শাঁখা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মহামূল্যবান। শাঁখা ছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে প্রায় অসম্ভব। এই শাঁখার সাথে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। আর এই ঐতিহ্য এখনো সুগৌরবে টিকে আছে ঢাকার বুকে,ইতিহাসকে সাক্ষী করে।
পুরান ঢাকা,নামটির সাথে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য,ইতিহাস এবং আভিজ্যাত্য। পুরান ঢাকার তেমনি একটি ঐতিহাসিক এলাকা হল শাঁখারিবাজার।শাঁখারিবাজার বুড়িগঙ্গা নদীর কাছে ইসলামপুর রোড ও নওয়াবপুর রোডের সংযোগ স্থলে অবস্থিত। মূলত এলাকায় বংশ পরমপরায় বসবাসকারী শাঁখা তৈরির কারিগড় শাখারিদের নামানুসারেই এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছিল শাঁখারিবাজার। শাঁখা, সিঁদুর থেকে শুরু করে পূজার যে কোনো সামগ্রী পাওয়া যায় এ বাজারে। একসময় ঢাকা বিখ্যাত ছিল শাঁখারিদের তৈরী শাঁখার জন্য, যা এখনও বহন করে চলেছে সেই ঐতিহ্য।
শাখারিদের ইতিহাস ঘাটতে গেলে জেমস ওয়াইজের বর্ননা সবার সামনে চলে আসে। তার তথ্য অনুসারে ৮৩৫ জন শাখারি বসবাস করতেন এই এলাকায়। প্রায় ৪ শ বছরের পুরনো এই এলাকায়, ধারণা করা হয় দেড় হাজার বছর আগে বল্লাল সেনের শাসনামলে শাঁখারি বাজারের পূর্ব পুরুষরা এসেছিলেন দক্ষিণ ভারত থেকে।
এই শাঁখা শিল্পটাও দক্ষিণ ভারতেই উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। শাঁখারিরা বাংলাদেশে প্রথমে বসতি গড়ে তোলেন ঢাকার বিক্রমপুরে। পরে সেখান থেকে ঢাকার বর্তমান শাঁখারি পট্টি অর্থাৎ শাঁখারি বাজারে শাঁখারিরা তাদের বসতি গড়ে তোলেন। এরপর থেকে প্রয়োজনের তাগিদে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাঁখারিদের বিস্তৃতি ঘটে।
শাঁখা হচ্ছে শঙ্খ দিয়ে তৈরি এক ধরনের সাদা অলঙ্কার। ভালো আকৃতির একটি শঙ্খ থেকে মাঝারি ধরনের সর্বোচ্চ ৪টি এবং সরু ধরনের ১০টি শাঁখা পাওয়া যায়। শাঁখা কেটে বের করার পর সেগুলোর ভেতর ও বাইরের দিক মসৃণ করে তাতে বিভিন্ন নকশা তোলা হয়।শাখারি বাজারের শাখার নকশাতে ফুল, লতা, ধানের শীষ, মাছ, পাখি ইত্যাদির মোটিফ বেশি দেখা যায়। আর এসকল শাঁখাগুলো ল তৈরি করতে শিল্পীকে মোট ১২টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।
বাংলাদেশের অন্যান্য সব ঐতিহাসিক পেশার মত এই শাখা শিল্পও এখন ধুকে ধুকে টিকে রয়েছে। বংশ পরম্পরায় পরিচালিত এই পেশার মানুষও এখন আগ্রহ হারিয়ে অন্যান্য পেশা বেছে নিয়েছেন।বাংলাদেশ সরকার শাঁখারিবাজার এলাকাকে হেরিটেজ এলাকা হিসেবে ঘোষণার পরে তা সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে হস্তান্তর করেন।
শাঁখারিবাজারকে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২০০৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ২০ কোটি টাকায় একটি প্রকল্প চালু হয়েছিল। এর আওতায় শাঁখারিবাজারের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর সংস্কার এবং পয়ঃনিষ্কাশনসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা ছিল। সরকারের সুনির্দিষ্ট সু-নজর এবং প্রশাসনিক সাহায্য এই পেশাটিকি নিয়ে যেতে পারে বিশ্ব দরবারে। আর তার সাথে সাথে পুরান ঢাকার এই ঐতিহাসিক পেশা টিকে যেতে পারে তার আপন ঐতিহ্য এবং ইতিহাস নিয়ে।