এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগের বিপন্ন বিস্ময়


প্রকাশ: 15/10/2022


Thumbnail

গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচন ছিল নিস্তরঙ্গ। উত্তাপহীন। সাবেক ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। যথারীতি বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জাতীয় পার্টি। ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকার পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। কোথাও কোনো গোলযোগের খবর পাওয়া যায়নি। ১২ অক্টোবরের এ উপনির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের ভিতরে সিসিটিভি লাগানো হয়েছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনাররা নির্বাচন কমিশনে বসে ভোটের অবস্থা সিসিটিভি ফুটেজের বদৌলতে দেখছিলেন। দেখতে দেখতেই সিইসি যেন ‘চোর’ ধরছিলেন। বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে ৫০টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাদে বাকি প্রার্থীরা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। যেন পরিকল্পিত চিত্রনাট্য। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেন অধীর আগ্রহে এরকম একটি ‘শুভক্ষণের’ অপেক্ষা করছিলেন। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বন্ধ করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদটি সাংবিধানিক। জনগণের ভোটের অধিকার সুরক্ষা তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব। তাই ভোট তিনি বন্ধ করতেই পারেন। কিন্তু ভোট বন্ধ করার পেছনে অবশ্যই যুক্তিসংগত বাস্তব কারণ থাকতে হবে। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে আদৌ কি সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল? একটি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব রিটার্নিং অফিসারের। রিটার্নিং অফিসার কি ভোট বন্ধের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন? বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন প্রিসাইডিং অফিসাররা। তারা কি লিখিত কিংবা মৌখিকভাবে বলেছিলেন ভোট কেন্দ্রের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই? গাইবান্ধায় নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা হয়েছিল? কেউ আহত বা নিহত হয়েছিল? না, রিটার্নিং অফিসার ভোট নিয়ে কোনো অভিযোগ পাননি। প্রিসাইডিং অফিসাররা কেউ বলেননি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাহলে কেন এবং কীসের ভিত্তিতে সিইসি ভোট বন্ধ করলেন? এর পেছনে কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? গাইবান্ধায় ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৪৫। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই ৫০টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে, তাহলে বাকি ৯৫টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ হলো কেন?

এর ফলে গাইবান্ধার একটি প্রায় গুরুত্বহীন উপনির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হলো। নির্বাচন কমিশন এ ভোট বন্ধের মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিল। আওয়ামী লীগ যে-কোনো উপায়ে ভোটে জয়ী হতে চায়। ভোটে জিততে আওয়ামী লীগ এমন কারচুপি করে যে নির্বাচন কমিশন নিরুপায় হয়ে ভোট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। কিছুদিন ধরে বিএনপি, সুশীলসমাজ, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রায় একই সুরে কথা বলছে। বিএনপি বলছে, এ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এ দাবিতে তারা আন্দোলন জমিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। সুশীলরা বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। অর্থাৎ বিএনপিকে নির্বাচনে আনতেই হবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের তো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মাথাব্যথার অন্ত নেই। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত একাধিকবার নির্বাচন কমিশনে ছুটে গেছেন। কখনো একা, কখনো মিত্রদেশের কূটনীতিকদের নিয়ে। সিইসি তাদের আশ্বস্ত করেছেন। এসব বৈঠকের পর নতুন নির্বাচন কমিশন তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নয় বরং নির্বাচন কমিশন কাউকে কেয়ার করে না। নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতহীন এটা প্রমাণে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। নির্বাচনের দেড় বছর আগে নির্বাচন কমিশন ডিসি-এসপিদের নিয়ে বৈঠক করে ৮ অক্টোবর। এ সময় কেন ডিসি-এসপিদের নিয়ে বৈঠক? একজন ডিসি বা এসপি একটি জেলায় দু-তিন বছর থাকেন। এখন যারা বিভিন্ন জেলায় এসব পদে আছেন তাদের বেশির ভাগই আগামী নির্বাচনের আগে অন্যত্র বদলি হবেন। এ ধরনের বৈঠক সাধারণত করা হয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময়। নির্বাচন কমিশন বর্ষায় শীতের গান গাইল কেন? এ বৈঠকে আবার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের বিরুদ্ধে হইচই করলেন। একজন নির্বাচন কমিশনার তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ আনলে তাঁরা প্রতিবাদ করেন। একজন সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তি ঢালাওভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ কীভাবে আনেন? হাততালি পাওয়ার জন্য? নাকি কাউকে খুশি করার জন্য? নির্বাচনকালীন (যে নির্বাচনই হোক না কেন) যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা নির্বাচন কমিশনের অধীন। কেউ যদি সত্যি কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন তাহলে তা শৃঙ্খলাভঙ্গ। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো যিনি বা যারা এ ধরনের কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তা না করে ঢালাওভাবে এ ধরনের অভিযোগের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।


ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গাইবান্ধার উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশন বীরত্ব দেখাল। মেরুদণ্ড আছে এটা প্রমাণের চেষ্টা করল। নিজের মেরুদণ্ডের প্রমাণ করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন আসলে আওয়ামী লীগকেই ‘ভোট চোর’ বানিয়ে ফেলল। এর উদ্দেশ্য কী তা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এর অনেক রকম ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ একে সাজানো নাটক বলছেন। তাঁদের মতে, এই গুরুত্বহীন নির্বাচনে ভোট বন্ধ করে কমিশন আসলে ফাঁদ পাতল। নির্বাচন কমিশন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেখাল তারা কত ক্ষমতাবান। সরকারকে পরোয়া করে না। এক ঘোষণায় নির্বাচন বন্ধ করে দেয়। কাজেই এটা রকিব বা হুদা কমিশন নয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলবে, বাঃ! বেশ তো। আউয়াল কমিশনের কোমর শক্ত। বিরোধী দলকে বোঝাবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার নেই। এ কমিশনের অধীনেই তোমরা নির্বাচনে যেতে পারো। আমরা তো আছি। গাইবান্ধার নির্বাচন দিয়ে আসলে বিএনপিসহ অন্য অবিশ্বাসী দলগুলোকে নির্বাচনের মাঠে আনার ফাঁদ পাতা হলো। তবে বিএনপির অতি চতুর বুদ্ধিজীবীদের এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতাদের কথাবার্তায় মনে হয়েছে আওয়ামী লীগ হতবাক, বিস্মিত, স্তম্ভিত। নির্বাচন কমিশন বিনা কারণে যেন আওয়ামী লীগের গালে কশে চড় মেরে দিয়েছে। ১৯৯১ সালে বিএনপি জমানায় মাগুরা, মিরপুর নির্বাচন হয়েছে। ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোট পাল্টে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাগুরা থেকে হেলিকপ্টারে পালিয়ে এসে বলেছেন, ‘আমি অসহায়’। বিচারপতি রউফের ওই এক কথায় বিএনপির যে ক্ষতি হয়েছিল, ২০২২ সালে গাইবান্ধায় ভোট বন্ধ করায় আওয়ামী লীগের ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ। কেউ কি জেনেশুনে নিজের ক্ষতি করে?

এ ঘটনার পর বিএনপি তাদের পক্ষে অনেক কথা বলার সুযোগ পাবে। ইতোমধ্যে বিএনপি নেতারা যা বলা শুরু করেছেন। গাইবান্ধায় নির্বাচন কমিশনের অ্যাকশনের পর বিএনপির জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এক বড় প্রমাণিক যুক্তি হাজির হলো। আওয়ামী লীগের দখলে প্রায় পুরো সংসদ। সেখানে একটি নির্বাচনে হার তারা হজম করতে চায় না। কারচুপি করে জয়ী হতে চায়। একটি আসনের জন্য যদি আওয়ামী লীগ এত মরিয়া এবং বেপরোয়া হয় তাহলে এ সরকারের অধীনে ৩০০ আসনে কীভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব? বিএনপি বলছে, দেখুন আওয়ামী লীগের একান্ত অনুগত নির্বাচন কমিশনও তাদের ভোট কারচুপির বাড়াবাড়ি সহ্য করতে পারছে না। অসহ্য হয়ে তারা নির্বাচন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। ৩০০ আসনে তাহলে কী হবে? তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার। বিএনপি এও বলছে, আওয়ামী লীগ জোর করে ভোটে জিততে চায়, এটা গাইবান্ধায় প্রমাণিত হলো। ২০১৮ সালের পর বিভিন্নভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটের অধিকার হরণের যে অভিযোগগুলো করা হচ্ছিল, গাইবান্ধায় ভোট বন্ধ করে নির্বাচন কমিশন যেন রায় তার ঘোষণা করল। জানিয়ে দিল সব সত্যি। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ দুর্বৃত্ত।

কিন্তু রাজনীতি সরল অঙ্ক নয়। রাজনীতির জটিল হিসাব- নিকাশ অনেক সময় দুর্বোধ্য। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন ‘নিরপেক্ষ’ তথাকথিত পরিচ্ছন্ন ব্যক্তির ওপর আস্থা রাখতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পদটি নিরপেক্ষ রাখতে। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে। এজন্যই সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রয়াত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন কীভাবে পদে পদে আওয়ামী লীগকে বিব্রত করেছেন, নাজেহাল করেছেন ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেবে। করিৎকর্মা ও দক্ষ ভেবে সাবেক আমলা এম এ সাঈদকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবর নির্বাচনে তিনি যেভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন তা ছিল অন্যায্য ও নজিরবিহীন। আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করাই যেন নিরপেক্ষতা প্রমাণের একমাত্র মাপকাঠি। ২০০১ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করা হয়েছিল আরেক সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানকে। আওয়ামী লীগ আশা করেছিল তিনি নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু শপথ নেওয়ার আগেই তিনি বিএনপিপিন্থি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের ১৩ মিনিটের মধ্যে ১৩ সচিবকে বদলি করে প্রমাণ করেছিলেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কাজ করাই নিরপেক্ষতা। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনে মধুর লোভে আসা নব্য ব্যবসায়ীরাই আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিরুদ্ধে অসত্য নোংরা মামলা করেছেন। হঠাৎ আওয়ামী লীগার হওয়া প্রভাবশালী আইনজীবীরাই শেখ হাসিনার পক্ষে মামলা লড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেও বিস্ময়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল আওয়ামী লীগকে। দুর্নীতির দায়ে এক বিচারপতিকে অপসারণ করার উদ্যোগ নিয়েছিল ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সে সময় দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারপতিদের বঙ্গভবনে চায়ের নিমন্ত্রণ জানানো হতো। সেখানে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হতো, এ পদ্ধতিটি অগ্রহণযোগ্য, অন্যায়। কিন্তু বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে এরকমই এক চায়ের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে সততার ফেরিওয়ালা এক ক্ষমতাবান আইনজ্ঞের হস্তক্ষেপে বিচারপতি সিনহা বেঁচে যান। গোটা আদালতপাড়া জানত তিনি দুর্নীতিবাজ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়। বিচারপতি সিনহা তো একটি সাংবিধানিক ক্যু করে ফেলেছিলেন প্রায়। বর্তমান সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে একটি রায়ও প্রস্তুত করে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ অনেক জল ঘোলা করে সিনহা ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পায়। আওয়ামী লীগ বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের আচরণে হতবাক হয়েছিল। লতিফুর রহমান, এম এ সাঈদ আওয়ামী লীগকে বিস্মিত করেছিল। বিচারপতি সিনহা আওয়ামী লীগকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সামনে এরকম কথিত ‘বিশ্বস্ত’ নীতিমানেরা আওয়ামী লীগের জন্য গোপনে ছুরি নিয়ে ঘুরছে। সুযোগ পেলেই মারবে। সেরকমই কি একটা বার্তা আওয়ামী লীগ পেল গাইবান্ধায়?

গত রবিবার বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম এক অনন্য, অসাধারণ, মহামূল্যবান কলাম লিখেছেন ‘আওয়ামী লীগ কি পারবে সব গুজব সামাল দিতে’ শিরোনামে। লেখার শুরুটাই ছিল এরকম- ‘আপনার পাশের মানুষটি কতটা ভয়াবহ একবারও কি ভেবেছেন।... ক্ষতি আপনজনরাই করে।’ গাইবান্ধার ঘটনার পর আওয়ামী লীগ নেতাদের বিপন্ন বিস্ময় দেখেশুনে বন্ধুবর নঈম নিজামের লেখাটি আবার পড়লাম। একটি লেখার বাস্তব উদাহরণ এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল। অনেকেই আমার সঙ্গে দ্বিমত হবেন। বলবেন, তাহলে কি আওয়ামী লীগ অনুগত আস্থাভাজন একজনকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে চেয়েছিল? যিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করবেন? ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। আওয়ামী লীগ কাজী হাবিবুল আউয়ালকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করেছিল নির্মোহ নিরপেক্ষতার প্রত্যাশা থেকে। কোনো চাপ, প্রলোভন, ভীতির কাছে তিনি নতিস্বীকার করবেন না সেই আশাবাদ থেকে। কিন্তু নতুন কমিশন আওয়ামীবিরোধী হয়ে নিজেকে শক্তিমান প্রমাণ করতে চাইছে। এখন দেখার বিষয় নির্বাচন কমিশন নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করার জন্য, পশ্চিমা দেশ, সুশীল এবং বিএনপির আস্থাভাজন ও প্রিয়পাত্র হতে আর কী কী চমক দেখায়। এদের আস্থা অর্জনের জন্য সিইসি আওয়ামী লীগের ওপর কতটা চড়াও হন। গাইবান্ধার উপনির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্যও একটা সতর্কবার্তা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগে একঝাঁক আবর্জনার আবির্ভাব ঘটে। যে-কোনো উপায়ে জয়ী হতে গিয়ে এরা নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের এক ভয়ংকর খেলা শুরু করে। এ সময়ের কয়েকটি উপনির্বাচন চমৎকার হয়েছে। কিছু স্থানে মনোনয়ন পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার খায়েশ বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক মনোনয়ন পান। মনোনয়ন পেয়েই তিনি সব প্রার্থীকে বসিয়ে দেওয়ার প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করেন। কোথাও কোথাও জোর করে ভোটজয়ের মানসিকতাও দেখা যায়। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মানেই যেন লটারি জেতা। মনোনয়নের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ার এক ব্যাধি আওয়ামী লীগে সংক্রমিত হয়েছে। এখান থেকে সরে আসাটা যে জরুরি সে বার্তা পাওয়া গেল গাইবান্ধায়। নির্বাচনে জিততে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে। এ চিন্তা কিছু নব্য আওয়ামী লীগার ভুলেই গিয়েছিল। গাইবান্ধা উপনির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তা। কিন্তু আওয়ামী লীগ যতই সতর্ক হোক, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে আগ্রহী হোক না কেন নির্বাচন কমিশন যদি চায় সব ভণ্ডুুল করে দেবে। সেটা যে খুব সহজেই তারা পারে গাইবান্ধা তার এক ছোট্ট উদাহরণ। সামনের নির্বাচন ও উপনির্বাচনগুলোয় কমিশন যদি গাইবান্ধার মতো একের পর এক ঘটনা ঘটায় তাহলে কে কী করবে? নির্বাচন কমিশনই যদি বলে, আসলে এ সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না। তখন তো সুশীলসমাজ আর পশ্চিমারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অনেক ঘটনা ঘটবে। তার ইঙ্গিত পাওয়া গেল গাইবান্ধায়। আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্য আরও অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে।

তবে গাইবান্ধার উপনির্বাচন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগের নৌকায় বিচিত্র সুবিধাবাদীরা ঠাঁই নিয়েছেন। এঁরা শেখ হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার হয়ে গেছেন। এঁদের কেউ কেউ যেন সরকারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে গেছেন। মাঝেমধ্যে মনে হয় এঁরাই সর্বেসর্বা। আমলাদের মধ্যে অনেকে এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো আচরণ করেন। পুলিশে অতি উৎসাহীরা অযথাই বিরোধী দলকে উসকে দেন। মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে জামানত হারিয়ে এখন সরকারের নীতিনির্ধারক হয়ে গেছেন এমন ব্যক্তিদের প্রভাব দেখে অনেকেই হতবাক। এঁদের ডিগবাজি যে সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ বার্তাটা গাইবান্ধার ভোট বন্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া গেল। দেশে সংকট বাড়ছে। বিদ্যুতের লোডশেডিং ভয়াবহ হচ্ছে। হঠাৎ বনে যাওয়া কেউকেটারা এখন সংকট সমাধানে দায়িত্ব নিচ্ছেন না। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার দায়িত্ব নিয়েছেন আমলারা। অর্থমন্ত্রীকে দেশে রেখে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বৈঠকে যাচ্ছেন আমলারা! সরকারের চারপাশে উড়ে এসে জুড়ে বসারাই খবরদারি করছেন। তাঁরাও কি সামনে ডিগবাজি দেবেন? এ প্রশ্নটা ক্রমে বড় হয়ে উঠছে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুঃসময়ে মার খাওয়া, জেল খাটা, নির্যাতিত- নিপীড়িত আদর্শবান তৃণমূল কর্মীরা ছাড়া দুঃসময়ে কেউই ‘মাই ম্যান’ থাকে না। সুসময়ের অতিথি পাখিরা দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের জন্য কেবল প্রতারণার চমক দিয়ে উধাও হয়ে যায়।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭