ইনসাইড আর্টিকেল

চাঁপাইনবাবগঞ্জে সুপেয় পানির হাহাকার


প্রকাশ: 13/11/2022


Thumbnail

উত্তরের জনপদ চাঁপাইনবাবগঞ্জে মিঠা পানির বদলে উঠছে উষ্ণ আর লবনাক্ত পানি। পানির স্তরও নেমে গেছে অনেক গভীরে আর সেখানে মিলছে পাথরের স্তর। ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার কয়েকটি এলাকায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। এছাড়া খনিজ আয়রণ আর আর্সেনিক আধিক্যের ফলে সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। নদীমাতৃক মিঠা পানির অঞ্চলে হঠাৎই লবনাক্ত পানির প্রশ্রবণ ভাবিয়ে তুলেছে এলাকার বাসিন্দাদের। বিষয়টিকে অশনি সংকেত হিসেবে অভিহিত করছেন পানি বিশেষজ্ঞরা। বরেন্দ্র অঞ্চলে গভীর নলকূপের যথেচ্ছ ব্যবহার আর চরাঞ্চলে পদ্মা-মহানন্দা-পুর্নভবা নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এমন সংকট সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পানি বিশেষজ্ঞরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক পরীক্ষায় এসব এলাকার পানির ঘনত্ব বিশ্লেষণে দ্রবীভ‚ত কঠিন পদার্থের মিশ্রণের পরিমান মিলেছে ১৭১০ মাল্টিমিটার। বাংলাদেশের সুপেয় পানিতে এর স্বাভাবিক মান ১০০০ মাল্টিমিটার। অতিরিক্ত এই দ্রবণের ফলে পানিকে করে তুলেছে উষ্ণ এবং লবনাক্ত। 

লবনাক্ত এই পানির সন্ধান মিলেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার রেহাইচর, শিবতলা, জোড়বাগান, রাজারামপুর, নামোশংকরবাটীসহ পাশর্^বর্তী বেশ কয়েকটি এলাকায়। 

জোড় বাগান এলাকার বাসিন্দা চামেলী বেগম ও গৃহবধু ফিরোজা খাতুনসহ অনেকে জানান, বছর খানেক আগে থেকে আমাদের ট্যাপের পানি গমর এবং লবনাক্ত। এছাড়া পানি ঘোলা আর তীব্র গন্ধ। পানি তোলার পর ১/২ ঘন্টা পর তা ব্যবহার করতে হয়। এই পানিতে গোসল করলে শরীর চুলকায়। এজন্য আমরা খাওয়ার জন্য অনেক দূর থেকে টিওবয়েলের পানি নিয়ে আসতে হয়। 

আরিফুর রহমান বাপ্পি নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, আমাদের এলাকায় টিওবয়েলে পানি ঠিকমত উঠছে না। সমুদ্র তীর থেকে এসব এলাকা প্রায় ৭’শ কিলোমিটারের বেশি দূরে। অথচ আমাদের এই মিঠা পানির অঞ্চলে দেখা দিয়েছে লবন পানি। এই পানি পান করার কোন উপায় নেই।

এদিকে সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া গ্রামে অত্যাধিক আর্সেনিকের কারনে দেখা দিয়েছে জটিল চর্মরোগসহ বিভিন্ন উপসর্গ। স্থানীয়রা এই গ্রামের নাম দিয়েছে আর্সেনিক গ্রাম। বিগত প্রায় দুই দশক ধরে আর্সেনিক সমস্যায় ভ‚গছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার রাজারামপুর, নামোশংকরবাটী, নয়ানশুকা ও চামাগ্রামের বাসিন্দারা। এছাড়া সদর উপজেলার বারঘরিয়া, মহারাজপুর এবং শিবগঞ্জের রানীহাটি ও তার পাশর্^বর্তী এলাকার মানুষ বসবাস করছেন আর্সেনিক ঝুঁকি নিয়ে। ক্রমেই বাড়ছে এর পরিধি। 

বেতবাড়িয়া গ্রামের আর্সেনিক আক্রান্ত কৃষক নজরুল ইসলাম, নির্মাণ শ্রমিক রিকন আলী ও শাহনাজ বেগমসহ অনেকে জানান, আর্সেনিকের কারনে আমাদের জীবন দূবির্ষহ করে তুলেছে। এখন কোন কাজ করতে পারিনা। হাত ও পায়ের তালুসহ শরীরে ঘা হয়ে গেছে। আমাদরে শরীরের ঘা থেকে পচা দূর্গন্ধ ছড়ায়। ফলে আশে পাশের মানুষ আমাদের পাশে দূর্গন্ধে থাকতে পারে না। এছাড়া পুরো শরীর সবসময় প্রচন্ড চুলকায় এবং যন্ত্রণা করে। 

গৃহবধু আলেপ নূর বেগম জানান, আমার অবস্থা শেষ পর্যায়ে। ডাক্তারা আমাকে রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি নিচ্ছিল না। বলছিল আমি না কি মারা যাব। আমার স্বামী দিনমজুর, এখন চিকিৎসা চলছে তবে প্রতিদিন দামী ঔষধ কিনে খাওয়ার সামর্থ আমার নাই। তাই দিন দিন আমার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।

অন্যদিকে মহানন্দা নদী পার্শ্ববর্তী বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের পানিতে অধিক আয়রণের ফলে পানি দিন দিন ব্যবহারে অনুপযোগী হয়েছে উঠছে বলে জানিয়েছে এলাকাবাসাী। পানিতে মাত্রারিক্ত আয়রণের কারনে স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। 

বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের আইনুল হক, তোহিদুল হক তুহিন, মর্জিনা বেগমসহ অনেকে জানান, আমাদের এখানকার খাবার পানি কখনও লাল কখনও হলুদ আবার কখনও ঘোলা বর্ণের। লাইনের পানিতে মাঝে মাঝে প্রচুর ফেনাযুক্ত পানিও আসে। দূর্গন্ধর কারনে অনেক সময় পানি খেতে পারিনা। আবার যখন ভাল পানি আসে তখন সেগুলো ব্যবহার করি। 

রবিউল ইসলাম নামে একজন জানান, নিজের পরিবার আর গবাদি পশুকে দিনের পর দিন এই লাল রংয়ের পানি খাওয়াচ্ছি। বেশ কয়েকবার পাইপ এবং জায়গা পরিবর্তন করেছি কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এই অতিরিক্ত আয়রণ পানি আমাদের খাওয়াসহ সব কাজে ব্যবহার করতে হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী ইমরান হোসেন জানান, পৌর এলাকার তিনটি স্থানে আমরা ডিপ টিউবওয়েল বসিয়েছি। এতো গভীরে যাওয়ার পারও পানি উষ্ণ এবং লবনাক্ত। বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তিত। এটা নাগরিকদের জন্য অশনিসংকেত, দ্রæত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে এটা দূর্যোগে রূপ নিতে পারে বলে আমরা আশংকা করছি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের র্নিবাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার সরকার জানান, পানির লবনাক্ততা আসছে ডিপ লেয়ার থেকে। কারন এখানে ৮’শ থেকে একহাজার ফুট গভীর থেকে পানি তুলতে হচ্ছে আবার সেখানেও পাথরের লেয়ার। আর আপার লেয়ারে আর্সেনিক ও আয়রণের সমস্যা আছে। যা জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. এসএম মাহমুদুর রশিদ জানান, আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করায় এই এলাকার মানুষ আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছে। প্রথমত তাদের আর্সেনিক মুক্ত পানি পান করতে হবে। এন্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিনসমুহসহ যেসব ঔষধ প্রয়োজন সেগুলো সংগ্রহ করে তাদের দিয়েছি। তবে সদর হাসপাতালে কোন চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ নেই। এক্ষেত্রে রোগীদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন জানান, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এসব এলাকায় কমপক্ষে দুইটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মানের জন্য আমি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানাব। তবে ভ‚গর্ভের পানি ব্যবহার না করে আমরা যেন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করি সেবিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭