ইনসাইড থট

৩রা নভেম্বর বাংলাদেশকে হত্যার চেষ্টা


প্রকাশ: 03/11/2022


Thumbnail

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের ১৭ জন সদস্যকে হত্যার ঘটনাটি অনেকের কাছে মনে হতে পারে শ্রেফ একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড আর যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা নিছক ক্ষমতার পালাবদলের জন্য ঘটিয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলের জন্য হত্যার ঘটনা রাজনীতিতে অনেক আছে, যেমন চিলির সালভাদর আলেন্দে হত্যা, ইরাকের বাদশাহ ফারুককে হত্যা, বার্মার অং সান সু চির পিতা অং সানকে হত্যা, মিসরের আনোয়ার সাদাতকে হত্যা। এসব হত্যা প্রচেষ্টায় অনেক সময় ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে আবার অনেক সময় হয়ওনি। বাংলাদেশে ১৫ই আগস্টের হত্যার একটা উদ্দেশ্য ক্ষমতার পালাবদল ছিল বটে, তবে তারচেয়েও বড় উদ্দেশ্য ছিল বাংলা নামের দেশটিকে চিরতরে শেষ করে দেয়া।

এটি মনে রাখতে হবে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যত ভোট পড়েছিল তার ৭৫ শতাংশ পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ২৫ শতাংশ ভোটার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে; জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপি প্রভৃতি আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টিকে ভোট দিয়েছিল। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা, যার অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতা। নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে এটি বোঝা যায়, যারা বাংলার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেছিলেন তারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলেন আর যারা করেননি তারা অন্য দল বা অন্য মার্কা বেছে নিয়েছিলেন। এর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম তো থাকবেই।

১৯৪৭ সালের পর থেকেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র কখনো চায়নি এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, যেখানে পাকিস্তানের সব প্রদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাগ্য প্রদেশগুলো নিজেদের মতো করে নির্ধারণ করতে পারে। যদি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিরঙ্কুশ করা যেত, তাহলে এসব সমস্যার কিছুটা সমাধান হতো। তারা সব সময় চেয়েছে সব প্রদেশের ওপর পাঞ্জাবিদের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা চালু থাকুক। শাসকদের দৃষ্টিতে পাঞ্জাবিরা হচ্ছে পাকিস্তানের একমাত্র এলিট শ্রেণি আর বাকিরা তাদের প্রজা। এলিটরা প্রজাদের ওপর ছড়ি ঘোরাবে, তাইতো হওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যা ছিল আগের বাঙালিদের নিয়ে। একে তো তারা পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আর অন্যদিকে শিক্ষা-দীক্ষায় তারা অনেক অগ্রসর ছিল। এ কারণে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা সেই ১৯৪৭ সাল থেকে নিজেদের ভাগ্য নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারের জন্য নিরন্তর লড়াই করেছে। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের মানুষ তেমন একটা রাজনীতি সচেতন ছিল না, এমনকি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা ছিল অনুল্লেখ্য। আর পাঞ্জাবের মুসলমানরা তো ব্রিটিশদের খেদমত করতেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। দেশভাগের পর পাঞ্জাবে যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়, তা ছিল অনেকটা লুটপাট ও জায়গা জমি দখলের জন্য। শুরুতে পাকিস্তানের অর্থনীতিও বহুলাংশে পূর্ব বাংলার পাট ও চা রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। পাকিস্তানের প্রথম ২৩ বছর বাঙালিরা নিজেদের ন্যায়সংগত দাবি আদায়ের জন্য লড়াই করেছে, বাঙালি রাজনৈতিক নেতারা জেল খেটেছেন, যাদের মধ্যে মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, মোজাফফর আহমদ অন্যতম।

বাঙালি সব সময় শান্তিপূর্ণভাবে নিজের অধিকার আদায় করতে চেয়েছে; কিন্তু তারপরও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রোষানলে পড়ে তারা নিগৃহীত হয়েছে। এর প্রেক্ষাপটেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যারা সত্তরের নির্বাচনে নৌকাকে ভোট দেননি, তাদেরও অনেকেই এই যুদ্ধে গেছেন, রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন। আর অন্যদিকে যারা সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, নৌকার সমর্থন করেছেন, তাদের অনেকেই যুদ্ধ শুরু হলে তার বিরোধিতা করেছেন, শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন আর বাংলাদেশ যাতে স্বাধীন না হয় তার জন্য ষড়যন্ত্র করেছেন। তাদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী, সংসদ সদস্য কাজী জহিরুল কাইয়ূম অন্যতম। অন্যদিকে দেশের ভেতর যারা কট্টর বামপন্থী, সহজ ভাষায় যাদের পিকিংপন্থী বাম বলা হয়, তারাও ছিলেন। তাদের দৃশ্যমান গুরু ছিলেন ন্যাপের মাওলানা ভাসানী; কিন্তু তাদের সব নির্দেশনা আসত চীনের কমিউনিস্ট পার্টি থেকে। চীন তখন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অন্যদিকে মাওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সভাপতি হয়েছিলেন। প্রবাসী সরকারকে প্রত্যহ এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে। আর এই কাজ অত্যন্ত  বিচক্ষণতার সঙ্গে করেছিলেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ।

শত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো বটে; কিন্তু যারা দেশের বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক ষড়যন্ত্র করেছেন তারা বসে থাকবেন কেন? একদিকে একটি নতুন দেশের কঠিন যাত্রা। ভরসা একজনের ওপরই, যার নির্দেশে এই দেশের কোটি মানুষ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তার সামনে কঠিন সব চ্যালেঞ্জ, যার অন্যতম হচ্ছে দুর্নীতি। একদিকে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করছেন, অন্যদিকে দেশ গড়ার কাজে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। আর এসবের মাঝে ষড়যন্ত্রকারীরা দ্বিগুণ উৎসাহে পরিশ্রম করেছে তাদের আগের ভেস্তে যাওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে। যেহেতু বাংলাদেশ এরইমধ্যে স্বাধীন হয়ে গেছে, সেহেতু বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানো সম্ভব নয়। সুতরাং যে মানুষটি বাংলাদেশের সমর্থক হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে, সেই বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দিতে পারলেই কিছুটা হলেও বাংলাদেশের মৃত্যু ঘটবে বলে তারা ধারণা করে নিয়েছিল। কিন্তু যেভাবে বঙ্গবন্ধু একটির পর একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন আর দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন, তাকে সরানো ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাদের এই কাজে সহায়তা করতে এগিয়ে এলো তৎকালীন মার্কিন সরকার, তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আর পাকিস্তান সরকার ও তাদের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৫ই আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হলো জাতির জনককে।

নির্বোধরা উপলব্ধি করেনি একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করলেই একটি দেশ বা একটি জাতিকে হত্যা করা যায় না, বিশেষ করে সেই দেশ বা জাতি যদি মানুষের অন্তরে গেঁথে থাকে। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরপরই দেশব্যাপী তার রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করল। গ্রেফতার হলেন প্রবাসী সরকারে নেতৃত্ব দানকারী নেতারা। স্বাভাবিকভাবেই বাদ পড়লেন প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ষড়যন্ত্রকারীদের মূল হোতা খন্দকার মোশতাক ও তার দোসররা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরপরই তিনি নিজেকে দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করলেন। যদিও এই সময় সংবিধান অনুযায়ী উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার কথা । সংসদও তখন বহাল ছিল। বহাল ছিল সংবিধান । পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যখন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের রক্তাক্ত লাশ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির সিঁড়িতে তখন খন্দকার মোশতাক দেশে সামরিক আইন জারি করেন। ওই রাতে শপথ গ্রহণ করে ২১ সদস্যের একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন, যার মধ্যে ১০ জন ছিলেন মন্ত্রী আর ১১ জন প্রতিমন্ত্রী। তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া সবাই বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর উপরাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মাহমুদউল্লাহকে মোশতাক তার উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে পুনর্বহাল করেন। তবে মোশতাকের মন্ত্রিসভার সবচেয়ে অবাক করা অন্তর্ভুক্তি ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী, যাকে বঙ্গবন্ধু রাতারাতি কর্নেল থেকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়েছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাসচিব ও ভারতে বাংলাদেশের প্রথম হাই কমিশনার এবং দেশের দ্বিতীয় অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিক, আর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ঢাকা হাইকোর্টের এক সময়ের প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে। এই তিনজন ব্যক্তিকে বঙ্গবন্ধু সব সময় স্যার বলে সম্বোধন করতেন। শিক্ষকদের কিভাবে সম্মান করতে হয় তা বঙ্গবন্ধু ঠিকই জানতেন, যেমনটি জানেন তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তারা আরো অনেকের মতো জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। মোশতাকের দুর্ভাগ্য, তিনি বঙ্গবন্ধু বিহীন যে বাংলাদেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা হবেন বলে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ ৬ নভেম্বর তাকে বুটের লাথির আঘাতে ফেলে দিয়ে এসব ষড়যন্ত্রের অন্যতম খেলোয়াড় ও বেনিফিশিয়ারি জেনারেল জিয়া নিজে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এই দেশে যতগুলো নারকীয় হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার সবগুলোই হয়েছে জিয়া আর তার স্ত্রী বেগম জিয়ার শাসনামলে। এর মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক ছিল ১৯৭৭ সালে বিমান বাহিনীতে সংগঠিত এক বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে হাজারের উপর সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যকে গণফাঁসিতে ঝুলিয়ে অনেকটা বিনা বিচারে হত্যা করা যাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ।

১৫ই আগস্টের ঘাতকরা টের পেয়েছিল একজন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলে বাংলাদেশের মৃত্যু হবে না। বাংলা নামের দেশটির জন্মদাতাদের মধ্যে আরো তো অনেকেই ছিলেন, যাদের মধ্যে আছে এক অনন্য উচ্চতার দেশপ্রেম আর মানুষের ভালোবাসা। একবার মোশতাক চেষ্টা করেছিলেন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মনসুর আলী জানতে চেয়েছিলেন কোন ক্ষমতাবলে মোশতাক তাকে এই অফার দিচ্ছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে! মুখের ওপর মনসুর আলীর উত্তর ‘ইউ আর নট মাই প্রেসিডেন্ট’, আপনি আমার প্রেসিডেন্ট নন। ফিরে গেলেন মনসুর আলী কেন্দ্রীয় কারাগারে। সুযোগ পেলে আবার তাদের হাতেই জন্ম নেবে বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। মোশতাক আর ঘাতকরা সবাই বুঝে গেছে, তাদের সার্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ায়ন করতে হলে তাদের সবাইকেই সরাতে হবে। কিন্তু তাদের সবাই তো কারাগারে। আর কারাগার হচ্ছে সবার জন্য একটি স্বীকৃত নিরাপদ স্থান। কারাগারে অস্ত্র নিয়ে ঢোকার রেওয়াজ নেই। তাহলে কিভাবে জাতির জনকের এসব সিপাহসালারকে পৃথিবী থেকে সরানো যায়? আবার শলাপরামর্শ, আবার ষড়যন্ত্র। একমাত্র রাষ্ট্রপতিই পারেন কারাগারে ঘাতকদের অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ অনুমোদন করতে। মোশতাকের সঙ্গে কথা বলে ৩ নভেম্বর ঘাতকরা রওনা হলেন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। প্রাপ্ত সূত্র মতে, নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন মুসলেম উদ্দিন। তখনো ভোর হতে কিছু সময় বাকি। কারা ফটকে এসে কারারক্ষীকে হুকুম দিলেন কারাগারের দরজা খুলতে। দায়িত্ব সচেতন কারারক্ষী সাফ জানিয়ে দিলেন রাতের বেলায় কাউকে কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেয়ার নিয়ম নেই আর অস্ত্র হাতে তো নয়ই। কিছু সময় বাকবিতণ্ডা চললো। অনড় কারারক্ষী। ঘাতকরা বলেন, বঙ্গভবনে ফোন করে রাষ্ট্রপতির আদেশ নিতে। অনন্যোপায় হয়ে কারারক্ষী ফোন করেন বঙ্গভবনে। ফোন রিসিভ করেন মেজর আবদুর রশিদ। তার হাত ঘুরে ফোন যায় মোশতাকের হাতে। মোশতাক হুকুম দেন, ‘ওরা যা করতে চায় করতে দাও।’ এই হুকুম দেয়ার জন্য মোশতাক আর তার পোষা দুর্বৃত্তরা অত রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন।

মোশতাকের নির্দেশ পেয়ে কারারক্ষী কারা ফটক খুলতে বাধ্য হন। ভেতরে প্রবেশ করেন মুসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে কালো ড্রেস পরা এক দল ঘাতক। জাতীয় চার নেতাকে বিভিন্ন সেল থেকে এনে জড়ো করা হয় ১ নম্বর সেলে। তারপর ব্রাশফায়ার। বেজে ওঠে কারাগারের পাগলা ঘণ্টা। জেগে ওঠেন নাজিমউদ্দিন রোডের আশপাশের বাড়ির বেশির ভাগ মানুষ আর কারাগারের ভেতরের কয়েদিরা। ততক্ষণে সব শেষ। বঙ্গবন্ধুর চারজন সেনাপতি তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর কামরুজ্জামানের পবিত্র আত্মা উড়ে যায় আকাশের দিকে। ইতিহাসের অনেক হত্যাকাণ্ড আর রক্তাক্ত অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে রইল বিশ্ব। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হত্যাকাণ্ড ছিল নজিরবিহীন। আর এসব ঘাতককে পরবর্তীকালে নানা ভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী বেগম জিয়া । 

৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করার জন্য বিচারপতি কে এম সোবহানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল। জিয়া ক্ষমতা দখলের কিছুদিন পর সেই কমিশন বাতিল করে দেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়েছিল ঢাকার মেট্রোপলিটন আদালতে। দীর্ঘ আট বছর শুনানির পর ২০০৪ সালে আদালত তার রায় দেন। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায়। রায়ে অভিযুক্ত ২০ জন সেনা সদস্যের মধ্যে ১৫ জনকে শাস্তি দেয়া হয়, যার মধ্যে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড (তারা সবাই তখন পলাতক) আর ১২ জনের যাবজ্জীবন। উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ফলাফল হয় উল্টো। শুধু সার্জেন্ট মুসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। জেলে ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনো নিরবে কাঁদছে । 

দণ্ডপ্রাপ্তদের অনেকেই এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন অথবা পলাতক। বলা বাহুল্য, এই রায়ে চার জাতীয় নেতার পরিবার তো বটেই, দেশের সাধারণ মানুষও খুশি হতে পারেনি।

ঘাতকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে জন্ম লাভকারী বাংলাদেশের মৃত্যু হয়েছিল ঠিক, তবে সেই মৃত বাংলাদেশের পুনর্জন্ম হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তবিধৌত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের পুনরুত্থান শুরু হয় ১৯৯৬ সালে, যখন বঙ্গবন্ধু কন্যা নির্বাচনে বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করেন। আবার ছন্দঃপতন হয় ২০০১ সালে, যখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা আবার সরকার গঠন করে তার পিতার ও জাতীয় চার নেতার প্রত্যাশিত পথে আবার ফিরে আসার চেষ্টা করছেন, যদিও নানা কারণে এবার তার পথচলা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কঠিন। কারণ এখন নিজ দলে অনেক ছোট-বড় খন্দকার মোশতাকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তিনি হাত দিয়েছেন দল থেকে সেসব জঞ্জাল অপসারণে। তবে যা যথেষ্ট নয় বলে আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষিরা ও বঙ্গবন্ধুর অনুসারিরা মনে করেন । জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের  এই দিনে প্রার্থনা করি যেন তার হাত দেয়া কাজে তিনি সফল হন। তার হাতেই বেঁচে থাকুক বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার পিতা আর জাতীয় চার নেতা। বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার ও জাতীয় চার নেতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও আত্মার শান্তি কামনা করছি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭