ইনসাইড আর্টিকেল

চোখে সর্ষেফুল কি শুধু মধ্যবিত্তের?


প্রকাশ: 12/10/2022


Thumbnail

হুমায়ুন আহমেদের একটা উক্তি এমন, "মধ্যবিত্ত হয়ে জন্মানোর চেয়ে ফকির হয়ে জন্মানো ভালো। ফকিরদের অভিনয় করতে হয়না কিন্তু মধ্যবিত্তদের সুখে থাকার প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যেতে হয়"। উক্তিটিতে আবেগ থাকলেও কর্কশ বাস্তবতা ঠিক এটাই। মধ্যবিত্ত এমন একটি অবস্থানে থাকে, যেখানে চাইলেই হাত পাতা যায়না, চাইলেই আবার ভালো জীবন যাপন করাও যায়না। আর বাংলাদেশে যে অসমতার সৃষ্টি হয়েছে তাতে রীতিমত মধ্যবিত্তরা চোখে সর্ষেফুল দেখছে।

কয়েকদিন আগেই ফেসবুকের একটি মিমস দেখলাম, পাশাপাশি দুটি ভিডিও একসাথে জোড়া লাগিয়ে বানানো মিমসের একটি ভিডিওতে দেখলাম একজন ডাক্তার তার মাসের বাজারের খরচের হিসাব দিচ্ছেন। তিনি বললেনও আমি চিকিৎসক, টাকা আনি এবং ঢালি, দাম কোনটার কেমন তা দেখার প্রয়োজনবোধ করিনা। এবং অপর ভিডিওটি একজন মাঝ বয়সি লোকের, টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কেঁদে সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন, বলছিলেন বেতন মাত্র ৯ হাজার, এতে সংসার চলেনা বাবা, আত্মমর্যাদার ভয়ে এই লাইনে এসেও দাঁড়াতে পারিনা, কিন্তু আজ আর না পেরে দাঁড়িয়েছেন লাইনে। ফেসবুকের মিমস দেখে সবসময় হাসি পেলেও এই মিমস মনে দারুণ রেখাপাত ঘটালো। আর এই ভিডিওটি যে কার মনে প্রশ্নের জন্মও যেমন দিবে তেমনি চোখে আঙ্গুল দিয়েও দেখিয়ে দিবে সমাজের অসম বন্টনের ভয়ংকর রূপ।

অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) সংজ্ঞা অনুসারে, যাঁরা দিনে ১০ থেকে ১০০ ডলার আয় বা ব্যয় করেন, তাঁরাই মধ্যবিত্ত। এবং তাদের হিসাব মতে ২০২০ সালে এশিয়ায় মধ্যবিত্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৭০ কোটি। আর ২০৩০ সালে বৈশ্বিক মধ্যবিত্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪৯০ কোটি। হিসাব অনুসারে তাহলে বলাই যায় বিশ্বে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই শ্রেণীটিই সব থেকে বেশি সংগ্রাম করে জীবন অতিবাহিত করে এবং এই এদের নিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্র খুব কমই ভাবে।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধি, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সব কিছুর মাঝে পিষে মরছে মধ্যবিত্তরা। নিম্ন আয়ের মানুষরা পায় উচ্চবিত্তদের থেকে ত্রান সাহায্য। কিন্তু মধ্যবিত্তরা পরে থাকে এই দুইয়ের মাঝে। ভালো এবং খারাপের মাঝামাঝি জীবনযাপন করতে গেলেও ভোগান্তি এবং নাভিশ্বাস উঠে যায় মধ্যবিত্তের। জীবনযাপনের কষাঘাতের শেষ কষ্টটুকুও থুতুর মত গিলে ফেলতে হয় তাদের। আয়ের সাথে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে বারবার ধাক্কা খেতে হয় মধ্যবিত্ত শ্রেনীর।

মধ্যবিত্তেরা আত্মসম্মানেরও একটি গ্যাড়াকলে পরে থাকে। জীবন না চললেও কষ্ট ভোগ করা হোক, কিন্তু হাত পাতা চলবে না। যেমন, যে দূরত্বে কিছুদিন আগেই রিক্সাভাড়া ছিল ৬০ টাকার সেই দূরত্বে রিক্সাভাড়াও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়। রিক্সাওয়ালারা ন্যায্য দাম বাড়িয়ে দিল ঠিকই, মধ্যবিত্তরা কি পারল নিজের চাকরির দাম বাড়াতে? দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে, বাসাভাড়া বাড়ছে, চারপাশের সব কিছুরি দাম বাড়ছে। বাড়ছেনা শুধু মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের দাম। মধ্যবিত্ত পারেনা ১০ টাকা কমাতে রিক্সাওয়ালার সাথে বাকবিতন্ডায় জড়াতে, পারেনা নিজের আত্মসম্মান নিয়ে দাঁড়াতে কোন সহায়তার লাইনে।

আমাদের সমাজে বরাবরই মধ্যবিত্তরা চাপে থাকে। করোনা মহামারীতেও আমরা দেখেছি সেটা। করোনাকালীন সময়ে নিম্নবিত্তরা পেয়েছে নানা সাহায্য সহযোগিতা। কিন্তু মধ্যবিত্তের কথা কয়জন চিন্তা করেছে। মধ্যবিত্তের শ্রেণির লোকদের কষ্ট লাঘবে কেউ এগিয়ে আসে না। এগিয়ে আসেনা সমাজ, না রাষ্ট্র। বরং করোনাকালে উচ্চবিত্ত বলে লাভবান হয়েছিল খাদ্যপণ্য, চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সে সময় অনেক পরিবারকে ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল, হারাতে হয়েছিল চাকরী। আর এসব ঘটনাগুলো ঘটেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষের সাথেই।

মধ্যবিত্তের আয়ের থেকে ব্যয় এখন বেড়েছে বেশি। বাংলাদেশে জাতীয় আয় এবং মাথাপিছু আয়ের তালিকা প্রকাশিত হয় গড় হিসেবে। আর এই হিসাব বের হয় মোট জাতীয় আয় এবং দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে। ফলে এই অংশে ধনী গরিব মধ্যবিত্ত সবার আয়ই একসাথে দেখায়, ফলে ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত সবার আয়ই দেখা যায় একই। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি এক? চিত্র ঠিক ভিন্ন। দেশে ধনি-গরিবের পার্থক্য কমেনা বাস্তবে, উল্টো এই দুইয়ের মাঝে হা হুতাশ করে মারা পরে মধ্যবিত্তরাই। মধ্যবিত্তের জীবনের উন্নয়ন তো হচ্ছেই না বরং আরও জটিল হয়ে উঠছে। বিশ্ব মন্দার যে আশঙ্কা জাতিসংঘ দেখিয়েছে তা যদি ছড়িয়ে যায় যে কোন দেশ থেকেই এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি হারিয়েও যেতে পারে। এবং সারা বিশ্বেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংকুচিত হচ্ছে। কিন্তু এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিই সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখে। বাংলাদেশের মত একটি দেশের জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেক গুরুত্ব রয়েছে কারণ এই শ্রেণীর প্রতিনিধিতত্বকারীদের বেশিরভাগই চাকরি করে। কেউবা নানা উৎপাদনশীল পেশায় যুক্ত থাকছে। এবং গ্রামে-গঞ্জে এখন সাধারণ কৃষিকাজের বাইরেও নানা ধরনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রকল্প গড়ে উঠছে। 

বাংলাদেশে ১৯৯২ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। এখন আমাদের সমাজে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি আমরা দেখি তা হলো নিছক অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত। এই শ্রেণী চাকরি করে, কিংবা গ্রাসাচ্ছাদনের চিন্তা করে যুক্ত হয়ে পরে এক থেকে একাধীক কাজের সাথে। অর্থাৎ এই শ্রেনি শুধু ছুটছে। কাজের পেছনে, জীবন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে। কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্র ভাবছেনা এদের নিয়ে। তাইতো দিন শেষে এরা নামে মাত্র আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচে, আর অর্থনৈতিক চাপ, সামাজিক চাপের নিচে পিষে যেতে থাকে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করে। লেখাটি মধ্যবিত্ত শ্রেনী নিয়ে হলেও দেশে ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত সবার জীবনের আয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা উচিৎ। এবং অবশ্যই মধ্যবিত্ত শ্রেণীটির দিকেও সমাজ ও রাষ্ট্রের সমতার নজর পরা উচিৎ। আর সমাজের বৈষম্যের কষাঘাতে যেন এই শ্রেণীটি না পরে সেটিও নজরে রাখতে হবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭