ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

যেভাবে স্বাধীনতা থেকে শৃঙ্খলে আটকা পড়েন ইরানের নারীরা


প্রকাশ: 29/09/2022


Thumbnail

‘নারী’, ‘জীবন’ ও ‘স্বাধীনতা’। ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হাতে আটক অবস্থায় মাসা আমিনি (২২) নামের এক তরুণীর মৃত্যুতে দেশজুড়ে চলমান বিক্ষোভের স্লোগানে এসব শব্দই উচ্চারিত হচ্ছে। হিজাব পরায় সঠিক নিয়ম মানা হয়নি অভিযোগে মাসা আমিনিকে আটক করেছিল ইরানের নৈতিকতা পুলিশ যারা কি না ‘গাশত–এ এরশাদ’ বা ‘গাইডেনস পেট্রল’ নামেও পরিচিত। নারী পর্দা মেনে চলছে ও ইসলামি পোশাক পরছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব তাদের। কর্তৃপক্ষ বলছে, হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন মাসা আমিনি, তাতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে ইরানের জনসাধারণের বিশ্বাস, তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছে নৈতিকতা পুলিশের সদস্যরা।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর মাসা আমিনির মৃত্যু যেনো স্ফুলিঙ্গের মতো ইরানিদের ক্ষোভের আগুনকে জ্বালিয়ে দেয়, যা দানা বাঁধছিল কয়েক দশক ধরে। এর মূলে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের চার দশকের পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন আর নারীরদের প্রতি সহিংসতা। এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন ইরানি নারীরা।

১৯৪১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইরানের ক্ষমতায় ছিল মোহাম্মদ রেজা পাহলাভির (মোহাম্মদ রেজা শাহ) সরকার। তাঁর শাসনামলে ইরানে নারীদের অর্জন ছিল উল্লেখযোগ্য। সে সময় তাদের উচ্চ শিক্ষা, পেশাগত উৎকর্ষ, ভোটাধিকার, সরকারি দপ্তরের দায়িত্ব, পুরুষের সমান বেতনের আইন, স্বাস্থ্যসেবা ও সন্তান নেওয়া বা না নেওয়ার অধিকার ছিল। নারীদের বিষয়গুলো দেখভালের জন্য মন্ত্রিসভায় পদও রাখা হয়েছিল, যা ছিল বিশ্বে দ্বিতীয়। নারীরা কেমন পোশাক পরবেন, তা তাঁরা নিজেরাই পছন্দ করতে পারতেন। ইরানের ১৯৬৭ সালের পারিবারিক সুরক্ষা আইন এবং ১৯৭৫ সালে এ আইনের সংশোধিত রূপ ছিল ইসলামী বিশ্বে এ ধরনের সবচেয়ে উদার আইনগুলোর অন্যতম। এই আইনে সমতা রক্ষা করে নারীর বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ এবং নারীর উত্তরাধিকার নিশ্চিত হয়েছিল। বহুবিবাহও বহুলাংশে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল।

রেজা শাহের সরকার পতনের আন্দোলনে অনেক নারীই অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৯ সালে তাঁকে উৎখাত করা হলে ইরানে নতুন ইসলামি প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলা হয়। এই ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে নারীদের নিয়ন্ত্রণ ও দমিয়ে রাখা। কট্টরপন্থী শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ছিলেন এই বিপ্লবের নেতা। তিনি যে কঠোর ইসলামি শাসনের সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন সেখানে নারীর সমঅধিকারকে বেমানান মনে করা হতো।

ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শাহের দেশ ছেড়ে পালানোর কয়েক সপ্তাহ পর ১৯৭৯ সালের ৬ মার্চ পারিবারিক সুরক্ষা আইন বাতিল করতে চাওয়ার কথা ঘোষোণা দেন খোমেনি। ঘরের বাইরে নারীদের অবশ্যই হিজাব পরতে হবে, চুল ঢাকতে হবে বলে নির্দেশ জারি করা হয়। এর প্রতিবাদে হাজারো নারী দেশজুড়ে তিন দিন বিক্ষোভ করেছিলেন। ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেহদি বাজারগান ছিলেন উদারপন্থী। রুহুল্লাহ খোমেনিকে তখনো তাঁর মতো উদার রাজনীতিকদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে চলতে হচ্ছিল। ফলে প্রতিবাদের মুখে রুহুল্লাহ খোমেনি সাময়িকভাবে পিছিয়ে আসেন এবং তাঁর ওই ঘোষণা প্রত্যাহার করেন।


কিন্তু ১৯৮০ সালে ক্ষমতা যখন পুরোপুরি খোমেনির হাতে চলে আসে, সে সময় তিনি নারীদের জন্য আবার পর্দা বাধ্যতামূলক করেন। সব নারী বিচারককে বরখাস্ত করেন। এর প্রতিবাদে নারীরা আবারও রাস্তায় নামলেও এবার তারা আর খোমেনিকে দমাতে পারেননি। ১৯৮৩ সালে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ইরান নারী অধিকারের ওপর অন্যান্য বিধিনিষেধের সঙ্গে পর্দাকে বাধ্যতামূলক করে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করে।

১৯৮০-এর দশক ছিল ইরানি নারীদের জন্য কঠোর দমন-পীড়নের। ওই সময়ে নারীরা সংগঠিতভাবে খুব কমই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তখন ইসলামিক প্রজাতন্ত্র জনগণের ওপর নজরদারি করত। আচরণগত কঠোর নিয়ম অমান্য করলেই শাস্তি দেওয়া হতো। ওই সময়ে ইরানের নৈতিকতা পুলিশ যা শুরুতে ‘গশত–এ এরশাদ’ নামে পরিচিত ছিল, তারা নিয়মিত রাস্তাঘাটে টহল দিতে শুরু করে। তারা ‘নিয়ম মতো’ পোশাক না পরার অভিযোগে নারীদের (মাঝে মাঝে পুরুষদেরও) অনেককে আটক করত। বাড়িঘরে তল্লাশি চালিয়ে অ্যালকোহল জব্দ করত। সে সময় সরকার নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু চাকরিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়। এমনকি নারী শিক্ষার্থীরা পশুচিকিৎসা বিজ্ঞান এবং ভূতত্ত্বের মতো নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়তে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। সরকার শাহ শাসনামলের পারিবারিক সুরক্ষা আইন বাতিল করে দেয়। এর ফলে নারীরা বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ এবং সন্তানকে হেফাজতে নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তখন মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স কমিয়ে প্রথমে ১৩ ও পরে ৯ এ নামিয়ে আনা হয় (২০০২ সালে আবার ১৩ বছর করা হয়) এবং বহুবিবাহকে উৎসাহিত করা হয়। নারীরা তখন একা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারতেন না। এমনকি বিদেশে যাওয়ার জন্যও একজন পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হতো।

আরও খারাপ যেটা দাঁড়ায় তা হলো, ইরানি কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে নারীদের ওপর সহিংসতা চালাত। ১৯৮০ সালে খোমেনি যখন সব ক্ষমতার কেন্দ্রে, তখন কর্তৃপক্ষের কাউকে সন্দেহজনক অপরাধী মনে হলেই তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। যে নারী পর্দা বা ইসলামী শাসনের বিরোধিতা করেছে তাকেও ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। বলা হতো এসব নারী যৌনবৃত্তির সঙ্গে জড়িত বা ‘আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ করতে চায়। নারী রাজনৈতিক বন্দীদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করা হতো এবং প্রায়ই নির্যাতন বা যৌন নির্যাতন করা হতো। তাদের মধ্যে অনেককে পাথর ছুড়ে মারা হয়েছে, যা ইরানে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ছিল না।

তবে ইরানের নারীরা ১৯৯০ এর দশকে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে লড়াই শুরু করেন, যা ‘গোলাপী বিপ্লব’ নামে পরিচিত। বিশেষত শহুরে এলাকায় নারীরা সম্মিলিতভাবে মেকআপ, রঙিন হেডস্কার্ফ এবং চাদরের পরিবর্তে লম্বা কোট পরে এবং স্কার্ফের নিচ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে চুল একটু আধটু দেখিয়ে হিজাব আইনের সীমা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। এই নারীদের সংখ্যা বিপুল হওয়ায় তখন নৈতিকতা পুলিশের পক্ষে সবাইকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব ছিল না।

বিক্ষোভের এ সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ইরানি নারীরা অন্যভাবে সংগঠিত হতে শুরু করেন। ২০০৬ সালে তাঁরা নারীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আইন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই প্রতিবাদের বাইরে ইরানি নারীবাদীরা বৈষম্যমূলক আইন প্রত্যাহার করার জন্য তৃণমূলে ১০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন; যা ‘সমতার জন্য পরিবর্তন’ নামেও পরিচিত। কট্টরপন্থী মাহমুদ আহমাদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট থাকাকালে কর্তৃপক্ষের দমন পীড়ন ও হয়রানি সত্ত্বেও এই প্রতিবাদ ঘটেছিল। তাঁর সময়ে নৈতিকতা পুলিশের বর্তমান রূপ দাঁড়ায়।

২০০৯ সালে আহমেদিনেজাদের বিতির্কত পুনর্নির্বাচন নিয়ে গণবিক্ষোভে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন ‘সমতার জন্য পরিবর্তন’ আন্দোলনের কর্মীরা। নারীদের মেকআপ, সানগ্লাস, মাথায় হিজাব, পরনে নীল জিন্স-এমন প্রতিবাদের ছবিগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়েছিল। তবে এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত সরকারের সহিংসতার মুখে শেষ হয়। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনী নেদা আগা সোলতান নামে এক তরুণীকে গুলি করে হত্যা করে। সেই দৃশ্য একটি মোবাইল ফোনে ধারণ করা হয়েছিল।


গত এক দশকে পর্দার বিরুদ্ধে নারীদের সংগঠিত প্রতিরোধ বেড়েছে। কম বয়সী নারীরা জনসমক্ষে তাদের মাথার স্কার্ফ খুলে ছবি তুলেছেন। ‘ঠিকভাবে’ হিজাব না পরার কারণে নৈতিকতা পুলিশ বা অন্যরা নারীদের জনসমক্ষে যেভাবে হয়রানি করেছে তাদের লজ্জা দিতে এই ভিডিও অনলাইনে ছাড়া হয়েছে। তারা বাধ্যতামূলক পর্দার নিন্দা জানাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন। তারা আইনের প্রতি অবজ্ঞা জানাতে ‘মাই স্টিলথি ফ্রিডম’ নামে প্রচার চালিয়েছেন, যেখানে নারীরা হিজাববিহীন ছবি পোস্ট করেছেন। সরকার গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ডের মধ্য দিয়ে তা দমনের চেষ্টা চালিয়েছে।

ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট কট্টরপন্থী ইব্রাহিম রাইসি ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভিন্নমত দমন করে চলেছেন। নারীদের বিক্ষোভ রুখতে পর্দা করার ওপর বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে তাঁর সরকার। রাইসি সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা হিজাববিরোধী ভিডিওগুলোতে উপস্থিত তরুণীদের গ্রেপ্তার এবং শাস্তি দিতে ‘ফেসিয়াল রিকগনিশন’ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। চলতি বছরের শুরুতে এ ধরনের ভিডিওতে থাকা একজন তরুণীকে আটক করে মারধর করা হয়েছিল। পরে তাঁকে দিয়ে তাঁর আচরণের জন্য ক্ষমা চাওয়ানো হয়, যা টেলিভিশনে প্রচার করা হয়।

মাসার আটক ও মৃত্যুর ঘটনায় সরকার ধরেই নিয়েছিল, তারা নারী নির্যাতন থেকে দায়মুক্তি পেতে পারে। তাই এ ঘটনার পর ইরানজুড়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সম্ভবত দেশটির নেতাদের জন্য বিস্ময়কর ছিল।

ইতিমধ্যে ইরান বিদ্রোহ দমনে কঠোরতা অবলম্বন করছে। ইন্টারনেট এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিও চালানো হয়েছে। বিক্ষোভে সহিংসতায় অন্তত ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ক্ষুব্ধ নারীরা পিছপা হচ্ছেন না। তাঁরা প্রকাশ্যে মাথার স্কার্ফ পুড়িয়ে ফেলছেন এবং চুল কেটে ফেলছেন। ১৯৭৯ সালের মতোই এবারের বিক্ষোভেও বিপুলসংখ্যক পুরুষ তাঁদের সঙ্গে প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন। সরকার যতই হিংস্র হয়ে উঠছে, বিক্ষোভ ততই বাড়ছে।

সুপেয় পানির অভাব বা অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে সাম্প্রতিক বিক্ষোভের বিপরীতে এই প্রতিবাদটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের একটি মূল নীতি- নারীদের দমিয়ে রাখার বিরুদ্ধে। এর ফলে বিক্ষোভকারীরা প্রকাশ্যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ও এর ধর্মতান্ত্রিক শাসনের অবসানের আহ্বান জানাচ্ছেন। ইরানের সরকার দাবি করে, এ ধরনের বিক্ষোভের নেপথ্যে শত্রুরা রয়েছে। এগুলো দেশের শত্রুদের কাজ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই বিক্ষোভ ৪০ বছর আগের অসন্তোষের ফল এবং বর্তমান শাসনের জন্য একটি শক্তিশালী হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইরান হয়তো অন্যদের যেভাবে দমন করে, সেভাবে এই প্রতিবাদ আন্দোলনকে দমন করতে পারে। কিন্তু যদি তা ঘটে, তাহলে তা ইরানিদের ক্ষোভ বাড়িয়ে দেবে। অথবা হয়তো মাসা আমিনির হত্যাকাণ্ড ইরানি নারীদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের বাঁকবদল হয়ে উঠতে পারে। হয়তো আরও একটি বিপ্লবের সূচনা হতে যাচ্ছে। আর এ বিপ্লবের স্লোগান সেই তিন শব্দ: নারী, জীবন ও স্বাধীনতা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭