ইনসাইড থট

এ্যানীর জন্য হৃদয়গাঁথা


প্রকাশ: 15/10/2022


Thumbnail

শাহীন সুলতানা এ্যানী, অকৃত্রিম বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহপাঠী। দ্যুতিময় উজ্জ্বল জ্বলজ্বলে হরিণী চোখ। সদা হাস্যোজ্বল সুন্দরী। প্রাণবন্ত। মান অভিমান আবেগে টইটুম্বুর। রাগী আবার বিনম্র। কোমলে কঠিনে সহজ সরল প্রেমময় এক অপূর্ব নারী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপন চাচাত ভাই শেখ হাফিজুর রহমানের সহধর্মিণী, প্রধানমন্ত্রীর চাচি, পিরোজপুর সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি, শেখ এ্যানী রহমান বলে পরিচিত। গতকাল বাদ আসর বনানী কবরস্থানে সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে চিরশয্যায় শুইয়ে, কবরে একমুঠো মাটি ছড়িয়ে  দিয়ে একবুক পাহাড়চাপা কষ্ট নিয়ে ফিরেছি। 

এ্যানীর সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকে। আমি তখন ঢাকা কলেজে পড়ি। এ্যানী বদরুন্নেসা কলেজে। সরকারি কলেজের শিক্ষকরা তাঁদের দীর্ঘদিনের নানা যৌক্তক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী সরকারি কলেজসমুহে ধর্মঘটের ডাক দিলেন। কিন্তু জিয়া সরকার তাদের ধর্মঘটে কোনো কর্ণপাত করল না। আমাদের শিক্ষা জীবন ব্যাহত হওয়ায়, শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে, কলেজ খুলে দেয়ার দাবিতে, আমরা সরকারি কলেজের ছাত্ররা 'সরকারি কলেজ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে, শিক্ষকদের সমর্থনে রাজপথে নামি। সরকারি বদরুন্নেসা মহিলা কলেজে কমিটি করতে গিয়ে এ্যানীর সঙ্গে আমার পরিচয়। রাজপথের মিছিলে, বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচিতে একসঙ্গে কাজ করতে করতে গড়ে ওঠে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। 

আমরা দাবি আদায় করে ছাড়ি। সারাদেশে সরকারি কলেজ খুলে দেয়া হয়। সেই দাবি আদায় করতে গিয়ে আমরা কলেজসমুহে ছাত্র সংসদ নির্বাচনও আদায় করি। বদরুন্নেসা কলেজে নির্বাচনে এ্যানী মুজিববাদী ছাত্রলীগের পক্ষ নেয়। জানতে পারি, এ্যানীর বাবা এনায়েত হোসেন খান আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন। ফলে এ্যানীর আওয়ামী ছাত্রলীগের পক্ষ নেয়াই স্বাভাবিক ছিল। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিএনপির ছাত্রদলের জলি-মীরা এবং জাসদ ছাত্রলীগের শেলী-ইয়াসমিন পরিষদের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। সেসময় সারাদেশে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের জয়জয়কার। মুজিববাদী ছাত্রলীগের তেমন কোনো অবস্থান ছিল না। জাসদের জয় নিশ্চিত জেনে নির্বাচন শুরুর কিছু ক্ষণের মধ্যে ছাত্রদল জাসদ ছাত্রলীগের উপর হামলা চালায়। গোলাগুলি হয়। উভয় ছাত্র সংগঠন ভোটকেন্দ্র ছেড়ে চলে যায়। ফাঁক দিয়ে মুজিববাদী ছাত্রলীগ এককভাবে নির্বাচন করে। সামান্য ভোট কাস্টিংয়ে ওদের শিপ্রা-ফরিদা প্যানেল জিতে যায়। নির্বাচনে অনেক বাদপ্রতিবাদ, পাল্টাপাল্টি বক্তৃতা, সমালোচনার ঝড়, ঝগড়াঝাঁটি, মুখ কালাকালি হলেও এ্যানীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক, বন্ধুত্ব নষ্ট হয়নি। এ্যানী শুধু আমাকে বলত, কেনো আমি আওয়ামী লীগ করি না। আওয়ামী লীগে যোগ দিলে অনেক বড় নেতা হতে পারব। 

এ্যানী আমার এক ক্লাস জুনিয়র হলেও ঢাকা কলেজ নির্বাচনে আমি রিআ্যডমিশন নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমরা সহপাঠী হয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসঙ্গে অনেককিছু করায় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে যাই। একসঙ্গে ক্লাস করা, লাইব্রেরি ওয়ার্ক করা, টিএসসি, ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় একসঙ্গে খাওয়া, আড্ডা দেওয়া, ডিপার্টমেন্ট, হাকিম চত্বর, লাইব্রেরির সামনে, শামসুন্নাহার আর রোকেয়া হলের সামনে আড্ডা দেওয়া, বিকালবেলা দল বেঁধে শহীদ মিনার পর্যন্ত হাঁটা। এমনি কত স্মৃতি রয়েছে এ্যানীর সঙ্গে আমার। মনে পড়ে, আন্দোলনের কারণে একবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা হলে বাড়ি যাওয়ার সময় এ্যানী ঠিকানা দিয়ে, ওদের বাড়িতে বেড়াতে যেতে বলেছিল। পিরোজপুর একটি ছাত্র সভায় যোগ দিতে গিয়ে আমি এ্যানীদের বাড়ি গিয়েছিলাম। এ্যানী আর ওর বাড়ির সবাই ভীষণ খুশি হয়েছিল। অনেক আদর আ্যপায়ন করে দুপুরের খাবার খাইয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরও অনেকবার এ্যানীর বাসায় গিয়েছি, খেয়েছি, আড্ডা দিয়েছি। এ্যানী ভালো গান গাইতো, কখনো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শোনাত। এ্যানীর স্বামী কবি, লেখক, সংস্কৃতির সমঝদার, বন্ধুবৎসল, হৃদয়বান, পরোপকারী, অত্যন্ত রুচিবান মানুষ শেখ হাফিজুর রহমান টোকন ভাইও বড় আপন করে নিয়েছিলেন। ছেলে মেয়ে তান ও জয়িতার সঙ্গে আমার ছেলে মেয়েদের গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। টোকন ভাইয়ের হার্টের অসুখ হলে তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনারের পরামর্শে সাওল হার্ট সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ বিমল ছাজেড়কে দেখান। চিকিৎসা নেন, সাওল বাংলাদেশের ঢাকা শাখায়। বর্তমানে সাওলের উপদেষ্টা তিনি। 

মনে পড়ে, ১৯৮৩'র ১১ জানুয়ারির ছাত্র বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে ডিজিএফআই ১৩ তারিখ দুপুরে ইস্কাটন থেকে আমাকে চোখ হাত বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে আমি আর এ্যানী টিউটোরিয়াল পরীক্ষা দেয়ার জন্য একসঙ্গে লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলাম পড়তে। রফিক স্যার সেদিন পরীক্ষা না নেয়ায় আমি আমার নোটবুক এ্যানীর কাছে রেখে মিছিলে যাই। ১৩ তারিখ সকাল আমাদের একজন সহকর্মীর মাধ্যমে খবর পাই, সিরাজুল আলম খান (দাদা) আমাকে এবং সলিমুল্লাহ খানকে ডেকে পাঠিয়েছেন, এখনই যেতে বলেছেন। যদিও আমাদের সেক্রেটারি আবুল হাসিব খান একটু আগেই আমাকে সাবধান করে দিয়েছেন, মোহন, তুমি খবরদার ক্যাম্পাসের বাইরে যাবে না, আমার এক বন্ধু ডিজিএফআইয়ে আছে, সে আমার কাছে তোমার খোঁজ খবর নিয়েছে। তুমি ক্যাম্পাসের বাইরে গেলে কিন্তু তোমাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে।' আমি সে কথা পাত্তা না দিয়ে সলিমুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে ইস্কাটনে দাদার সঙ্গে মিটিং করে ফেরার সময় ডিজিএফআই আমাকে তুলে নিয়ে যায়। 

২১ দিন গুম থেকে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে সেই মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসার পর এ্যানী আমাকে ডিপার্টমেন্টে সেই নোটবুক ফেরত দিতে কেঁদে ফেলে। সেই নোটবুক হাতে নিয়ে দেখি এ্যানী তার মলাটের উপর লিখেছে, মোহন তুমি এভাবে কোথায় হারিয়ে গেলে? জানি না তোমাকে আর কোনোদিন ফিরে পাব কিনা, তোমার  সঙ্গে আর দেখা হবে কিনা? সে কথা ভাবতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় বাংলাদেশ।' লেখাটা পড়ে আমার চোখেও পানি এসে যায়। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, এ্যানী আমার কতখানি বন্ধু। কতটুকু ভালবাসে আমায়। আমাদের এই অকৃত্রিম, গভীর, নিখাদ, নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব আজীবন অটুট ছিল। 

দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এ্যানী থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি ছিল। মাঝে মাঝে টোকন ভাইকে কিম্বা তাঁকে না পেলে তাঁর পিএস মঞ্জুকে ফোন করে এ্যানীর স্বাস্থ্যের খবর নিতাম। আমার বিশ্বাস ছিল, এ্যানী সুস্থ হয়ে আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। এ্যানী ফিরে এলো কিন্তু নীরব নিথর নির্বাক হয়ে। বন্ধু, শেষ দেখা আর হলো না। হলো না কোনো বাক্য বিনিময়! হাজার জনতার ভিড়ে ব্যানারের ছবি হয়ে তুমি ঝুলে রইলে! 

বনানী কবর স্থানের মসজিদের গেটে সফেদ পাজামা পাঞ্জাবি পরে শোককাতর টোকন ভাই বসেছিলেন একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে। কাছে গিয়ে কাঁধে সান্ত্বনার হাত রাখতেই কেঁপে উঠলেন, অশ্রুসজল চোখে, বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বললেন, ভাই কেমন আছেন?' কোনো জবাব দিতে পারলাম না। চোখ গড়িয়ে একফোঁটা পানি ঝরে পড়ল, প্রিয় বন্ধুর শোকে। ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র আতিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে জানাজা শেষে মরহুমার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাবার প্যান্ডেল ও অন্যান্য আয়োজন করা হয়েছিল। স্পিকার শিরিন শারমিন এবং  আমির হোসেন আমু, ওবায়দুল কাদের, বাহাউদ্দীন নাসিম, মোহাম্মদ হানিফ, শেখ হেলাল, ফজলে নূর তাপসসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী কয়েক হাজার মানুষ দ্বিতীয় জানাজা ও দাফন কাজে উপস্থিত ছিলেন। স্পিকারসহ অন্যান্যরা মরদেহে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। 

বহুদিন পর দেখা হলো এ্যানীর ছোটবোন কানাডা প্রবাসী লনির সঙ্গে। ১৯৮১'র ডাকসু ইলেকশনে দলের উর্ধ্বে উঠে লনি, এ্যানী দুইবোন আমার জন্য সাহিত্য সম্পাদক পদে প্রকাশ্যে ভোট ক্যাম্পেইন করেছিল। দেখা মাত্রই লনি এগিয়ে এসে আমার হাত মুঠোবন্দি করে, বন্ধু হারালেন' বলে কেঁদে ফেলল। কেঁদে ফেললাম আমিও। কিছুক্ষণ দুজন দুজনের হাত ধরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভবের চেষ্টা করলাম। পরে ওর সঙ্গে কথা হলো। দেখা হয়েছিল, এ্যানী ও টোকন ভাইয়ের একমাত্র ছেলে তানের সঙ্গেও শোকার্ত, বিধ্বস্ত তান সালাম দিয়ে বলল, মামা কেমন আছেন?' এমন দুঃসময়ের মধ্যেও তানের বিনয় দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। শুধু মাথা নাড়লাম। 

সাদা কফিনে মোড়ানো, জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত এ্যানীকে যখন ধরাধরি করে কবরে নামানো হচ্ছিল তখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। কষ্টে বুক দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল ওর এই অকাল মৃত্যুতে। কত কথা মনে পড়ছিল। কত স্মৃতি! এ জীবনে আর তা বলা হবে না। এ্যানীর এক জীবন সন্ধিক্ষণে ওকে নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম- 

এই যে এ্যানী, একটুখানি থামো
সিঁড়ি থেকে একটু বেঁকে নামো
তোমার আমার দুখের জীবন ফেলে
চলো, যাই মিশে যাই সবহারাদের দলে.. 

সেই কবিতাটা ঘুরিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল-
এই যে এ্যানী, একটুখানি তাকাও
ঘুম থেকে একটু উঠে দাঁড়াও.. 

কিন্তু জানি, এ্যানী আর কোনোদিন তাকাবে না, উঠে দাঁড়াবে না, ওর ওই প্রাণবন্ত হাসিতে উদ্ভাসিত করবে না চতুর্দিক। জীবন এমনি অসমাপ্ত পান্ডুলিপির না বলা গল্পের দীর্ঘশ্বাস, অব্যক্ত যন্ত্রনার মহাকাব্য...


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭