ইনসাইড আর্টিকেল

ইডেন কলেজ এবং একটি মানবিক অবক্ষয়


প্রকাশ: 10/10/2022


Thumbnail

আমরা এখন দুটি জায়গায় বসবাস করি, প্রথমটি হল ডিজিটাল দুনিয়া এবং আরেকটি হল আমাদের সমাজ। ডিজিটাল দুনিয়াটা আমরা এখন বাস্তব ভেবে বসি। হরহামেশাই আমরা ট্রল করি, হাস্যরসে ভরা মিমস বানাই এবং অনেক সময় এই সামাজিক মাধ্যম হয়ে যায় যে কোন ইস্যু তৈরির একটি বড় মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কখন যে কার জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে তা আমরা বুঝতে পারছি না। ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকারও হতে হচ্ছে নানা ভাবে। এছাড়া কাউকে নিয়ে অসত্য সংবাদ, ভিডিও প্রকাশ কিংবা ঘৃণামূলক ও শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্য যে কাউকে সামাজিক ভাবে হেয় হতে সাহায্য করছে কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে। কিন্তু তা নিয়ে কার মাথাব্যথা নেই, শুধু ফেসবুক ট্রলিং, সাইবার বুলিং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ঝড়ের গতিতে যা আমাদের মানবিক অবক্ষয়কে তুলে ধরে

উপরের কথাগুলো নতুন প্রসঙ্গে আসার জন্যে বলা। দুটি প্রসঙ্গেরই অন্তর্নিহিত মিলও আছে। নতুন যে প্রসঙ্গটি নিয়ে বলব সেটি সাম্প্রতীক সময়ে ঘটা ইডেন মহিলা কলেজের বিষয়ে। ইডেন মহিলা কলেজ, একটি ঐতিহাসিক কলেজ। এই কলেজে পড়েছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দিলারা জামান, মতিয়া চৌধুরী সহ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মত মহীয়সী নারীরা। কিন্তু আজ ইডেন মহিলা কলেজ নিয়ে যা হচ্ছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক । অবশ্যই রাজনৈতিক নানান সমস্যা , ছাত্রলীগের ন্যাকারজনক ঘটনা গুলো একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের ইমেজের জন্য খারাপ তকমা বয়ে নিয়ে আসছে কিন্তু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুটিকয়েক মানুষের  উশৃঙ্খলতা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম খারাপ করতে পারেনা অবশ্যই। ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতি ক্ষুদ্র সংখ্যকের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততা অবশ্যই পুরো ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে ট্রলের মত ঘটনা তৈরি করতে পারেনা। কিন্তু আমরা তা করছি এবং প্রতিনিয়ৎ নতুন কন্টেন্ট বানিয়ে হাস্যরসে ফেটে পরছি।

ইডেন কলেজে আমার এক পরিচিত ছোট বোন পড়ছে। সে ভ্রমন বিষয়ক একটি গ্রুপ পরিচালনাও করে। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম তার এখন খুব মন চায় ফেসবুক পেজ থেকে সে যে ইডেন কলেজে পড়ে সেই তথ্যটি সরিয়ে ফেলতে। তাকে কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে জানাল, শুধুমাত্র ফেসবুক ট্রলই নয় এখন তার ইনবক্সের ম্যাসেজেও বাজে বাজে মন্তব্য করেছে। সে ভীষন দুঃখ করে জানাল যে তার আর কোথাও বলতেও ইচ্ছে করেনা সে ইডেন কলেজে পড়ে। 
ইডেন কলেজের আরেক শিক্ষার্থী তার অভিজ্ঞতা জানায় আমাকে, ভীষণ আক্ষেপ নিয়েই সে কথাগুলো বলছিল আমাকে। সে জানায় সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে  তাকে  প্রতিনিয়ত বুলিং, হ্যারেসমেন্ট এর স্বীকার হতে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বাস্তব জীবনে সর্বক্ষেত্রে। তার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে সে বাসা ভাড়াও পায়নি। সে জানায়  যে আজিমপুর এলাকায় ইডেনের মেয়েদের বাসা ভাড়াটা পর্যন্ত মানুষ দিতে চায় না। কিছুদিন আগে সে বাসা ভাড়া নিতে চাইলে সেই বাসার বাড়িওয়ালা তাকে মুখের উপরে বলে দেয় ইডেনের মেয়েদের বাসা ভাড়া দেন না তিনি । তার মতে  কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতাদের অর্থহীন বক্তব্যে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রলের কারণে ইডেনের প্রত্যেকটা মেয়ে প্রতিনিয়ত সামাজিক ভাবে লাঞ্চিত হচ্ছে । এবং সে এও বলে তার বাবা মাকে আত্মীয় স্বজনরা  কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে তারা আমাকে ইডেনের  হলে রাখেন কি না ।  
আমার এখন জানতে ইচ্ছে করে এমনটা কেন হবে? একজন মেয়ে যে কিনা ভীষন ভালো একটি বিষয় নিয়ে এই কলেজে পড়ছে, যার রেজাল্ট এত ভালো, যে শুধুমাত্র পড়াশুনাই নয়, নানান কারিকুলাম এক্টিভিটিজের  সাথে জড়িত সে কেন তার নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্ব করতে পারবেন?কেন একজন মেয়ে শুধু ইডেন কলেজে পড়ে জন্যেই বাসা ভাড়া পাবেনা এবং কেন তাকে সামাজিক ট্রলের শিকার হতে হবে? আমরা কিন্তু কেউ এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছিনা।

ইডেন কলেজের ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি, হলগুলোতে সিট বাণিজ্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কলেজ প্রশাসনের নীরবতার বলি ইডেনের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এটা জানা কথা। কিন্তু এর বাইরেও ফেসবুক ট্রল এবং সামাজিক হেয়র বলিও এই সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ফেসবুক খুললেই ইডেন কলেজকে নিয়ে ট্রল ঘুরে বেড়ায়। এমন কি অন্য কোন নারী ঘটিত ট্রলের কমেন্ট সেকশনেও দেখা যায় ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ট্রল করা হচ্ছে। আমরা কেউ এটা কেন বুঝছিনা গুটি কয়েক মানুষের অপকর্মের ফল কেন ভুগবে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী। আমরা ভাবছিনা ওই শিক্ষার্থীদের পরিবার রয়েছে, সামাজিক মর্যাদা  রয়েছে, সামাজিক অবস্থান রয়েছে। ইডেন কলেজে ঘটা রাজনৈতিক ঘটনাগুলো জনসাধারণের বিনোদনের খোরাকে পরিণত হয়েছে এই ব্যপারটা যেমন ভীষন দুঃখজনক তেমনি ইডেন কলেজে পড়লেই সেই শিক্ষার্থী অপকর্মের সাথে জড়িত ভেবে তাদের নিয়ে ট্রল করাটাও অতি নিম্ন মানুষিকতার পরিচয় দেয় এবং অবশ্যই এটা ন্যাক্কারজনকও।


নৈতিকতা বলে একটি বিষয় আছে এটা যেন আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি আমাদের জীবন থেকে। নৈতিকতা এখন ঝাঁপসা । কোন বিষয়টি নিয়ে আমাদের আওয়াজ ওঠাতে হবে, কোন বিষয়টি নিয়ে ট্রল বানাতে হবে,আমরা যেন এর ফারাকই ভুলে গেছি। ইডেন কলেজে যে সকল ঘটনা ঘটেছে তা ইডেনের গুটিকয়েক মানুষের অপরাজনীতির ফলে ঘটেছে।  চাপ দিয়ে অনৈতিক কাজ করানোর যে অভিযোগ ইডেনের ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে উঠছে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠানো জরুরি ছিল। এ ধরনের অভিযোগ কেউ হাওয়ায় ভেসে করেনা বরং এর পিছে অবশ্যই কারণ থাকবেই। কিন্তু ইডেনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে যে সামাজিক ট্রল করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে তা শুধুমাত্র এই ধরনের গুরুত্বর অভিযোগকেই ধামাচাপা দেয় না বরং এই ধরনের অভিযোগগুলোকে খুব হালকা ভাবে হাস্যরসের খোরাকে পরিণত করে। কিন্তু আমাদের উচিৎ ছিল এই অপকর্মগুলো কেন হল, কেন একটি ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র রাজনীতি এতটা উশৃঙ্খল হয়ে উঠল এগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইস্যু তৈরি করে প্রশাসনকে সঠিক তদন্ত  করতে বাধ্য করা। কিন্তু তা না করে আমরা এই গুরুত্বর সমস্যাটিকে ফেসবুকীয় সাধারণ ট্রলে পরিণত করলাম। এবং এমন একটি ট্রলে পরিনত করালাম যা শুধুমাত্র সাধারন শিক্ষার্থীকে ফেলল     নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে আইডেনন্টি ক্রাইসিসের মধ্যে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা পেল সামাজিক হেয় অবস্থান। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইশ্যুই তাদের এই বলি দিল না, বরং ট্রল করে ব্যাপারটাকে আমরাও খারাপ অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিলাম।

পৃথিবী এখন বিশ্বগ্রামে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যে কোন ঘটনা যে কোন ইস্যু এখন শুধুমাত্র একটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছে না বরং এটি মুহুর্তের মধ্যে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে । যখন বাংলাদেশের কোন ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে এতটা বাজে ভাবে ট্রল করা হচ্ছে, যখন শিক্ষার্থীদের ব্যপারে হাস্যরসে পরিপূর্ণ অযৌক্তিক ট্রল বানানো হচ্ছে তখন খুব স্বাভাবিক ভাবে এটি বাইরের দেশে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে নেতীবাচক ভাবমূর্তী তুলে ধরছে। ইডেনে ঘটা ঘটনার দায় একজন সাধারণ শিক্ষার্থী নিতে পারেনা।  রাজনৈতিক মারপ্যাচের দায়ও অবশ্যই সেই সাধারণ শিক্ষার্থী নিতে পারে না। ট্রল কি নিয়ে করতে হবে, কাকে নিয়ে করতে হবে এবং ট্রল করার প্রয়োজনটাই আসলে কতটুকু এটি নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। শুধুমাত্র নোংরা হাস্যরসের জন্য সমাজে থাকা আর কিছু মানুষের জীবন দুর্বিসহ যেন না হয় এটি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। অন্যায় হলে অন্যায় নিয়ে আওয়াজ তুলতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে সিরিয়াস ইস্যু ট্রলে পরিনত হয়ে নেহাৎ যেন সাধারণ হাস্যরসে পরিণত না হয়।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭