ইনসাইড এডুকেশন

প্রশ্নপত্রে উস্কানি, ভুল না ইচ্ছাকৃত?


প্রকাশ: 10/11/2022


Thumbnail

শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠু না হলে তা দেশের সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক। গত শনিবার থেকে শুরু হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। কয়েক বছরের মতো এবারও প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আলোচনা ছিল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছিল। পরীক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে প্রশ্ন ফাঁসের কোনো খবর আসেনি।

প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ না থাকলেও এসেছে নানা আপত্তি। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুল বা উস্কানিমূলক উদ্দীপক নতুন নয়। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা, স্কুল-কলেজের পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষায় ভুল হওয়া কিংবা উস্কানিমূলক প্রশ্নের নজির আছে এবং তা নিয়ে নানা সমালোচনা দেখা দেয়। চলতি এইচএসসি পরীক্ষার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষায় ধর্মীয় উস্কানির অভিযোগ ওঠে। কিছু কেন্দ্রে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে ভুল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টিও উঠে এসেছে।  

গত সোমার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্ন নিয়ে দেশজুড়ে রীতিমতো সমালোচনার ঝড় ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল ও ভুয়া প্রশ্ন নিয়েও বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়। এই প্রশ্নের ও উদ্দীপক নিয়ে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদ ওঠে। 

এর মধেই আবার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্রে লেখক ও সাংবাদিক আনিসুল হককে হেয় করার অভিযোগ উঠেছে। এক সৃজনশীল প্রশ্নের উদ্দীপকে লেখক আনিসুল হকের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘২১শে বইমেলায় তারাহুড়ো করে তিনি বই প্রকাশ করেন। পাঠকদের কাছে তার লেখা খাপছাড়া মনে হয়। ফলে পাঠকদের কাছে তিনি সমাদৃত হন না।’ প্রশ্নপত্রের ১ নম্বর প্রশ্নে সরাসরি ব্যাক্তিগত আক্রমণ করা হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানিয়েছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। 

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খান বলেছেন, এ প্রশ্নপত্র তৈরিতে যুক্ত শিক্ষককে খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির প্রধান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেছেন, এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বলেছেন।

এদিকে, চট্টগ্রাম বোর্ডের কয়েকটি কেন্দ্রে ২০১৮ সালের সিলেবাস অনুসারে প্রণীত প্রশ্নে ২০১৯ সালের পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাতটি কেন্দ্রের পাশাপাশি গাইবান্ধা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ ও নেত্রকোনার একটি করে কেন্দ্রে ভুল প্রশ্নপত্র সরবরাহের খবর পাওয়া গেছে। 

যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিকের (এইচএসসি) পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় ভুল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়েছে। ওই প্রশ্নপত্রে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা নম্বর কম পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। অভিভাবকেরাও শিক্ষার্থীদের ভালো ফল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনা ঘটবে কেন? কোনো কোনো কেন্দ্রে বিষয়টি নজরে এলে প্রশ্নপত্র পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার আগে যে সময় নষ্ট হয়েছে, তা পুষিয়ে দেওয়া হয়নি। এর প্রভাব তো পরীক্ষার ফলাফলে পড়বে। কারণ মূল্যায়ন করা হয় খাতা দেখে। কোনো কোনো জায়গায় কেন্দ্রসচিবকে শোকজ করা হয়েছে। কিন্তু এতেই কি ভুল সংশোধন হয়ে গেল। শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মনে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, তার দায় কে নেবে? প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, কোনো কোনো কেন্দ্রে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র পরীক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে অনেক দেরিতে। রাজবাড়ীর একটি কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীর তুলনায় প্রশ্নপত্র কম ছিল। অন্য কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র এনে পরীক্ষা শুরু করতে হয়। এসএসসির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার পরীক্ষার্থীদের ব্যাপারে এমন অবহেলা কেন? 

যেকোনো পাবলিক পরীক্ষার আগে শতভাগ প্রস্তুতির পাশাপাশি সর্বাত্মক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। যেসব কেন্দ্রে এসব ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কোনো সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এ ধরনের ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটে তার জন্য সর্বাত্মক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।  

শিক্ষামন্ত্রী ডা: দিপু মনি গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এইচএসসির প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক উসকানি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এ দেশে কোনো পরীক্ষার প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক কিছু থাকবে সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা চিহ্নিত করছি, এ প্রশ্নটি কোন সেটার করেছেন, কোন মডারেটর করেছেন। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।

এইচএসসির বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষার প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক উসকানির মন্ত্রী আরো বলেন, প্রশ্ন সেটিং প্রশ্ন মডারেটিং কাজগুলো এমনভাবে হয়, যিনি প্রশ্ন সেট করে যান তিনি আর ওই প্রশ্ন দেখতে পারেন না। যিনি মডারেট করে যান তিনিও ওই প্রশ্ন দেখতে পারেন না। সেটার ও মডারেটর ছাড়া প্রশ্নের একটি অক্ষরও কারো আর দেখবার সুযোগ থাকে না। আমাদের একটা সুস্পষ্ট নির্দেশিকা আছে, কী কী বিষয় মাথায় রেখে প্রশ্নগুলো তারা করবেন। প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতার কিছু যাতে না থাকে সেটিও সে নির্দেশিকায় থাকে।

প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক উসকানির বিষয়টি খুবই দুঃখজনক উল্লেখ করে ডা: দীপু মনি আরো বলেন, কোনো একজন প্রশ্নকর্তা প্রশ্নটি করেছেন। যিনি মডারেট করেছেন তার দৃষ্টিও হয়তো কোনো কারণে এটি এড়িয়ে গেছে, বা তিনিও হয়তো এটি স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। আমরা চিহ্নিত করছি এ প্রশ্নটি কোন সেটার করেছেন, কোন মডারেটর করেছন। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। যারা চিহ্নিত হবেন তাদের আর প্রশ্ন প্রণয়নের কার্যক্রমের সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত রাখা হবে না।

শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ধর্মকে সামনাসামনি করা ঠিক হয়নি। মুসলমানের কাছে জমি বিক্রি করে দেশ ত্যাগ করছে- এ সমস্ত তথ্য সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। এ ধরনের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত। এটা কখনো কাম্য নয়। তিনি বলেন, ‘আরো ভালো প্রশ্ন করা যেত। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবতাবোধ বাড়ানো। ধর্মে-ধর্মে সহিষ্ণুতা বাড়াতে কাজ করা।’ অনেক চিন্তা করে পরীক্ষার প্রশ্ন করা প্রয়োজন বলে অধ্যাপক কায়কোবাদ মনে করেন।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ণ কোনো বক্তব্য যেন না থাকে সে জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নে লিখিত নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে ওরিয়েন্টশন করানো হয়। প্রশ্নপত্র দেখার কোনো সুযোগ নেই।’ কিভাবে এ ধরনের প্রশ্ন করা হলো তা পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭