ইনসাইড থট

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’র সাথে সংহতি প্রকাশে ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে প্রাণীবীমার প্রবর্তন জরুরি


প্রকাশ: 10/11/2022


Thumbnail

১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষি বিজ্ঞানীদের আঁতুড়ঘর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ...‘খাদ্য শুধু চাউল, আটা নয়: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ তরিতরকারিও আছে’...।

ক্ষুধা নিবারণ ও দারিদ্র বিমোচন, নিরাপদ পুষ্টির চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি বাণিজ্যিকীকরণ, আমদানি ব্যয় হ্রাস করার ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদের অবদান  গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, মেধাবী জাতি গঠন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতেও প্রাণিসম্পদের বিশাল  অবদান অনস্বীকার্য।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে শাহাদাত বরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্জনের মুকুটের সবচেয়ে মূল্যবান রত্নটি হচ্ছে কৃষিখাতের অবিস্মরণীয় অগ্রগতি। সারা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বনির্ভর একটি দেশ। কিন্তু কৃষির এই অগ্রযাত্রায় আমিষ উৎপাদনকারী খাতগুলোর যেভাবে অগ্রগতি হওয়া প্রয়োজন ছিল, আমাদের প্রাণিসম্পদ খাত ঠিক সেভাবে অগ্রসর হতে পারেনি।

দানাদার খাদ্যে স্বনির্ভরতার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষকে পুষ্টি নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত‘ করার ঘোষণা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রানীসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হলেও মাছ ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও পুষ্টিকর খাবার ক্রয় করার সামর্থ্য অর্জন করেছে। যার ফলে বাংলাদেশে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদির চাহিদাও বেড়েছে।

শুধু তাই নয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের স্বনির্ভর হওয়ার পরেও অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য, কৃষিপণ্য বাণিজ্যিকীকরণ করতে হবে। এই অতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর জন্য দেশে মাংস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের আওতায় প্রানীসম্পদ অধিদপ্তর কৃষকদের উৎসাহিত করছে, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে গরু জবাই করার জন্য প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সরকার দেশের বিভিন্ন জেলায় আধুনিক কসাইখানা স্থাপন করছে। কৃষকের খামারে বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদিত দুধ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্যাকেজিং করে বাজারজাত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করার ব্যবস্থা রেখেছে সরকার। কিন্তু কৃষক তারপরও উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।

প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকার নানান কারণের মধ্যে একটা বড় কারণ হল খামারি মূল ধারার আর্থিক প্রক্রিয়ার সাথে সম্যকভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে না পারা। সরকার বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেছেন, যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা মাইক্রোএন্টারপ্রেনার তাদেরকে, বিশেষকরে প্রাণিসম্পদ খাতে ঋণ বিতরণ করার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ঠিক পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে সরকারী অর্থ বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ হওয়ায় সুদের হার অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে।

প্রাণিসম্পদ খাতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাঁধাসমূহের ক্ষেত্রে প্রান্তিক পর্যায়ে অসচেতনতা, কৃষকের মধ্যে ব্যাংক ঋণের প্রতি ভীতি, আনুষঙ্গিক কাগজ পত্র প্রস্তুতে জটিলতা ও খরচ, সময়সাপেক্ষতা, ঋণ প্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগত ও জামানতজনিত জটিলতা, ব্যাংকিং সেবা কৃষকের দোরগোড়ায় না পৌঁছানো, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণের প্রতি অনীহা, ঋণপ্রাপ্তিতে মধ্যসত্বভোগীর উপস্থিতি, যথাযথ মনিটরিং এর অভাব, ব্যাংকগুলোর তদারকি খরচ বেশী হওয়া, ঝুঁকি হ্রাসকল্পে বীমা সুবিধা না থাকা ও কৃষিঋণ নিয়ে অকৃষিখাতে ব্যবহৃত হওয়াকে চিহ্নিত করা হয়।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, প্রাণিসম্পদ খাতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও প্রানীবীমা বিষয়ে, আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মহোদয়ের সাথে কথা বলেছিলাম। তিনি আমাদের আবেদন অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকের এমডি মহোদয়গণের সাথে মোবাইল ফোনে উচ্চ ভলিউমে কথা বললেন। জনতা ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, এ সমস্ত ব্যাংকের এমডি মহোদয়গণ বললেন, ‘যে আমরা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন খাতে ঋণ দিতে পারি, যদি ঋণের টাকা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে‘। টাকা ফেরতের নিশ্চয়তা কিভাবে হবে? প্রাণীর ইনস্যুরেন্স এর ব্যবস্থা করতে হবে, অর্থাৎ প্রানীবীমা প্রবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে ব্যাংক থেকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণে প্রানীবীমা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা প্রয়োজন।

প্রাণিসম্পদ খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাধারণ বীমা কর্পোরেশন ১৯৮১ সালে প্রাণীবীমা চালু করে, কাগজেকলমে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চালু থাকলেও  কার্যক্রমটি সফল হতে পারেনি। ব্যর্থতার কারণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সেই সময়কালে টেকনোলজি ছিলনা। প্রাণীর রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে সনাক্তিকরণ, ট্রেসএ্যাবিলিটি, ডিজিস ম্যাপিং, ডিজিস সার্ভিলেন্স সিস্টেম বা প্রাণী মৃত্যুহার নির্ণয়ে ন্যাশনাল ডাটা বেইজ কোনটাই তখন ছিল না। বীমা কোম্পানিগুলো প্রতারিত হয়েছেন। কারণ যে গরুটার জন্য বীমা নেওয়া হয়েছিল সে গরুটা মারা না গেলেও, অসাধু খামারী অসত্য তথ্য দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে ঠকিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য পুত্র আইটি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয় এর বদৌলতে এখন তো আমরা বাংলাদেশে 4IR (Fourth Industrial Revolution) বা ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ এর যুগে চলে এসেছি, যেখানে নেচার-এর সিনক্রোনাইজেশন এর পাশাপাশি আর্টিফিশিয়াল ইনটিলিজেন্স এর সিনক্রোনাইজেশন হচ্ছে। মানুষের সনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট‘ এর ন্যায়, সম্প্রতি গরু সনাক্তকরণের জন্য ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গরুর দুই নাকের দুটি ছিদ্রের নীচে মধ্যখানে কালো মাংশল  স্থানটুকু‘র নাম ‘মাজল‘। এই মাজলে প্রাকৃতিক ভাবেই অসংখ্য আঁকাবাঁকা রেখা আছে, যাহা একটি গরুর সাথে অন্য গরুর মিল নেই। প্রযুক্তির মাধ্যমে এই মাজলের ছবি সংরক্ষণ করে গরুর সনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। যাহা দ্বারা প্রাণীর রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে ট্রেসএ্যাবিলিটি সহজেই করা যায়।

প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তির ভূমিকা ও প্রানীবীমা প্রবর্তন‘ নিয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে প্রাণীসেবা লিমিটেড আয়োজিত দিনব্যাপী সেমিনারে বিশেষজ্ঞমহল এবিষয়ে  সচেতনতার জন্য কৃষকদের নিয়ে উঠান বৈঠক, পাঠ্যপুস্তকে ‘আর্থিক সম্পৃক্ততা‘ বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি, কৃষকের ডাটাকে স্বীকৃতি প্রদান ও এ্যাসিটাইজেশন করা এবং এই ডাটার উপর ভিত্তি করে ঋণ প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করা, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজনেস মডেল এর পরিবর্তন নিয়ে আসা, ডিজিটালভাবে ডকুমেন্ট প্রদান করার ব্যবস্থা রাখা, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র পর্যায়ে খামারিদের জন্য সিআইবি চার্জ বাদ দিয়ে ডকুমেন্টেশন চার্জ কমিয়ে আনা, কৃষিঋণ পাওয়ার টার্মস এন্ড কন্ডিশনস গুলোকে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত ও সহজ করা, ফিনটেক ও ফাইনান্সিয়াল ইন্সটিউশন এর পার্টনারশিপের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনা, এজেন্ট ব্যাংকিং এর মতো প্রান্তিক পর্যায়ে লেনডিং ইউনিট যোগ করা, অ্যাপের মাধ্যমে ডকুমেন্ট সাবমিট করে কৃষক যাতে সহজে এবং দ্রুততার সাথে ঋণ পেতে পারে সেই ব্যবস্থা করা, খামারিদের জন্য ট্রেড লাইসেন্স সহজীকরণ করা, প্রাণীকে বন্ধক দিয়ে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা রাখা, প্রাণিসম্পদ খাতের প্রতিটি ঋণ বা প্রণোদনার পাশাপাশি বীমার ব্যবস্থা রাখা, ব্যাংক ও বীমা খাতকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

আগামী দিনে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে করণীয় লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট এর জন্য খামারি বা কৃষককে গরু ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা এবং ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যেন ক্ষতি না হয় সেজন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে গরু সনাক্তকরণের তথ্য সংরক্ষণ করে বীমা প্রবর্তনের নির্দেশনা জরুরী।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭