশের অধিকাংশ খামারির প্রতিচ্ছবি। তবে দুইজনের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। একজন সফল, অন্যজন ব্যর্থ। তবে একটি ক্ষেত্রে তাদের মিল রয়েছে। এদের কেউই সরকার থেকে কোন প্রকার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা পায়নি। এই খামারিদের সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার লক্ষে প্রাণিসম্পদ এবং মৎস্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প ২০১৯ সালে চালু করা হয়। 'সকলের জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ নিশ্চিতকরণ', এই ভিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সংরক্ষণ, রোগনিয়ন্ত্রণ ও জাত উন্নয়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রাব্বানী বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) গ্রাম ভিত্তিক আমাদের যে খামারি; শহর উপ-শহর থেকে শুরু করে গ্রাম অবধি যে খামারি, যারা প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন করে তাদের জীবিকা হিসেবে, তাদেরকে আমরা দুইভাবে সহযোগিতা দিচ্ছি। একটি হলো আমরা নির্বাচিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে খামারি নির্বাচন করে প্রডিউসার গ্রুপ গঠন করেছি। তাদেরকে একটা পর্যায়ে আমারা সংগঠন পর্যন্ত উন্নীত করব। তাদের জন্য কমিটি করে দিয়েছি, তাদের ব্যাংক একাউন্ট ওপেন করে দিয়েছি, তাদেরকে গঠন তন্ত্র দিয়েছি তারা কিভাবে নিজেরা কাজ পরিচালনা করবে, সঞ্চয় করবে ইত্যাদি এবং এর বাইরে সকল খামারিদের জন্য রয়েছে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা।

এর আওতায় উপশহর থেকে শুরু করে গ্রামভিত্তিক আমাদের যে প্রান্তিক খামারি রয়েছে তাদের জন্য দেশের ৬১টি জেলায় ৪৬৫ টি উপজেলায় ভ্যালুচেইন ভিত্তিক ৫ হাজার ৫০০টি প্রডিউসার গ্রুপ গঠনের করা হয়েছে। তাদের জন্য কমিটি করে দিয়েছি, ব্যাংক একাউন্ট করে দিয়েছি, তাদেরকে গঠনতন্ত্র দিয়েছি এবং এই গ্রুপের বাইরে যে খামারি আছে তাদের সকলের জন্যই রয়েছে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রযুক্তি সহায়তা, তাদের উৎপাদিত পণ্যের হাইজিন উন্নত করা, উৎপাদন দক্ষতা বাড়ানো, নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে অবহিত হওয়া এবং সেই প্রযুক্তিগুলো তাদের খামারে ব্যাবহার করার ব্যাপারে তাদের উৎসাহিত করা।

গত এক যুগে দেশে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৫.৫১ গুণ, মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৭.৩৫ গুণ এবং ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.০৭ গুণ। প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে বিগত সালগুলোতে পবিত্র ঈদুল আজহার পশুর চাহিদা দেশে পালিত পশু দিয়েই পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ খাতের যে বিপ্লব ঘটেছে, তার পেছনে অনেক বড় অবদান এই ক্ষুদ্র অপ্রাতিষ্ঠানিক খামারিদের। কিন্তু এই খামারিরাই উপেক্ষিত! মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নিলেও তাঁর ফল পাচ্ছেন না এই খামারিরা। তাদের উন্নয়নের জন্য গৃহীত কর্মসূচির বেশিরভাগ সুযোগ-সুবিধাই তাদের পর্যন্ত পৌঁছায় না। খামারির দোরগোড়ায় বিনামূল্যে পশুর চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা এখন পর্যন্ত প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। অনেক জায়গায় রয়েছে পশুর ভ্যাক্সিন এবং ওষুধের অভাব।

মুজাহিদ-রিমনদের মত আরও অনেক ক্ষুদ্র খামারি এবং উদ্যোক্তা আছেন যারা কোনো প্রকার সরকারি সহযোগিতা না পাওয়া সত্ত্বেও খামার টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। রিমনের যে ২ হাজার মুরগি মারা গিয়েছে তা শুধু রিমনেরই ক্ষতি নয়, এটা বাংলাদেশের ক্ষতি, প্রাণিসম্পদ খাতের ক্ষতি। সরকার যদি সরাসরি তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে এই ক্ষুদ্র খামারিদের প্রতি আরও যত্নশীল না হয় তাহলে শুধু রিমনরাই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের প্রাণিসম্পদ খাত এবং উৎপাদনও ব্যাহত হবে। আর এর প্রভাব শুধু খামারি পর্যায়ে নয়, ভোক্তা পর্যায়েও পরিলক্ষিত হয়। বৃদ্ধি পায় দুধ, ডিম, মুরগিসহ প্রাণিজ পণ্যের দ্রব্যমূল্য।

মুজাহিদ জানান, বর্তমানে গরুর মধ্যে এলএসডি বা ল্যাম্পিস্কিন ডিজিজ বেশ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তার নিজের খামারেও বর্তমানে ২টি গরু এই রোগে আক্রান্ত। কিন্তু ভ্যাক্সিনের ঘাটতি থাকায় গরুকে ভ্যাক্সিন দিতে পারছেন না। ভাইরাসজনিত রোগ হওয়ায় অন্যান্য গরুতেও রোগ ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

পাশাপাশি পশু খাবারের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে তেমন লাভ হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “দানাদার খাবারের দাম ২০২০ সালেও ২৩ টাকা কেজি ছিল। এখন সেটার দাম ৩৫ টাকা কেজি। আগের গরুর পিছনে মাসে ৫ হাজার টাকা খরচ হলে এখন খরচ হয় ৮ থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা। যে পরিমাণ খরচ বেড়েছে সে তুলনায় আমাদের লাভ বাড়েনি।”

অন্যদিকে রিমন বলেন, ৩ বছর আগে যখন ব্যবসা শুরু করেছিলাম তখন ১ বস্তা মুরগির খাবারের দাম ছিল ২ হাজার ১২০ টাকা। এখন সেই বস্তার দাম ৩ হাজার ৪২০ টাকা। যখন ২ হাজার ৫৮৫ টাকা বস্তা ছিল তখন মুরগি বিক্রি করেছি ১৩০ টাকা কেজি। এখন খাবারের দাম প্রায় ৮০০ টাকা বেশি হলেও মুরগির দাম তেমন বাড়েনি। তাই এখন আর আগের মত লাভ হয়না।”

এলডিডিপি প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পটিতে (এলডিডিপি) মোট বিনিয়োগ ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগ ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা প্রাণিসম্পদ সেক্টরে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি, গাভী-ষাঁড়, ছাগল-ভেড়া এবং হাঁস-মুরগির উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি প্রদর্শনী দ্বারা খামারিদের দক্ষতা উন্নয়ন, দুগ্ধ বিপণনের জন্য বাজার সংযোগ, পণ্য বহুমুখীকরণ, মূল্য সংযোজন, স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রাণিজাত আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ফুড সেফটি নিশ্চিতকরণে উৎপাদনকারী, পরিবহনকারী, ব্যবসায়ী, কারিগর, ভোক্তা সব স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে এ প্রকল্প।

গত ৫-৬টি কোরবানির ঈদে আমরা আমাদের দেশি পশু দিয়েই কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণ করেছি।

— ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা
মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর



প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, আমরা দেশব্যাপী এই প্রান্তিক খামারিদের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে তুলছি। যার ফলে তাদের পাশাপাশি আমাদের আরেকটি জনগোষ্ঠী, আমাদের শিক্ষিত যুবসমাজ, তারাই কিন্তু এই প্রাণিসম্পদ খাতে এগিয়ে আসছে। যার ফলাফল দেশের যে প্রাণী উৎপাদন, সেই উৎপাদনে প্রতিফলিত হচ্ছে।

এলডিডিপি প্রকল্পের সুযোগ সুবিধাগুলো যদি প্রান্তিক পর্যায়ে এবং সারা দেশের সকল ক্ষুদ্র খামারিদের কাছে যথাযথ পৌঁছে দেয়া যায় তাহলে দেশের প্রাণিসম্পদ খাত যেমন সমৃদ্ধ হবে তেমনি দেশে বেকারদের সংখ্যা কমে উদ্যোগতা এবং কর্মসংস্থানও তৈরি হবে। সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে রিমনের মত খামারিদেরকেও বিরাট অংকের লোকসান গুনতে হবে না। তাই খামারিদের দ্বারপ্রান্তে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সকল সুযোগ-সুবিধা পৌঁছাতে মন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের দাবি জানিয়েছেন এই খামারিরা। প্রাণিজ পণ্যের উৎপাদন যদি আমরা আরও বৃদ্ধি করতে চাই এবং যে লক্ষ্য নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং এলডিডিপি প্রকল্প কাজ করে যাচ্ছে সে লক্ষ্যে পৌছতে চাই তাহলে রিমন, মুজাহিদের মত খামারিদের প্রতি নজর দেয়ার বিকল্প নেই।




প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭