ক্লাব ইনসাইড

জাবিতে প্রকাশ্যে নিয়মভঙ্গ, দেখার নেই কেউ


প্রকাশ: 03/11/2022


Thumbnail

গত ২৫ আগস্ট (মঙ্গলবার) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের সামনের সড়কটি বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে এক প্রেসবার্তা দেন কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোঃ মোজাম্মেল হক। এর প্রেক্ষিতে গত ২৮ আগস্ট সকাল ১০টায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বন্ধ করে দেয়া হয় সড়কটি।

এরপর প্রায় দু মাস অতিবাহিত হলেও টনক নড়েনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। প্রায় সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর দাবি সত্ত্বেও সড়কটি পুনরুদ্ধারে দৃশ্যমান কোনো নজরদারি কিংবা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি ক্যাম্পাসের উপরমহলকে।

সরেজমিনে জানা যায়, প্রথমে গাছের গুড়ি ফেলে এবং পরবর্তীতে (৩১ আগস্ট) ইট সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে, লোহার পাতের তৈরী গেট ও স্টিলের পাইপ বসিয়ে উভয় দিকে ব্যারিকেড তৈরীর মাধ্যমে ক্যাম্পাসের মূল এই রাস্তাটিকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় কলা ও মানবিকী অনুষদ কর্তৃপক্ষ। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীসহ অন্যান্যরা।

জানা গিয়েছে, সড়ক বন্ধ করে দেয়ার প্রথম দিন (২৮ আগস্ট) রাতে পর্যাপ্ত আলো ও নিরাপত্তা সংকেত না থাকায় একাধিক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে, বাইক দূর্ঘটনায় মারাত্মক আহত দুই শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও, ক্যাম্পাসের প্রাক্তন-বর্তমান অসংখ্য শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাস্তা বন্ধের বিষয়টিকে অপরিকল্পিত ও অবিবেচকের মত কাজ হিসেবে উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ ও তীব্র সমালোচনা করেছেন।

দৃশ্যমান অবস্থা এই যে, নতুন কলা ভবনের সম্মুখ রাস্তাটি বন্ধ করে দেয়ার দরুণ শহীদ মিনার ঘুরে অপর পাশের সরু ও ভাঙা রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে সকলকে। অনেকটা রাস্তা ঘুরে যাওয়ায় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত রিকশা ভাড়াও। এ নিয়ে বিপাকে পড়ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

বিকল্প এই রাস্তায় মানুষের যাতায়াত বেড়ে যাওয়ায় রাস্তা ঘেঁষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি চত্বরে তৈরী হয়েছে অনেকগুলো অস্থায়ী দোকানের। যার ফলে সেখানে বেড়েছে মানুষের সমাগম। ফলস্বরূপ, শহীদ মিনারের অপর পাশের রাস্তাটিতে সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। এছাড়াও, রাস্তাটিতে সড়ক বাতি না থাকায় রাতের বেলা পর্যাপ্ত আলোকস্বল্পতায় যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দূর্ঘটনা। গুরুতর আহত হতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীসহ পথচারীরা।

উল্লেখ্য, রাস্তা বন্ধ করার বিষয়ে জারিকৃত বিবৃতিতে বলা হয়েছিলো, রাস্তাটি ভবনের খুব কাছে হওয়ায় ক্লাস-পরীক্ষা চলাকালীন যানবাহনের বিকট শব্দে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। একই সাথে, ভবনের সামনে কোন জায়গা না থাকায় রিকশা ও অটোরিকশাগুলো এখানে জড়ো হয়। সে কারণে রাস্তা পার হতেও শিক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হয়। তাই শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করেই রাস্তাটি বন্ধ করা হয়েছে।

তবে, পূর্বোক্ত এই বিবৃতির সাথে একমত নন অধিকাংশ প্রত্যক্ষদর্শী ও ভূক্তভোগীই। স্থায়ীভাবে রাস্তা বন্ধ না করে, বরং স্লাইড গেট সিস্টেম ব্যবহার করে শুধু ক্লাসের সময়ে রাস্তা বন্ধ রেখে, বাকি সময় রাস্তা খোলা রাখার ব্যবস্থা করলে বিষয়টি ভালো হতো বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। এতে যেমন একাডেমিক কাজে সুবিধা হতো, তেমনি সাধারণের চলাচলের ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি হত না বলে মনে করছেন তারা।

সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অনেকটাই যেনো দায় এড়িয়ে যেতে চান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ নূরুল আলম। দায়হীনভাবে বাংলা ইনসাইডারকে তিনি জানান, “তারা প্রশাসনের সাথে কোনো আলোচনা না করেই সড়কে স্থায়ী ব্যারিকেড দিয়েছে। তারা যেহেতু নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা বন্ধ করেছে এটার সমাধান তারাই করুক।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোঃ মোজাম্মেল হক বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, “আমাদের কাছে রাস্তা বন্ধ ব্যতীত কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিলো না। প্রশাসন এটা ভেঙ্গে বিকল্প ব্যবস্থা করে দিক। বাস্তবতা এই যে, আমরা তো আসলে রাস্তা বন্ধ করছি না। বরং, আমরা বাঁচতে পারছি না, আমরা বাঁচতে চাই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে বহুকাল মৌখিক ভাবে আমাদের সমস্যার কথা বলে এসেছি, বহু চিঠিও দিয়েছি। কিন্তু যখন এটার সমাধান হয় নাই, পুরো ফ্যাকাল্টির সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা মিলে এটা করেছি।”

এ ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এই প্রতিবেদককে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংযোগ সড়কটি একটি প্রাইমারি রোড। যেটা কোনোভাবেই প্রশাসনের অনুমতি ব্যতীত বন্ধ করা যায় না। সড়কটি বন্ধ করায় স্বাভাবিকভাবেই  বিশ্ববিদ্যালয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে। সড়কের সন্নিকটে কোনো একাডেমিক ভবন থাকলে এর পরিবেশ একটা পর্যায়ে বিঘ্নিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, তাই বলে কোনো অনুষদ নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে থাকলে বৃহত্তর অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। সমস্যা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সাথে আলেচনা করে সমাধান করা উচিত। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে সিদ্ধান্ত নিতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি  হতে  থাকবে।”

সমস্যা সমাধানের উপায় বাতলে দিয়ে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরহাদুর রেজা বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, “নতুন কলা ভবন তৈরীতে মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ করা হয়নি। মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে নতুন কলা ভবন এখানে হওয়ার কথা ছিল না। শ্রেনীকক্ষ যাতে শব্দ দূষণমুক্ত থাকে এবং একাডেমিক পরিবেশ বজায় থাকে, সেটা ভবন তৈরীর আগেই সংশ্লিষ্টদের বিবেচনা  করা দরকার ছিল। রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে সমস্যার সমাধান কোনো দৃষ্টকোণ থেকেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। এক্ষেত্রে শব্দ দূষণ এবং ধুলোবালি রোধ করতে পারে, এমন ট্রি বেরিয়ার দেয়া যেতে পারে। ক্লাসরুমের ডিজাইনে চেঞ্জ এনে নয়েজ প্রুফ ও মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এখানে মূল সমস্যা হলো, মাস্টারপ্ল্যানের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া এবং যথাস্থানে ভবন নির্মাণ না করা।”

জানতে চাইলে, ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সভাপতি ইমতিয়াজ অর্ণব বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যস্ততম রাস্তা বন্ধ করে দেয়া যেমন বিবেচনাপ্রসূত কাজ নয়, তেমনই যানবাহনের তীব্র চাপে জাহাঙ্গীরনগরে শব্দদূষণ ও নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাফিক বিষয়ে প্রশাসনের উদাসীনতাও একইভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। নতুন কলা ভবনের অপরিকল্পিত অবস্থানের কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পঠন-পাঠনে মনোনিবেশ না পারাটা প্রশাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। মাস্টারপ্ল্যানহীন উন্নয়ন কেমন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে এই ক্যাম্পাসে, এটি একটি উদাহরণ মাত্র। এভাবে  শিক্ষার্থীদের মতামত ব্যতীত কোনো কাঠামোগত উন্নয়ন বা পরিবর্তনই শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর হবে না। ফাংশনিং বডির এহেন বিচ্ছিন্নবাদীতা চলতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়  প্রশাসন তার স্বকীয়তা হারাবে, বিভাগগুলো হয়ে উঠবে স্বেচ্ছাচারী। আর এসকল সমন্বয়হীনতা আর অপপরিকল্পিত উন্নয়নের ভিকটিম হবে শিক্ষার্থীরা।”

প্রসঙ্গত, কলা ও মানবিকী অনুষদের চারতলা বিশিষ্ট নতুন এই ভবনে বর্তমানে সাতটি বিভাগের ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। ভবনটির নীচ তলার শ্রেণীকক্ষগুলো ব্যতীত বাকি শ্রেণীকক্ষগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সেখানে শব্দ দূষণের সমস্যা নেই বলে মতামত অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭