ইনসাইড আর্টিকেল

লুডুর ঘুঁটির ছক থেকে বের হতে হবে


প্রকাশ: 14/10/2022


Thumbnail

আমার বাসার পাশেই পাড়ার একজন বড় ভাই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই বিসিএস ক্যাডার হওয়াটা কি খুব জরুরি? ভাই খুব প্রতিজ্ঞভাবে মাথা ঝুঁকে বললেন, অবশ্যই জরুরি। বিসিএস ক্যাডার হলে বাড়ি-গাড়ি, ক্ষমতা সব তখন তোমার হাতের মুঠোয়। আর খুব লাজুক মুখে বললেন, ভালো বউও কিন্তু পাওয়া যায়।

বিসিএস, অবশ্যই বাংলাদেশের একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বা বিসিএস এ মোট ২৭টি ক্যাডারে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্য থেকে জনবল নিয়োগ করা হয়। বিসিএস এর মাধ্যমে প্রথম শ্রেণীর গেজেটভুক্ত কর্মকর্তা নিয়োগপ্রাপ্ত হন। যেহেতু চাকরির বাজারের অবস্থা এখন খারাপ, সেক্ষেত্রে অনেকেই মনে করেন বিসিএসের মাধ্যমে ভালো একটি সরকারি চাকরি জুটে যাবে। এখন বলি লেখার শুরুতে যে গল্পটি দিয়ে শুরু করেছিলাম তার ব্যাপারে। যখন একজন বিসিএস ক্যাডার প্রশাসনের আমলা পদে বসেন তখন তার জনগণের সেবাই হওয়া উচিৎ প্রথম ব্রত। কিন্তু আপনি যদি বিসিএস পরীক্ষাধারীদের ১০০ জনকে জিজ্ঞেস করেন, কেন তারা বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন? আপনি ৮০% উত্তরে পাবেন আমার শুরুতে লেখা সেই কথাটিই। তাহলে আমরা কি বলব, বিসিএস শুধুমাত্র ক্ষমতার, সামাজিক মর্যাদার?

বাংলাদেশে অনেক চাকরির সুযোগ রয়েছে।কিন্তু সেই স্থলে দক্ষ কর্মী মেলে না। ফলে সেই সকল চাকরির স্থলে কাজ করছেন ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির লোকেরা। ২০১৯ সালের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ বিদেশি কর্মী কাজ করছে , বলাই যায় এ কয় বছরে সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে । আর এসকল কর্মীরা কাজ করছেন বাংলাদেশের  ফ্যাশন ও ডিজাইনিং, ভারী যন্ত্রপাতি পরিচালনা, বিপণন, সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি খাতে। আর সব থেকে বেশি নিয়োগ পাচ্ছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে। যারা এই নিয়োগগুলো দিচ্ছেন তাদের মতে বাংলাদেশের এই খাতগুলোতে দক্ষ কর্মীর অভাব, এজন্যেই তারা বাইরের দেশের এসব কর্মীকে বেশ ভালো অংকের বেতনের বিনিময়ে দেশে নিয়োগ দিচ্ছেন। আর এসকল বিদেশি কর্মী নিয়োগ হচ্ছে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশে আর তা হলো উন্নয়ন, উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রমের মত  সেক্টর গুলোতে। কিন্তু কেন বাংলাদেশের দক্ষ কর্মী নেই এই সেক্টরগুলোতে? সে প্রশ্নের উত্তর আমরা কিন্তু সকলেই জানি।

সরকারি চাকরি সোনার হরিণ,কেন সোনার হরিণ তাও সকলেরই জানা। আর অনেকেরই এই সোনার চাকরির পেছনে দৌড়ানোর প্রবণতা ঢুকিয়ে দেয়া হয় ছোটবেলা থেকেই। আমাদের দেশে শুধুমাত্র একাডেমিক সাফল্যই বিচার করে একজন মানুষের সামাজিক মর্যাদা। আমি এমনও দেখেছি একই পরিবারের দুটি সন্তান একজন হয়তো একাডেমিক ভাবে ভীষণ  ভালো ফলাফল করছে কিন্তু আরেকজন একাডেমিকভাবে  ভাল ফলাফল না করলেও সে হয়ত খেলাধুলায় ভালো, আঁকাআঁকিতে ভালো, জটিল চিন্তায়  ভালো, কিন্তু বাসা থেকেই ভালো মর্যাদা এবং প্রশংসা  পাচ্ছে সেই একাডেমিকভাবে ভালো সন্তানটি। কিন্তু দুইজনই কিন্তু সমান  প্রশংসার দাবিদার।  শুনতে খুব খারাপ লাগলেও বাস্তবতাটা তাই। আমাদের ছোটবেলা থেকেই প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়, জিপিএ ফাইভ, ভাল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং শেষতক সরকারি চাকরি। আর যে এই তিনটিই পার করতে পারল সেই সফল, সমাজে মর্যাদাবান। আর ওই যে ছোটবেলাতেই ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে সরকারি চাকরি সোনার হরিণ কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, সেহেতু  চল তবে আঁটঘাট বেঁধে বিসিএস পরীক্ষায় নেমে যাই।

বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরি জোটে, এটা যেমন সত্যি তেমনি আরেকটি সত্য হল নিরাপত্তা। সরকারি চাকরির পেছনে দৌড়ের আরেকটি  কারণ হচ্ছে নিরাপত্তা। সরকারি চাকরিতে যদি দুর্নীতি করা হয়, প্রমাণিত হলে বড়জোর  ওএসডি করা হয় বা কখনো কখনো বদলি করা হয় কিন্তু চাকরি সে হারায় না। এটা একটা সামাজিক নিরাপত্তাই, চাকরি না হারানোর নিশ্চয়তা । এছাড়া আছে অবসরে গেলে অবসর ভাতা পাবার একটি সুযোগ। আর বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকরি পেলে এই নিরাপত্তাটাও  মিলছে, এছাড়া বাংলাদেশে সরকারি চাকুরেকে কেউ বিনা অনুমতিতে গ্রেফতার করতে না পারার যে আইন চালু হয়েছে এটাও আরেকটা নিরাপত্তা এনে দিচ্ছে।মোট কথা এই সামাজিক নিরাপত্তাদের  জন্যেও কেউ কেউ বিসিএসকেই ধ্যান জ্ঞান করে ফেলছে।

একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন, উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রমের মত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর গুলোর উপরে । কিন্তু আমাদের এই সেক্টরগুলোতে দক্ষ কর্মী নেই। বিসিএসের পেছনেই শুধু না ছুটে এই সেক্টরগুলোতে কাজ করার মত বাংলাদেশি দক্ষ কর্মী  গড়ে তুলতে হবে। কারিগরি জ্ঞান, নিরাপত্তা, মর্যাদা এই চাকরিগুলোর ক্ষেত্রেও বৃদ্ধি করতে হবে। বিসিএস হলেই জীবনে উন্নয়ন সম্ভব কিন্তু অন্য সেকশনে চাকরি করলে জীবনের উন্নয়ন সম্ভব নয়, এমন ধারণা থেকেও আমাদের বের হতে হবে। দেশে যে সকল চাকরি গুলোতে বিদেশি কর্মীরা কাজ করছে সেগুলো খুঁজে বের করে সেই স্থলে কিভাবে দক্ষ কর্মী আমাদের দেশে তৈরি করা যায় এবং তরুণ সমাজ যাতে সেই সেক্টরগুলোতে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আজকাল বিসিএস ক্যাডার হলেই গণমাধ্যম ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করে। এই মানসিকতা থেকে সংবাদমাধ্যমকেও বের হতে হবে। গণমাধ্যমের উচিৎ বিসিএস পরীক্ষাকে সেই অন্যান্য চাকরির কাতারে ফেলা এবং অন্যান্য পরীক্ষার মত করেই সবার সামনে তুলে ধরা। কেন একজন বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সংবাদ পত্রের মূল পাতায় উঠে যাবেন আর কেন একজন সরকারি ব্যাংকের পরীক্ষা দিয়ে টিকে গেলে পত্রিকা তার খোঁজ নিবেনা এই মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। গণমাধ্যমেরও উচিৎ একটি পরীক্ষাকে সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে তুলে না ধরে সব পরীক্ষার মত করে এটিকে তুলে ধরা। আর এখনকার বাবা মায়েরও উচিৎ এই মানসিকতা থেকে বের হওয়া, সন্তানকে বড় হয়ে বিসিএস ক্যাডারই হতে হবে এমন চিন্তা সন্তানের মধ্যে না ঢুকিয়ে দেয়া।

বিসিএস পরীক্ষা হলেই জীবনে সাফল্য আসবে না হলে নয় এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। বিসিএস না হোক লুডুর ঘুঁটির ছক,বের হতে হবে এই ছক থেকে। চাকরি হোক সেবার মানসিকতায়, না হোক দুর্নীতি, ক্ষমতা, অর্থ এবং সামাজিক মর্যাদার নামে। যে কোন চাকরিই হোক সম্মানের, যে কোন চাকরিই প্রতিনিধিত্ব করুক স্বনির্ভরতার, যে কোন চাকরিই হোক মর্যাদার। শুধুমাত্র বিসিএসই না হোক সম্মানের চাকরি। তা না হলে সমাজে সেবা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে হয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে শুধুমাত্র ক্ষমতা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭