ইনসাইড থট

গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ফিরে দেখা ১১ নভেম্বর ১৯৯০


প্রকাশ: 11/11/2022


Thumbnail

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুক্তির সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বাঙালির একমাত্র আশারআলো। ইতিহাসবিদরা সেই সত্যকেই যুগে যুগে শুনিয়ে আসছেন।বঙ্গবন্ধুরঅসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়তে পড়তে আমি যেন জীবন্ত হাজির হয়ে উঠি বঙ্গবন্ধুর পেছনে কিংবা সামনে কিংবা কখন পাশে।  ভাষা আন্দোলন , মুক্তিযুদ্ধ , ৭ মার্চ, ৬ দফা , ১১ দফা , ২১ দফা -ছাত্রলীগ এক শিহরণ জাগিয়ে তোলে বাঙালিহৃদয়ে।প্রজন্মের পর প্রজন্মঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল , যেন এক স্বপ্নপুরী।যেখান পড়তে স্বপ্ন দেখে বাংলার তরুণ তরুণীরা যুগে যুগে।সকলেরমতো আমারও স্বপ্ন সত্যি হলো।আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম।আর কিছুদিনের মাঝেই জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করলেন।


কিছুদিন চুপচাপ এরশাদ কি করেন তা সকলের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দেখছিলো। এরপর শুরু হলো আন্দোলন। সামরিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গঠন করা হলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আগুন ঝরা ফেব্রুয়ারী ১৪ জাতির ইতিহাসে আরেকটি স্মরণীয় দিন হয়ে রইলো। ধীরে ধীরে সামরিক সরকার মোড়ক থেকে বেরিয়ে জন্ম নিলো জাতীয় পার্টি এবং রাজনীতিবিদের ভাষায় রাবার স্ট্যাম্প সংসদ। উর্দি ছেড়ে এরশাদ এলেন প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রহসনের ভোটে। কিন্তু সেই সংসদ বেশিদিন টিকলোনা। ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট ভেঙে দিলেন এবং গৃহপালিত বিরোধীদল দিয়ে ৩ মার্চ ১৯৮৮ নতুন সংসদ বানালেন। আবার দানাবাঁধল আন্দোলন গণতন্ত্রের। কিন্তু কোথায় যেন আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যেত। এভাবে ১৯৮৮, ১৯৮৯ চলে গেলো। কিন্তু ১৯৯০ সালে এসে আর জনগণ বসে রইলোনা। বসে রইলোনা সাধারণ ছাত্র সমাজ। এরশাদ তখন নানা বাহানা খুঁজে ক্ষমতায় থাকতে চেষ্টা করছিলো। আর তারই ধারায় ১৯৯০ সালে ক্ষমতায় থাকতে ১০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ১৯৭৩ কে উপেক্ষা করে। কিন্তু বসে রইলো না আইনজীবী শিক্ষক ছাত্ররা। এরশাদের আদেশ হাই কোর্টে চ্যালেঞ্জ হলো। এরই মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিলেন এক অসম সাহসী পদক্ষেপ। ১১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতীকী ক্লাস হবে। উত্তেজনায় আমাদের ঘুম নেই সারা রাত। সকালেই চলে এলাম কলাভবনে। দেখলাম অনেকেই আসছেন। গোয়েন্দারাও আছে। কিন্তু যেমন ঘোষণা তেমনি কাজ। দর্শনের প্রিয় অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদউদ্দিন, এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ফেরদৌস হাসান ক্লাস নিলেন। আমরা প্রতিটি ক্লাসে উপস্থিত থেকে আন্দোলনের ইতিহাসকে এগিয়ে নিলাম। আমার সঙ্গে সেদিন দর্শনের মাশরুর ভাই ছিলেন। সেদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান ছিলেন ওই ক্লাস গুলোতে। লোকমুখে শুনলাম তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ উপাচার্য মনিরুজ্জামান মিয়াকে নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্রোহীদের তালিকা পাঠাতে। কিন্তু কোথায় কার আদেশ নির্দেশ। সারা দেশ তখন জেগে উঠেছে। ২৭ নভেম্বর এরশাদের গুন্ডারা TSC র কাছে গুলি করে হত্যা করে ডাক্তার মিলনকে। রিকশাতে একসঙ্গে আসছিলেন ডাক্তার জালাল মহিউদ্দিন  ও ডাক্তার মিলন।  আমি তখন লাইব্রেরিতে।মনে হচ্ছিল এই বুঝি গুলি আমার গায়ে লাগে লাগে। এরশাদের দিন ফুরিয়ে গেলো ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০। পদত্যাগ করলেন গণঅভ্যুর্থানের মাঝে। 

আজ সেই ১১ নভেম্বর। আমাদের মাননীয় প্ৰধানমন্ত্ৰী সহরওয়ার্দী ময়দানে বিকেলে আসবেন। সাজ সাজ রব। কি বলবেন তিনি সকলের উৎকণ্ঠা। কারণ বিএনপি এরই মাঝে মাঠ গরম করতে চেষ্টা করছেন।  অভিযোগ গণতন্ত্র নেই। অপরদিকে আছে বিশ্ব মন্দা। জাতির সামনে একটি ক্রিটিকাল মোমেন্ট। যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা এক সাগর রক্ত ঝরিয়েছি সেই গণতন্ত্র আজ হুমকিতে। এখন সকলের দায়িত্ব সজাগ থেকে শান্তির পথ খোঁজা।

শহীদ নূর হোসেন ১০ নভেম্বর ১৯৮৭ স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র –জনতার মিছিলে "গণতন্ত্র মুক্তি পাক"  নিজ গায়ে লিখে মিছিলে অংশ নেয়। সেই মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় শহীদ নূর হোসেনকে। শহীদ নূর হোসেনের মতো সমগ্র জাতির ত্যাগের বিনিময়ে যে গণতন্ত্র আমরা ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলাম তার সুফল ভোগ করেছেন বেগম খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। সেই বিএনপি ২০০১ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে এক বিভৎস চেহারায় অবতীর্ণ হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অবর্ণনীয় নিপীড়ন,  নির্যাতন চালায়। তাদের শাসনের আমলে ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা করে মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমানকে। আজও সেই হামলার ভয়াবহতা মনে করে অসংখ্য আওয়ামী লীগ কর্মী শিহরিত হন!  জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করে ইদমেনি এই মহল। তারা বারবার জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছে। তাদের এই কর্মকান্ড সীমা ছাড়িয়ে জনতার উপর আঘাত হানে। ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকাতে,  ২০১৫ সালে সরকার উৎখাত করতে পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে জনতার উপর। সেই নির্মমতাকে মোকাবেলা করতে জনগণের পাশে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকরা।

১৯৯০ সালের  ১১ নভেম্বর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক -ছাত্ররা, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তির সংগ্রামে  যেভাবে ছাত্র -শিক্ষকরা অবদান রেখেছেন সেই অবদানকে আমরা যেন সকলে স্মরণ রাখি - সেই প্রতাশ্যা থেকে আমার আজকের লেখা। 

যে শিক্ষকরা ১৯৯০ সালে সামরিক লেবাসে থাকা সরকারকে বিতাড়নে অবদান রাখে তাদেরকে ২০১৫ সালের পে স্কেল শিক্ষকদেরকে দুই ধাপ নামিয়ে দেয়া , আমলাদেরকে ৩০ লক্ষ টাকার গাড়ির সুবিধা সহ মাত্রাতিরিক্ত বিদেশ ভ্রমণ সুবিধা দেয়া কি ন্যায় ও ন্যায্যতার শর্ত পূরণ করে? ওই সব অসমতাসামান্য হলেও যেমন সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি ও আজকের অর্থনৈতিক সংকটের মুলে অবদান রাখছে সেটা যেন সরকার বিবেচনায় নেন।

পত্রিকায় দেখেছি বিদেশী ভ্ৰমণ কমানো হয়েছে। কিন্তু বিদেশী বা দেশি কোম্পানির অর্থায়নেভ্ৰমণ অব্যাহত আছে। আছে অবৈধ অর্থ  পাচার - যারা বিদেশ থেকে টাকা নিয়ে আসে সেই শ্রমিক আজ নিপীড়িত আর যারা পাচার করে তারা সমাজে হয় ক্ষমতায় বাহাদুর কিংবা দাপটে !

কেবল বিদেশ ভ্রমণ কমানো নয়, গাড়ির সুবিধা কমানোর প্রয়োজন আছে বলে বিবেচনা করা যায়। কারণ আজকের মূল সংকট জ্বালানিও প্রাইভেট কার। সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মাঝে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে। "ঋণ করে হলেও ঘি খাও" নীতি আলিঙ্গন করে আমাদের অনেকেই গাড়ি কিনছে সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রাখতে।

গণতন্ত্র মানে কেবল একটি নির্বাচন নয়। গণতন্ত্র ও নির্বাচন যেটা বলে সেটা হলো সকলে সমান -সচিব কিংবা দলের প্রধান হলেও ভোট একটি। এই সমতার কথা গণতন্ত্র বলে।  আমাদের অনেক নীতি সেই সমতাকে অস্বীকার করছে।  ফলে গণতন্ত্র হুমকিতে পড়ছে।

আমরা ইট -পাথরের উন্নয়ন চাই না - মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়ার উন্নয়ন চাই না।  অনেকেই প্রশ্ন করেছেন - পদ্মা সেতু হওয়ার পরেও কেন বরিশাল -খুলনার মানুষ বিএনপিরজনসভাতে গেলো ? সেই কারণ খুঁজতে হবে আমাদেরকে।

সমাজের যারা গণতন্রের মুক্তিতে অবদান রেখেছেন তাদেরকে উপেক্ষা করে যিনি পদে আছেন তিনি যে আচরণ করছেন তা মানুষকে সংক্ষুব্ধ করছে কি? আমরা হাইব্রিড -কাউয়ার কথা শুনি। কিন্তু সেই হাইব্রিড - কাউয়ার বিষয়ে কোনো অর্থবহ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি? বরং অভিযোগ আছে যারা ত্যাগ করেছেন তাদরেকে নির্যাতন করা হচ্ছে। 

আজকের জনসভাতেনূর হোসেনের ত্যাগের কথা, বঙ্গবন্ধু যে নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছেন তাদের কথা মাননীয় প্ৰধানমন্ত্ৰী কি বলবেনআমলা -পুলিশ নয়, জনগণ হোক রাজনীতির ভরসা। বন্ধ হোক বৈষম্য , নিপীড়ন , নির্যাতন। নির্মূল হোক দুর্নীতি। আর সে জন্য আমাদের সকলকে সোচ্চার হতে হবে। জাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক -ছাত্রদের কাছে আশা করে তারা যেন রাজনীতিবিদেরকে হুশিয়ার করে -গণতন্ত্র মানে ক্ষমতায় যাওয়া ও তার সুফল একা একা ভোগ করা নয়। গণতন্ত্র মানে স্বাধীনতা - কথা বলবার স্বাধীনতা, নিজের অধিকার ভোগের স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার পাবার অধিকার। ভোটের গণতন্ত্র গণতন্ত্র নয় - মানবতার বিজয় ও মানুষের মর্যাদাকে সন্মান করে যে কাজ সেটাই গণতন্ত্র। সমাজ সেবার পরিবর্তে রাজনীতি হয়ে গাছে বাণিজ্য- সেই বাণিজ্য বন্ধ হোক।

ফরিদ আহমেদ, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭