লিভিং ইনসাইড

একজন কিং খান এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি


প্রকাশ: 04/10/2022


Thumbnail

কয়েকদিন ধরে মিডিয়া পাড়াতে তুমুল শোরগোল চলছে। বাংলাদেশের সুপারস্টার শাকিব খান এবং বুবলীর বিষয়টি এখন শুধুমাত্র ঢালিউড পাড়াতেই নয় বরং দেশের প্রত্যেক মানুষের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘটনার মুদ্রার এ পাশে আপাতদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ কিংবা বলা যেতে পারে মসলাদার হলেও আমরা কিন্তু কেউ এই  মুদ্রার বিপরীত পাশটা নিয়ে ভাবছি না। আমরা ভাবছি না কিভাবে একজন বিত্তবান পুরুষ একটার পর একটা সন্তান দিচ্ছেন, সেই সন্তান গোপনে জন্ম নিচ্ছে এবং দিন শেষে সেই জনপ্রিয় মুখ তার বাচ্চার পিতৃত্বের দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছেন গণমাধ্যমে। আর এই ঘটনা শুধু একবার নয়, বারবার ঘটছে।

সিনেমা এবং সিনেমায় অভিনয় করা অভিনেত্রী অভিনেতা সব সময় সমাজে অনুকরণযোগ্য হয়ে থাকে। আর এই অনুকরণযোগ্য ব্যক্তিদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সমাজের মানুষ ভালো কিছু কোন মাধ্যম থেকে শিখবে তার প্রশ্ন থেকেই যায়। এখানে একটা বিষয় আমরা খেয়াল করি যে দুইজন জনপ্রিয় মুখ,বুবলী কিংবা অপু একই সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছেন। কিন্তু কেউই এখানে ছেলেটিকে অর্থাৎ শাকিব খানকে দুষছেন না। সন্তান জন্মদান, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বার বার ঘটানো, টাকা দিয়ে ধাপাচাপা দেয়া এইসবই শাকিব খানের একটা বিবেকহীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন। কিন্তু এইসব করার পরেও দুইজন নারীর একজনও  আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গেলেন না। একটা পর্যায়ে এসে দুইজনই চুপ থেকে গেলেন। তাহলে শুধুমাত্র কি টাকার জোরে একজন বিত্তবান পুরুষ সব কিছু করতে পারেন? সমাজে মানুষ এই অনুকরণটিই হয়ত নিবেন যে টাকা দিয়েই সব অপকৃতি মাটির নিচে দাবিয়ে রাখা যায়।

বাংলাদেশ তথা নারীর উন্নয়ন, নারী মুক্তি, নারীদের সাবলম্বীকরণের ক্ষেত্রে পুরো বিশ্ব এখন সোচ্চার। কিন্তু আদৌ এই সোচ্চার কাজে লাগছে তো? গত কয়েকদিনের ঘটনা এবং কয়েক বছর আগের ঘটনায় কি নারীর সাবলম্বী হওয়া, নারীর উন্নয়নের ফলে কোন সোচ্চার পদক্ষেপ কি আমরা দেখলাম? নাহ, এই প্রশ্নগুলোই শুধু আমরা করতে পারি, কিন্তু আদৌতে এর উত্তর না আসবে। যে জনপ্রিয় দুইজন নারী এই ঘটনার সাথে যুক্ত হলেন, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল, তারা বাংলাদেশের সিনেমা অঙ্গনের জনপ্রিয় মুখ। কিন্তু তারা এই অন্যায় মেনে নিলেন। যেখানে এই দায়িত্ব জ্ঞানহীন অপরাধের শাস্তি পাওয়ার কথা ছিল শাকিব খানের, সেখানে কোন আওয়াজই উঠানো হল না। তাহলে নারী মুক্তি, নারীর সাবলম্বী হওয়ার রিফ্লেকশন যদি আমরা এই জনপ্রিয় মুখগুলোতেই না দেখতে পাই, তাহলে এদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা হাজার নারীর নির্যাতনের ঘটনা অবাক করবে না কাউকেই।

যখন কোন নারী-পুরুষ ঘটিত কোন ঘটনা ঘটে, অনেকেই বিচার করতে চান নারীর দোষ এখানে কতটা। অন্য কোন উদাহরণ টানছি না, সিনেমা পাড়ার উদাহরণ দিয়েই বলছি, যখন বাংলা সিনেমার আরেক নায়িকা পরীমণি মাদক মামলায় গ্রেফতার হলেন, অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগেই একাধিক নারী সহকর্মীই তার বিরুদ্ধে কথা বলে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এছাড়া পরীমণিকে সিনেমা সংগঠন থেকে বাতিল বা নিষিদ্ধ ঘোষণাও করা হয়। কিন্তু যখন শাকিব খানের সন্তান নিয়ে অপু বিশ্বাস মিডিয়ার সামনে আসলেন, কোন সিনেমা সংগঠনই শাকিব খানের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠায়নি। গত কয়েক দিনে বুবলীও যে ঘটনার একই অবতার নিয়ে আসলেন, সেটাতেও কার মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় নাই। বরং এটি শাকিব কিংবা বুবলী, অপু কিংবা শাকিবের সংসারের কেচ্চা হিসেবেই রয়ে গেল। এছাড়া সিনেমা জগতের অন্ধকার যে যুগে নায়িকারা অভিনয় করেছিল এবং কালের বিবর্তনে হারিয়েও গিয়েছেন বা নিষিদ্ধ হয়েছেন তাদের সাথেও শাকিব খান অভিনয় করেছেন। কিন্তু সিনেমাপাড়া থেকে হারিয়ে গেছেন শুধু তারাই, হারায়নি শাকিব। কারণ শাকিব পুরুষ, এই পুরুষশাষিত সমাজ শাকিবের দোষ খুঁজে পায় না।

শাকিব, অপু, এবং বুবলীর এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা শুধুমাত্র তাদের সংসারের কেচ্চাই থেকে যাচ্ছে না। এই কেচ্চা সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে নারীর প্রতি পুরুষের নেতিবাচক অবস্থান। নারী সাবলম্বী হলেও সে পুরুষের আশায় বাঁচে। এই ঘটনা সেই ভুল তথ্যটিই দিবে। কারণ শাকিব খান শুধুমাত্র বাচ্চাই জন্ম দেয়াননি, বরং তিনি মাতৃত্বের মত, বিয়ের মত একটি বিষয়কে ধামাচাপা দেয়ার কাজটিও করেছেন। মজার বিষয়টি হল গোপনে এই বিবেকহীন কাজ করে গণমাধ্যমের সামনে দন্ত বিকশিত করে নিজের জাকজমকপূর্ণ বিয়ে করার ইচ্ছাও তিনি পোষণ করার সাহস রাখেন। আর এসব মুখ বুঝে মেনে নিয়েছেন এই দেশের সেই সকল নায়িকারা, যারা আদৌতে সাবলম্বী, মুক্ত চিন্তার নারী, কাজের জায়গায় যে সফল নারী। তাহলে এই ঘটনা কি শুধু মসলাই দিল? নাকি সমাজে একটা ভুল এবং ভয়ংকর একটি ম্যাসেজ দিয়ে গেল? এই ধরণের ঘটনা সমাজে আরও অপরাধ বাড়ায়, এই ঘটনা সমাজে আরও নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বাড়ায়। এখানে এটাও না বললেই নয়, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভভঙ্গি নারীদের মধ্যেও যে আছে, এটি তারই প্রমাণ।

নারীরা সোচ্চার হয় না দেখেই শাকিব খানের মত ছেলেরা পার পেয়ে যায়। নারীরা অন্যায় মেনে নেয় জন্যেই শাকিব খানের মত আপাত দৃষ্টিতে লম্পটরা সমাজে বুক ফুলে বাঁচে । টাকার জোরে এবং বিত্তের জোরে সমাজকে এবং নারীকে দাবায় রাখা যায় এই ভুল তথ্যটিও সমাজে বিষের মত ছড়িয়ে যায় এজন্যেই। ‘যত দোষ নন্দঘোষ’ রূপে নারীকেই ভাবা সমাজ উটপাখির ন্যায় মাথাগুজে থাকে। আর সেই সুযাগে জন্ম নেয় লম্পট কিং খানরাই। এখন  আপনারা আওয়াজ ওঠাবেন নাকি আরেকটি কিং খানের জন্ম দিবেন, এই প্রশ্ন আপনাদেরই, এই প্রশ্ন সমাজকেও।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭