ইনসাইড বাংলাদেশ

অভিযোগের ভান্ডার ‌‘ফুডপান্ডা’


প্রকাশ: 03/10/2022


Thumbnail

ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে নওশাদ শুভ, ব্যাচেলর ভাড়া বাসায় থাকার দরুণ অনেক সময় তাকে নির্ভর করতে হয় ফুডপান্ডার মত খাবার সরবরাহকারী অ্যাপসের উপর। কিন্তু এই সেবার অভিজ্ঞতার  ব্যাপারে জানতে চাইলে বেশ খানিকটা ক্ষোভ উগ্রে দেন তিনি। তার অভিযোগ মতে ফুডপান্ডা ঘরের দুয়ারে খাবার পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার করলেও, রাইডাররা অনেক সময় সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে খাবার পৌঁছে দিতে অপারগতা জানায়। তিনি জানান যদি আমাকে নিচে নেমেই খাবারটা নিতে হবে তাহলে আমি বাইরে গিয়েই খেতে পারি, বাসায় এক্সটা ডেলিভারি চার্জ দিয়ে কেন খাবার আনতে আমি নিচে যাব? এছাড়া এক খাবার অর্ডার দিয়ে আরেক খাবার পাওয়ার ঘটনাও তার সাথে ঘটেছে অহরহ। এছাড়া রাইডারের ঘরের দুয়ারে খাবার পৌঁছে না দেয়া নিয়ে বাকবিতণ্ডায় খাবার কেনসেল ঘটনাও ।

আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রেসাত আমিন প্রিয়া, তার অভিজ্ঞতা আরও এক সরস বেশি। তার অভিযোগ মতে ফুডপান্ডায় রাত ১০টায় খাবার অর্ডার করে দীর্ঘক্ষণ খাবার না পেয়ে ঘুমিয়ে যান তিনি। রাত ৩ টায় ঘুম ভাঙ্গে ফুডপান্ডার রাইডারের কলে। সে সময় খাবার অর্ডার করার কথা বললে ফুডপান্ডার অফিস থেকে তাকে আবার কল দিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় খাবার কেন কেনসেল করছেন তিনি। শেষ অব্ধি খাবারটা কেনসেল করে ফুডপান্ডা। এমন খাবার অর্ডার দিয়ে দীর্ঘক্ষণ খাবারের জন্য অপেক্ষা করার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন অনেক গ্রাহকই।

বাংলাদেশে এখন ই-কমার্স ব্যবসা দারুণ ভাবে জমে উঠেছে। কিন্তু এর বিপরীতে আছে নানান অভিযোগ, ক্ষোভ এবং গ্রাহক ভোগান্তি। বাংলাদেশের সব থেকে জনপ্রিয় একটি খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফুডপান্ডা। অভিযোগ আছে এই প্রতিষ্ঠানটি ডিজিটাল মাফিয়ার মত আচরণ করছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে গ্রাহকদের আছে পাহাড় সমান অভিযোগ। খাবার অর্ডার করে কেনসেল হয়ে যাওয়া, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরেও খাবার সঠিক সময়ে না পৌছানো, খাবার অর্ডার করে টাকা পরিশোধের পরেও খাবার না আসা, দাম বেশি নেয়া, ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার মত গুরুত্বর সব অভিযোগ উঠছে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

খাবার ডেলিভারির পাশাপাশি গ্রোসারি পণ্যও সরবরাহ করে ফুডপান্ডা। সেখানেও রয়েছে সেই একই অভিযোগ। চলতি মাসের ১১ই সেপ্টেম্বর টিস্যুর দাম ২ টাকা বেশি রাখায় খুলনা মহানগরীতে ফুডপান্ডাকে ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। এক ভোক্তার লিখিত অভিযোগের পরিপেক্ষিতে  এই পদক্ষেপ নিয়েছিল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তর। অভিযোগে জানানো হয়েছিল যে,  ফুডপান্ডা ২৮ টাকার টিস্যু পেপার ৩০ টাকা বিক্রি করেছিল। শুনানিতে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফুডপান্ডাকে ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল সে সময়। জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ৫০০ টাকা সেই ভোক্তাকে দেয়া হয়েছিল পরে।

এছাড়া ভ্যাট ফাঁকি দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। ফুডপান্ডার  কম্পিউটার ও ল্যাপটপ  জব্দ করে জানা যায়  ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি ও এপ্রিল-মোট আট মাসে মোট ২৭ কোটি ৫৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫১৭ টাকার বিক্রয় তথ্য পাওয়া যায় । কিন্তু এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি গুলশান ভ্যাট সার্কেলে দাখিলপত্রে ১৫ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ৯৭২ টাকা বিক্রয়মূল্য দেখিয়েছে। আট মাসে প্রতিষ্ঠানটি মোট ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫৪৫ টাকা বিক্রয়তথ্য গোপন করেছে। যার উপর পরিহার করা ভ্যাট ৫৩ লাখ ১০ হাজার ৭৪ টাকা। এই ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সুদ ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬২০ টাকা।

ফুডপান্ডার মত খাবার এবং গ্রোসারি পণ্য ডেলিভারি দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্ভর হয়ে উঠছে মানুষ। আর মানুষের আস্থার জায়গাটা তারা শুরুতে নিতে পেরেছিল জন্যেই মানুষ তাদের উপর নির্ভর হয়ে উঠছে। কিন্তু এখন এই আস্থা রাখাটাই গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রাহকদের। শুরুতে ফুডপান্ডার খাবার ডেলিভারি, ভাউচার অফার, গ্রাহক অভিযোগ দিয়ে সাহায্য পাওয়ার মত ব্যবস্থা ছিল বলে ফুডপান্ডা সেই আস্থা পেয়েছিল। কিন্তু এখন আস্থার জায়গাটা ধরে রাখতে পারছে না এই প্রতিষ্ঠানটি। বরং গ্রাহকের সেই আস্থাকে এখন তারা ফাঁদ হিসেবে নিয়েছে। এখন গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপেক্ষিতে শুধুমাত্র পরবর্তীতে সমস্যা হবে না বলে জানালেও তারা ঘটে যাওয়া সমস্যার সমাধান করছে না। আবার গ্রাহকদের পেমেন্ট করা টাকার বিপরীতে কোন খাবার ডেলিভারি না হলেও সেই টাকা রিফান্ড করে না এই প্রতিষ্ঠান। 

ফুডপান্ডা ডিসকাউন্ট নিয়েও নানারকম ভাওতাবাজির আশ্রয় নিয়েছিল এই ফুডপান্ডা। কয়েকদিন আগেই রেস্টুরেন্টের খাবার ২০% বাড়িয়ে ২০% ডিসকাউন্ট দেওয়ার প্রস্তাব দেইয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এই ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহকের আস্থা রাখার অঙ্গীকার করলেও এ ধরনের নোংরা চালাকি গ্রাহকের শুধুমাত্র আস্থাই নষ্ট করছে না। অপরদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের উপর বিশ্বাস-আস্থা নষ্ট হচ্ছে অনেক গ্রাহকের।

নতুন করে আরেকটি ফি বাড়িয়েছে ফুডপান্ডা। প্ল্যাটফর্ম ফি’ নাম করে বাড়তি টাকা নিচ্ছে অনলাইনে খাবার অর্ডারকারী প্রতিষ্ঠানটি। শুরুর দিকে ফুডপান্ডা ফ্রি ডেলিভারি দিলেও এরপর ডেলিভারি ফি যুক্ত করে এই প্রতিষ্ঠানটি। দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি এবং নানা পারিপাশ্বিকতায় ডেলিভারি ফি সংযুক্তির যুক্তিযুক্ত কারণ থাকলেও এই প্লাটফর্ম ফি নেয়ার কারণ অযৌক্তিক মনে হয়। অবশ্য ফুডপান্ডা যুক্তি দেখিয়েছে তারা এই ফি নিচ্ছে তাদের টেকের উন্নয়নের জন্যে যাতে গ্রাহকরা সেরা সেবা উপভোগ করতে পারে। কিন্তু সেরা সেবার চিত্রের দিকে তাকালে এই বাড়তি টাকা নেয়াটাকে প্রতারণাই মনে হয়।

ঢাকার বাইরে ৬৪ জেলায় ফুডপান্ডার সেবা চালু আছে। ঢাকার ভেতরের রেস্টুরেন্টের খাবার মোটামুটি ভালো ডেলিভারি দিলেও ঢাকার বাইরের জেলা শহরের মানুষের অভিজ্ঞতা আরও খারাপ। ভ্যান থেকে ৩০০ টাকা দামের চায়নিজ খাবার চার গুণ বেশি দামে ফুডপান্ডায় ডেলিভারি দেয়ার অভিযোগ আছে। ফুডপান্ডায় যেসকল ছবি ব্যবহার করা হয় সেগুলো ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে আপলোদ দেয়া হয় গ্রাহককে আকর্ষণ করার লক্ষে। ফলে ছবি দেখে এক খাবার অর্ডার করে আরেক খাবার পাবার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে গ্রাহকদের। এছাড়া আছে পচা খাবার ডেলিভারি পাবার অভিজ্ঞতা। এ ক্ষেত্রে ফুডপান্ডাকে অভিযোগ করলে তারা জানায় তাদের সেবা শুধু খাবার পৌঁছে দেয়া, প্যাকেট খাবার খুলে দেখার পলিসি তাদের নেই। কিন্তু ফুডপান্ডায় ডেলিভারি হওয়া খাবারটি আদৌ রেস্টুরেন্ট দিচ্ছে কিনা, এটি নিশ্চিত করা অবশ্যই ফুডপান্ডার দায়িত্বের মধ্যেই পরে। গ্রাহক দাম দিয়ে যদি সেই খাবারটি খেতেই না পারে, পচা খাবার যদি ফুডপান্ডা দুয়ারে পৌঁছে দেয়াটাই শুধু দায়িত্ব মনে করে তাহলে এ ধরনের সেবা মানুষ নিবে কেন?

ফুডপান্ডা মানুষের সময় বাঁচাচ্ছে, এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগের পাহাড়, তা নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের এখনই ভাবা উচিত। ফুডপান্ডার ম্যনেজিং ডিরেক্টর আম্বারীন রেজা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, গ্রাহকদের বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতা দিতে নতুন সেবা ও ফিচার চালু করছেন তারা। এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং সেবা যেন ভাওতাবাজি, এবং গ্রাহক ভোগান্তির না হয় তা নিয়ে যেন ভাবে এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭