প্রকাশ: 22/10/2022
চলতি মাসের শুরুর দিকে
বাংলাদেশের রাজধানীতে লোডশেডিং শুরু হলে চিন্তায় আসে সুরক্ষার কথা।
বছরের এই সময়টাতে ঢাকায় ডেঙ্গুবাহী মশার উৎপাত বেশি থাকে। বিদ্যুতের অভাবে কোনো ফ্যান
বা এয়ার কন্ডিশনার সচল না থাকায় মশারির ভেতরও অনেকে থাকতে পারেননি।
ডিজেলের ঘাটতিতে ব্যাকআপ জেনারেটর চালানো যাচ্ছিল না। এমনকি মোমবাতির দামও চারগুণ বেড়ে
গিয়েছিল।
গত
৪ অক্টোবর যে লোডশেডিংয়ে অন্ধকারে ডুবেছিল বাংলাদেশের
বেশিরভাগ জায়গাতেই। দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চার-পঞ্চমাংশই সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন
ছিলেন। এসময় কারখানাগুলো থমকে যায়। পাম্পগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেওয়ায় পানির অভাবে
পড়েন বাসিন্দারা।
বাংলাদেশে
সেদিনের গ্রিড বিপর্যয় ছিল ভূ-রাজনীতির কারণে বিদ্যুৎঘাটতির চরম লক্ষণ। গত এক দশকে
বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা
প্রচুর বাড়িয়েছে। কিন্তু এর বেশিরভাগই প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভর, যা চলে আমদানি করা জ্বালানি
দিয়ে।
ইউক্রেনে
রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে সম্প্রতি গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে। দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায়
ধনীরা বেশি দাম দেওয়ায় উপসাগরীয় গ্যাস উৎপাদনকারীরা ইউরোপে রপ্তানিতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
বাংলাদেশ
এখন যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছে, তাকে আসন্ন ঘটনাবলীর আগমনীবার্তা বলা যায়। আগামী
দশকে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি হবে এশিয়ার। বাড়বে জ্বালানির চাহিদা। আবার,
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এ অঞ্চলের দেশগুলো। আগামী দিনগুলোতে
বন্যা, খরা ও দাবদাহের ক্ষয়ক্ষতি কেবলই বাড়বে। একই সময়, জীবাশ্ম জ্বালানির প্রাপ্যতা
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ
অবস্থায় বিদ্যুতের নিশ্চয়তাসহ এশিয়ার ভবিষ্যৎ সাফল্য ও এর জনগণের মঙ্গল নির্ভর করছে
অঞ্চলটি দ্রুততম সময়ে সবুজ জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারবে কি না, তার ওপর।
এটি খুবই কঠিন চ্যালেঞ্জ।
২০৫০
সাল নাগাদ আসিয়ানের (দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট) ১০ সদস্যের জ্বালানি চাহিদা বেড়ে
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বর্তমান চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি হবে বলে ধারণা করা
হচ্ছে। ২০৪০ সালের মধ্যে শুধু ভারতের ইইউ’র এখনকার চাহিদার চেয়ে বেশি জ্বালানির প্রয়োজন
হবে।
স্বাভাবিকভাবেই,
এই অতিরিক্ত চাহিদার বেশিরভাগ পূরণ করা হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে। তবে এ অঞ্চলে
জীবাশ্ম জ্বালানির আধিপত্য থাকছেই। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে জ্বালানির
জগতে এখনো কয়লাই রাজা।
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের
পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কার্বন নির্গমনকারী ভারত। ২০৭০ সালের মধ্যে নির্গমনের হার
শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে দেশটি,যা বড় পশ্চিমা অর্থনীতিগুলোর
তুলনায় দুই দশক পেছনে। এশিয়ার কিছু দেশ এ বিষয়ে এখনো কোনো প্রতিশ্রুতিই দিতে পারেনি।
কার্বন
নিঃসরণ শূন্যে নামাতে কয়লার ব্যবহার কমানো জরুরি। যদিও আগামী কয়েক বছর এশিয়াজুড়ে
গ্রিডের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল রাখার প্রয়োজন
হবে। তবে নতুনগুলোর নির্মাণ অবশ্যই ধীর হতে হবে। এ জাতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ৯৫ শতাংশ
অর্থায়নকারী চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া সম্প্রতি বিদেশে অর্থায়ন বন্ধের প্রতিশ্রুতি
দিয়েছে।
পুরোনো
কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করতেও সহায়তার প্রয়োজন। ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম
দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজে লাগানো একটি মডেল অনুসরণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই মডেলে
ধনী দেশগুলো কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণ দেয়।
সবুজ
জ্বালানির নতুন উৎস হিসেবে আশা জাগাচ্ছে হাইড্রোজেন। এ থেকে বিপুল পরিমাণ পরিচ্ছন্ন
জ্বালানি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সেই প্রযুক্তি ও অবকাঠামো কোনোটাই ব্যাপক মাত্রায়
পরীক্ষিত নয়। ফলে হাইড্রোজেন জ্বালানির অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত এশিয়ার জ্বালানি
ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রধান মাধ্যম হতে পারে সৌর ও বায়ু শক্তি।
এশিয়ার
বেশিরভাগ নবায়নযোগ্য প্রকল্পগুলোর আকার ছোট। তবে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ
হতে পারে। দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্সের পূর্বাভাস বলছে, ২০৩১ সাল নাগাদ এশিয়ার বিদ্যুৎ
ব্যবস্থায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩১ শতাংশে দাঁড়াতে পারে।
ভারতের
গ্রিডে নতুন ২০০ গিগাওয়াট যোগ হয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ ২১ শতাংশে পৌঁছাবে। চীনে
এ ধরনের সক্ষমতায় ৭০০ গিগাওয়াট যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। চীনা পরিকল্পনা সংস্থার
প্রধান দাবি করেছেন, শুধু গোবি মরুভূমিতেই ৪৫০ গিগাওয়াটের একটি বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র
তৈরি করা হবে।
সবুজ
জ্বালানিতে রূপান্তর কার্যকর করতে পারমাণবিক বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। চীনে এটি আগে থেকেই
রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া- সবাই পরমাণু সক্ষমতা যোগ করছে। এছাড়া, এশিয়ার
সবুজ-জ্বালানি পণ্যের উৎপাদন সক্ষমতাও এতে সাহায্য করবে। চীনের পরে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম
ও দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের বৃহত্তম সোলার মডিউল প্রস্তুতকারক।
ব্যাটারি
তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিকেলের সবচেয়ে বড় উৎপাদক ইন্দোনেশিয়া। নিকেল প্রক্রিয়াকরণকে
আধুনিকীকরণ এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন স্থানের ব্যাটারি প্রস্তুতকারকদের বিনিয়োগে
উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি। আন্তর্জাতিক
জ্বালানি সংস্থার প্রধান অর্থনীতিবিদ টিম গোল্ড ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, একসময় কয়লার
চেয়ে নিকেল থেকেই বেশি আয় করবে ইন্দোনেশিয়া।
তবে
সব প্রকল্পই হয়তো বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে না। এশিয়া ইনভেস্টর গ্রুপ অন ক্লাইমেট
চেঞ্জের ধারণা, এশিয়াকে কার্বনমুক্ত করার জন্য ২০৫০ সালের মধ্যে ২৬ ট্রিলিয়ন থেকে
৩৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের দরকার হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রয়োজন
হবে ধনী দেশগুলোর অনুদান এবং ভর্তুকিও।
কার্বন
নিঃসরণ শূন্যে নামাতে ২০৩০ সালের মধ্যে একাই এক ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছে
ভারত। এটি ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আওতায় দরিদ্র দেশগুলোকে প্রতিশ্রুত বার্ষিক
সহায়তার ১০ গুণ। তবে ধনীদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত সহায়তার খুব সামান্যই হাতে পেয়েছে
দরিদ্ররা। ফলে, আগামী মাসে মিসরে যখন জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে,
তখন আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে অর্থছাড়ের বিষয়টি। আপাতত এশিয়ার নিম্ন-কার্বন ভবিষ্যৎ
নির্ভর করছে এই সম্মেলনের ফলাফলের ওপর।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭