শাকিব খানের পর এবার আইনি পদক্ষেপ নিলেন অভিনেতা ও প্রযোজক অনন্ত জলিল। বাংলাদেশ ও ইরানের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে অনন্ত-বর্ষার বহুল আলোচিত সিনেমা ‘দিন: দ্য ডে’। গেল কোরবানির ঈদে সিনেমাটি মুক্তির পর অনন্ত জলিলের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনেন ইরানি নির্মাতা মুর্তজা অতাশ জমজম।
পরবর্তীতে এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন অনন্ত জলিল। এতেও থামেননি ইরানি নির্মাতা। আর তাই এবার আইনি পদক্ষেপ নিলেন অনন্ত জলিল। মুর্তজা অতাশ জমজমকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন তিনি। এ অভিনেতা নিজেই খবরটি নিশ্চিত করেছেন।
শনিবার (২২ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে আইনি নোটিশের ছবি পোস্ট করে অনন্ত জলিল লিখেছেন, এই মিথ্যাচারের জন্য মুর্তজাকে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হতেই হবে এবং এর সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি দুষ্কৃতিকারীদেরও কিছুতেই ক্ষমা করা হবে না।
গত কোরবানি ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত আমাদের নতুন সিনেমা ‘দিন: দ্য ডে’ দিয়ে সিনেমাহলে দর্শক ফিরেছে, এটা সবাই অবগত আছেন। ঈদের পর ঢাকাই সিনেমার যে আলোচনা এবং সিনেমাহলে দর্শকের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল সেটাও ‘দিন: দ্য ডে’ সিনেমার বদৌলতে বলে আমি মনে করি। যার কারণে ঈদ এবং তৎপরবর্তী আরও কিছু সিনেমার প্রতি দর্শকরা আকৃষ্ট হয়েছেন। ঢাকাই সিনেমার এই আলোচনা ও বাজার তৈরি কারও কারও মনে হিংসার উদ্রেক ঘটিয়েছে। তারা চেষ্টা করছে কীভাবে ঢাকাই সিনেমার এই জোয়ার থামিয়ে দেয়া যায়।
সেসব দুস্কৃতিকারী, দেশবিরোধী চক্রের উস্কানি ও সহযোহিতায় এবং তাদের চক্রান্তে কিছু দিন আগে ‘দিন: দ্য ডে’ সিনেমার ইরানি পরিচালক মুর্তজা অতাশ জমজম ‘দিন: দ্য ডে’ সিনেমার নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রকাশ করেছে, যা দেশের কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এসব মিথ্যা, বানোয়াট তথ্যের বিপরীতে আমি আসল সত্য তুলে ধরে বিস্তারিত তথ্যও তখন জানিয়েছিলাম সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে। পাশপাশি মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রদান করে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করা, আমার সম্মানহানি করা, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে ছোট করে দেখা- এসব কারণে আমি আমার আইনজীবীর মাধ্যমে মুর্তজা অতাশ জমজমকে গত ০৪-০৯-২০২২ ইং তারিখে উকিল নোটিশ পাঠাই। তিনি অদ্যাবধি সেটার কোনো উত্তর দেননি।
আমি একজন সহনশীল মানুষ। সর্বোচ্চ ধৈর্য দেখিয়ে বিষয়টি নিয়ে তারপর থেকে আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু আজ আবার লক্ষ্য করলাম, মি. মর্তুজা আবারও সেসব দেশবিরোধী দুষ্কৃতিকারীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমার সম্মানহানি করার জন্য ভুয়া তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকায় মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট খবর প্রকাশ করেছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শিগগিরই তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করব। পাশাপাশি যারা দেশে বসে একজন বিদেশীকে দিয়ে এভাবে আমাদের সম্মানহানি করছে, দেশি সিনেমা, সর্বোপরি বাংলাদেশের ক্ষতি করছে, তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। আমি দেশি এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সবসময় শ্রদ্ধাশীল। সবার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
এর আগেও, ইরানি নির্মাতার অভিযোগ নিয়ে ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেজে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন অনন্ত জলিল। সেখানে তিনি পুরো বিষয়টির স্পষ্ট বর্ণনা করেছেন। তার সেই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা আমাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইছেন যে, কোরবানি ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত আমার সিনেমা ‘দিন: দ্য ডে’র পরিচালক ইরানি নাগরিক মুর্তজা অতাশ জমজম সিনেমাটি নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন। তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিস্তারিত বিষয় আমি এই পোস্টের মাধ্যমে তুলে ধরছি।
দিন: দ্য ডে’র শুটিং শুরু হয় ২০১৯ সালে ইরানে। শেষ হয় ২০২০ সালে। বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশে আমরা সিনেমাটির শুটিং করি। আমি শুরুতেই বলে এসেছি, এ সিনেমাটি প্রযোজনা করেছে ইরান। আমার সঙ্গে চুক্তি আছে যে, সিনেমাটির বাংলাদেশে যেসব কাজ হবে (শুটিং, ডাবিং) সেটার ব্যয়ভার আমি বহন করবো। আমি সেটাই করেছি। চুক্তি অনুযায়ী ইরানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে শুটিংয়ের খরচ বহন করবে ইরানি প্রযোজক।
ইরান যে সিনেমাটির মূল প্রযোজক সেটা পরিচালকই তার স্ট্যাটাসে দেওয়া একটি বাক্যের (আমি ছিলাম সিনেমাটির মূল প্রযোজক) মাধ্যমে স্বীকার করেছেন। এর মাধ্যমে একটা বিষয় পরিস্কার হয় যে, সিনেমাটিতে আমি শুধু বাংলাদেশের খরচ বহন করেছি এবং এটাই ছিল চুক্তি। ২০১৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশন চ্যানেল- সব জায়গাতেই সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্ন প্রচরণায় আমি বলেছি ‘দিন: দ্য ডে’ সিনেমার মূল প্রযোজক ইরানি। আমি শুধু বাংলাদেশের শুটিংকৃত অংশটুকুর খরচ বহন করেছি।
সিনেমার নামের ক্ষেত্রে আমি বাংলায় একটি নাম ব্যবহার করেছি। তাও ‘ডে’-এর বাংলা, অর্থাৎ ‘দিন’। ইরানি প্রযোজকের দেওয়া নামও (ডে) কিন্তু সিনেমায় রয়ে গেছে। এটাও আমাদের মৌখিক আলোচনায় ছিল। যেহেতু সিনেমাটি বাংলাদেশে মুক্তি দেওয়া হবে, তাই বাংলা নাম থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। আর আর্ন্তজাতিকভাবে মুক্তির জন্য সঙ্গে ইংরেজি নামও রয়েছে। সুতরাং নাম নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা অবান্তর।
তিনি (ইরানি নির্মাতা) যে গল্পের কথা বলেছেন, সেটা আমাদের দু’জনেরই আইডিয়া। সিনেমার গল্প আমি এবং মুর্তজা সাহেব দু’জনেই আলোচনা করে ঠিক করেছি। ইরানের শুটিং শুরুর পর ইরানি প্রযোজক আমাদেরকে সম্মানের সঙ্গে পাঁচতারকা হোটেলে রেখেছেন। আমরাও বাংলাদেশে শুটিংয়ের সময় ইরানি ইউনিটকে ঢাকার সোনারগাঁ হোটেলে রেখেছিলাম। সম্মান এবং আতিথিয়েতায় কোনো ঘাটতি রাখিনি। এ সিনেমার পরিচালক যেহেতু মুস্তফা অতাশ জমজম, তাই শুটিংয়ের যাবতীয় ইক্যুপমেন্ট, অর্থাৎ এইট-কে রেজুলেশনের ক্যামেরা তিনি ইরান থেকেই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
যেহেতু এইট-কে রেজুলেশনের ক্যামেরা বাংলাদেশে নেই। ইরানসহ অন্যান্য দেশের শুটিংয়ের ফুটেজ, এমন কী বাংলাদেশে শুটিংয়ের ফুটেজও তিনি শুটিং শেষে ইরান নিয়ে গেছেন, লাইনআপ করার জন্য। ২০২০ সালে শুটিং শেষে তিনি আমাকে এডিট করা একটা লাইনআপ পাঠালেন। আমি সেটা দেখে গল্পে বেশ কিছু জায়গায় অসামঞ্জস্যতা দেখে বলেছি, আমাকে একটা কপি দেন, আমি সেটা ঠিক করে দিচ্ছি। যেহেতু ইরান গিয়ে এডিটিং করা সম্ভব নয়, তাই আমি ঠিক করি ভারতের হায়দ্রাবাদের অন্নপূর্ণা স্টুডিওতে কাজটি করবো। সেই ফুটেজের কপি তিনি নিজেই সঙ্গে করে অন্নপূর্ণা স্টুডিওতে নিয়ে আসেন। আমাদের সঙ্গে ৪/৫ দিন হায়দ্রাবাদে অবস্থান করে তিনি নিজ দেশ ইরানে ফিরেও যান।
আমরা সিনেমাটিতে ডলবি সাউন্ড ব্যবহার করতে চাইলাম। যেহেতু ডলবি সাউন্ড ব্যবহার করলে তাদের (ডলবি কোম্পানীর) লাইসেন্স লাগে, আর ডলবি আমেরিকান কোম্পানী, ইরান সেটা ব্যবহার করতে পারবে না, তাই আমি বলেছি আমার দেশে (বাংলাদেশ) ডলবি সাউন্ড ব্যবহার করবো। বিষয়টিতে তিনি রাজি হয়েই স্বশরীরে ভারতের হায়দ্রাবাদের অন্নপূর্ণা স্টুডিওতে সিনেমাটির ফুটেজ নিয়ে আসেন। যদি কোনো অর্থ পাওনা থাকতো তাহলে তিনি কী ফুটেজ নিয়ে আসতেন? এছাড়া সিনেমাটির সম্পূর্ণ ফুটেজ এখনও তার কাছেই রয়ে গেছে যেহেতু তিনি সিনেমাটির মূল প্রযোজক এবং পরিচালক, তাই তার কাছে সেটা থাকাটাই স্বাভাবিক।
আমি একটা কথা স্পষ্ট বলতে চাই, চুক্তিতে যেভাবে যা কিছু উল্লেখ ছিল সে অনুযায়ীই আমি কাজ করেছি। যদি আমার কাছে তিনি ১০০ টাকাও অর্থাৎ কোনো অর্থ পাওনা থাকতেন তাহলে তিনি কী আমাকে সিনেমার সম্পূর্ণ ফুটেজ দিতেন? কিংবা ফুটেজ না পেলে আমি কী মুক্তি দিতে পারতাম? যেহেতু তার কাছেই শুটিংয়ের পর সম্পূর্ণ ফুটেজ ছিল এবং এখনও রয়েছে! নিশ্চয়ই তার অনুমতি এবং সম্পূর্ণ সম্মতিতেই আমি সিনেমাটি মুক্তি দিয়েছি। এখন তার অবান্তর অভিযোগ মূলত আমাকে ও আমার দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশকে ছোট করার অপপ্রয়াস বলে আমি মনে করি।
আরও একটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা যখন বাংলাদেশে হোটেল লি মেরিডিয়ানে এ সিনেমার গান ও প্রাথমিক ট্রেইলর উদ্বোধন করি তখনও তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং সিনেমাটি যে আমরা বাংলাদেশে মুক্তি দেব, সে ব্যাপারে কোনো আপত্তি জানাননি। আমি এটাও বলেছি যে, ইরান যদি সময়মতো মুক্তি দিতে না পারে তাহলে আমি বাংলাদেশে মুক্তি দেব। এসব নিয়েও তখন কোনো আপত্তি করেননি তিনি। ইরান সময়মতো মুক্তি দিতে পারছে না বলে, তিনবার আমরা মুক্তির তারিখ ঘোষণা দিয়েও সেটা পরিবর্তন করি। বাংলাদেশে মুক্তির সময় পরিবর্তনের কারণে আমার ইমেজ ক্ষুন্ন হচ্ছে জেনেও শুধু তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি সেটা মেনে নিয়েছি। শুরু থেকেই সবসময় আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল এবং সেটা এখনও আছে বলে আমি মনে করি।
আপনারা দেখেছেন, গত কোরবানি ঈদে ‘দিন: দ্য ডে’ মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা এবং সেটা দেশ থেকেই। আমি মনে করি, এটাও তেমনই একটি ষড়যন্ত্র। এরপরও মুর্তজা সাহেবের যদি কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে সেটা আমরা নিজেরাই বসে সমাধান করতে পারি (যদিও আমি চুক্তির বাইরে কিছু করিনি সেটা আগেই বলেছি)। তিনি বাংলাদেশি কারও পরামর্শে কিংবা নিজের প্রচারের স্বার্থে যদি ভুল এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে গণমাধ্যমকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন তাহলে সেটা হবে খুবই দুঃখজনক। যদি এ রকম কিছু ঘটে থাকে তাহলে আমিও দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনি ব্যবস্থা নেব। কারণ, একই চুক্তিপত্র আমার কাছেও রয়েছে।
আমি সাংবাদিক ভাই-বোনদের প্রতি অনুরোধ করবো, সত্যটা জেনে আপনারা খবর প্রকাশ করবেন। আমি চেষ্টা করবো আমার পেইজ থেকে বিস্তারিত তথ্য আপনাদের জানানোর জন্য। এমনিতেই আমাদের বাংলাদেশি সিনেমার দূর্দিন চলছে। এরমধ্যে গত ঈদে আমার ‘দিন: দ্য ডে’সহ আরও দুটি সিনেমা দেশের সিনেমা অঙ্গনে আশার আলো দেখিয়েছে। দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে ফিরছেন। দেশি সিনেমা অঙ্গন চাঙা হয়ে উঠছে। তাই একটি চক্র উঠে পড়ে লেগেছে কীভাবে বাংলাদেশের এই বাজারটি নষ্ট করা যায়। তারা আমাদেরই সিনেমার লোক বলে আমি মনে করি।
আমি সিনেমা নিয়ে বিশেষ কিছু কাজ করার পরিকল্পনা করছি। সেটা যাতে থামিয়ে দেয়া যায়, এমন কী ঈদের সিনেমার জোয়ার দেখে যারা নতুন করে প্রযোজনার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন তাদেরকেও দূরে সরিয়ে রাখা যায়, এ কারণে বিভিন্নভাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে ছোট করার জন্য অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একটি অসাধু চক্র। এই ঘটনা তারই একটা অংশ বলে আমি মনে করি। আমার যদি কোনো ভুল ত্রুটি থাকে সেটা ভবিষ্যতে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো। কিন্তু আপনাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে চাঙা করার জন্য, আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দেয়ার জন্য নেগেটিভ খবর প্রচার করা থেকে আপাতত বিরত থাকবেন। যাতে আমরা (বাংলাদেশি সিনেমা) আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি। আপনাদের ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের প্রতি আমাদের অগাধ শ্রদ্ধা আছে। সবসময় আপনারা আমার পাশে ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন, এটাই আশা করি। সবাইকে ধন্যবাদ।’’